স্বাস্থ্য খাতের অঘোষিত মাফিয়া সিন্ডিকেট গড়ে হাজার কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়া মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরে কৌশল বদলে নয়া সিন্ডিকেট গড়ছেন মিঠু। শত কোটি টাকার টেন্ডার বাগিয়ে নিতে দলে ভেড়াতে নতুন পদায়ন হওয়া কর্মকর্তাদের দেওয়া হচ্ছে টোপ।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর সংস্কারের জন্য রাষ্ট্রের সব খাতেই চলছে রদবদল। এর বাইরে নেই স্বাস্থ্য খাতও। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সূত্রে জানা যায়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর, নিপসম থেকে শুরু করে সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রিন্সিপাল, হাসপাতালের পরিচালক, তত্ত্বাবধায়ক, চিকিৎসকসহ সব পদে শুরু হয়েছে পরিবর্তনের জোয়ার। এর ফলে ভেস্তে গেছে মিঠু সিন্ডিকেটের সাজানো গুটিগুলো। তাই নতুন করে সিন্ডিকেট গড়ে তুলতে জোরেশোরে মাঠে নেমেছেন এ চক্রের সদস্যরা। নতুন পদায়ন পাওয়া কর্মকর্তাদের দেওয়া হচ্ছে টোপ। যাতে কেনাকাটার প্রক্রিয়া শুরু হলেই কাজ হাতাতে পারে এ চক্র। টার্গেট করা পদে যোগদানের সঙ্গে সঙ্গে ওই কর্মকর্তাদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে মিঠুর পাঠানো ফুল ও উপহার। বিভিন্নভাবে সম্পর্ক বাড়ানোর চেষ্টা চলছে এসব কর্মকর্তার সঙ্গে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকার একটি সরকারি মেডিকেল কলেজে নতুন প্রিন্সিপাল যোগদানের খবর শুনেই তার চেম্বারে ফুল নিয়ে পৌঁছে যান দুজন ব্যক্তি। ওই চিকিৎসক তাদের প্রতিষ্ঠানের নাম জিজ্ঞেস করলে নতুন একটি প্রতিষ্ঠানের নাম শোনেন। প্রতিষ্ঠানের কাজ, মালিকানা নিয়ে জেরার মুখে বেরিয়ে আসে ভয়ংকর তথ্য। অন্যের নামে কোম্পানি খুলে সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করে যাচ্ছেন মিঠু। মিঠুর প্রতিষ্ঠান বুঝতে পেরে তাদের কক্ষ থেকে বের দেন ওই প্রিন্সিপাল। একই ভাবে নানা উপহার, বিদেশ যাওয়া, নগদ অর্থসহ বিভিন্ন প্রলোভন দেওয়া হচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা কিংবা ঢাকার বাইরের মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপাল। হাসপাতালের পরিচালকদেরও দেওয়া হচ্ছে এসব উপঢৌকনের টোপ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক ডা. মাহবুব আরেফীন রেজানুর বলেন, ‘কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত প্রেতাত্মা স্বাস্থ্য খাত দুর্বল করে ফেলেছে। টেন্ডার, কেনাকাটায় দুর্নীতি, বদলি বাণিজ্য করে মিঠু সিন্ডিকেটে জড়িয়ে হাতিয়ে নিয়েছে শত শত কোটি টাকা। এসব দুর্নীতিবাজ যেন কোনোভাবেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আবার থাবা বসাতে না পারে সেজন্য আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছি। নতুন কৌশলে মিঠু সিন্ডিকেট মাথা চাড়া দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কোনোভাবেই যেন এ সিন্ডিকেট স্বাস্থ্য খাত গ্রাস না করতে পারে এজন্য আমরা সতর্ক নজর রাখছি। দুর্নীতি প্রতিরোধের এ আন্দোলন আমরা চালিয়ে যাব, এজন্য গণমাধ্যমের সহযোতিা প্রত্যাশা করি।’
দুদকসূত্রে জানা যায়, বছরের পর বছর ধরে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে মালামাল সরবরাহ ও উন্নয়ন কাজের নামে সরকারের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন মিঠু-এমন একাধিক অভিযোগ অনুসন্ধান করে দুদক। বারবার দুদক থেকে তলব এবং সম্পদ বিবরণী চাওয়া হলেও মিঠু এসবের তোয়াক্কা করেননি। এক যুগ আগে তাঁর সম্পদ বিবরণী চেয়ে নোটিস দিয়েছিল দুদক, কিন্তু তিনি সম্পদের হিসাব দাখিল করেননি। পরে তাঁর বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলাও হয়। পরে ‘তদবির’ করে দুদকের ওই মামলা থেকে অব্যাহতি পান মিঠু। করোনাকালে স্বাস্থ্যসামগ্রী সরবরাহে দুর্নীতির অভিযোগে অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে মিঠুকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করেছিল দুদক। তবে তিনি হাজির হননি। অদৃশ্য কারণে তাঁর বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হয়নি। সর্বশেষ যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর ৫০০ কোটি টাকার সম্পদ জব্দ হওয়ার খবর প্রকাশের পর নড়েচড়ে বসে দুদক। পরে গত বছর তাঁর জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ফের অনুসন্ধান শুরু করে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটি। ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক বনে যাওয়া সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদের ব্যবসার অংশীদার মিঠু। অভিযোগ আছে, অতীতে দুদকের বিভিন্ন অনুসন্ধান ও মামলা থেকে মিঠুকে রক্ষা করতে বেনজীর আহমেদ সহায়তা করেছেন। সর্বশেষ মিঠুর বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ নিয়ে অনুসন্ধানে নেমে তাঁর স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি জব্দ করেছে দুদক। গত বছরের ১৯ অক্টোবর দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর প্রায় ৭৪ কোটি টাকা মূল্যের সম্পদ জব্দ করার আদেশ দেন আদালত। একই সঙ্গে তাঁর বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞাও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এসবের তোয়াক্কা না করে পুনরায় মাথা চাড়া দিচ্ছে মিঠু সিন্ডিকেট।