বাজারে মিলছে না বোতলজাত সয়াবিন তেল। দুই-এক দোকানে পাওয়া গেলেও ১০ থেকে ২০ টাকা বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে ১ লিটারের বোতল। চাহিদামতো তেল না পেয়ে বিপাকে পড়েছেন ভোক্তা। তেল আমদানির জন্য
ঋণপত্র (এলসি) খুলছে না ব্যাংকগুলো। বিশ্ববাজারে দাম বাড়ায় দেশে উৎপাদন খরচ বাড়লেও দাম বাড়েনি। সরবরাহ বাড়াতে সরকারের সহায়তা পাচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা। এসব কারণে ভোজ্য তেলের জন্য হাহাকার শুরু হয়েছে।
জানা গেছে, গত সেপ্টেম্বরের শুরু থেকেই ঊর্ধ্বমুখী দেশের ভোজ্য তেলের বাজার। শতভাগ মার্জিন ছাড়া এলসি খোলা যাবে না বলে তফসিলি ব্যাংকগুলোকে জানিয়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তারপর ব্যাংকগুলো তেল আমদানির জন্য ঠিকমতো ঋণপত্র (এলসি) খুলছে না। ফলে দুই-তিনটি ছাড়া অন্য কোনো কোম্পানির বোতলজাত সয়াবিন তেল পাওয়া যাচ্ছে না। যেসব কোম্পানির তেল পাওয়া যাচ্ছে, সেটাও চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত নয়। বিশেষ করে ৫ লিটারের বোতলের সরবরাহ একেবারেই নাই। দাম বাড়ার এই সময়ে ৫ লিটারের বোতল কিনলে একটু সাশ্রয় হলেও তা মিলছে না বলে জানিয়েছেন ক্রেতা-বিক্রেতা। সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন, এভাবে চলতে থাকলে আসন্ন রোজার মাসে ভোজ্যতেলের সংকট সমগ্র বাজারকে অস্থির করে তুলতে পারে। তেল কোম্পানির প্রতিনিধিরা বলছেন, বেশ কিছুদিন ধরেই দেশে সয়াবিন তেলের সংকট চলছে। সংকটের শুরু থেকে ঋণপত্র (এলসি) খোলার হার ও আমদানি পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে কি না, সেদিকে সরকারের বড় নজরদারির দরকার ছিল। কিন্তু কোনো খবরই রাখেনি। পিঁয়াজ সংকট মোকাবিলার উদাহরণ টেনে তারা বলেন, আমদানি স্বাভাবিক রাখতে সরকার বিশ্ববাজার পর্যবেক্ষণ করে ব্যবসায়ীদের সাহস দিতে পারতেন। প্রয়োজনে বেসরকারি উদ্যোগে ভোজ্য তেল আমদানি করে সরকারিভাবে মজুত করা যেত। তেল উৎপাদনকারী কোম্পানির প্রতিনিধিরা আরও বলেন, অতীতে দেশে পিঁয়াজ সংকটের সময় সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ সহায়তা করার কারণে বাজার স্বাভাবিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা গিয়েছিল। একাধিক কারণে বর্তমানে ভোজ্যতেলের বাজার অস্থির। দেশে ডলার সংকট পুরোপুরি কাটেনি। আমদানিকারকরা আগের মতো ভোজ্য তেল আমদানি করতে পারছেন না। বিশ্ববাজারে ভোজ্য তেলের দামও আগের চেয়ে বেড়েছে। এসব কারণে ভোজ্য তেলের দাম ঊর্ধ্বমুখী। দেশের ইতিহাসে পাম অয়েলের দাম এবারের মতো আর বাড়েনি। মূলত ইন্দোনেশিয়ায় উৎপাদন সংকট, বায়োডিজেলে পাম অয়েল ব্যবহারের পরিমাণ পাঁচ শতাংশ বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যটির বুকিং রেকর্ড পরিমাণে বেড়েছে। ভোজ্য তেলের পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, দেশে সয়াবিন তেল আমদানি যে দিন দিন কমছে সেটা আমলে নেওয়া হয়নি। তাদের অভিযোগ, সরকারের তদারকি সংস্থাগুলো আমদানি-সংক্রান্ত যে তথ্য দিচ্ছে, বাস্তবের সঙ্গে তার কোনো মিল নেই। এই তথ্যগুলো সাত-আট মাস আগের। ফলে দেশে সয়াবিন তেল পর্যাপ্ত মজুতের ‘ভুল’ বার্তা যাচ্ছে দেশবাসীর কাছে।
আমদানিকারকরা জানিয়েছেন, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন, এলসি জটিলতা, সুদহার বৃদ্ধির চাপ কাটিয়ে উঠতে না পেরে দেশের কয়েকটি গ্রুপ ভোজ্য তেলের বাজার থেকে সরে গেছে। বিশ্ববাজারের অস্থিরতার ধাক্কা পড়েছে। বিশ্ববাজারে ৪০ শতাংশ বেড়েছে অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের দাম। ফলে সরকারের ১০ শতাংশ শুল্ক কমানোর প্রভাব পড়ছে না। সেই দামের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সমন্বয় করতে না পারার কারণেই মূলত দেশে ভোজ্য তেল নিয়ে এমন ঘটনা ঘটেছে।
রাজধানীর বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বোতলজাত সয়াবিন অনেক দোকানে পাওয়াই যাচ্ছে না। কিছু কিছু দোকানে এক লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেল মিললেও তা বিক্রি হচ্ছে ১৬৭ থেকে ১৭০ টাকায়। স্থানভেদে একই সয়াবিন তেল ১৭৫ থেকে ১৮০ টাকা দরেও বিক্রি হচ্ছে। বর্তমানে খোলা পাম তেল ১৬০ থেকে ১৬২ এবং সয়াবিন তেল ১৭০ থেকে ১৭৫ টাকায় প্রতি লিটার বিক্রি হচ্ছে। খোলা সয়াবিন তেলের কেজি ১৯৫ থেকে ২০০ টাকায় বিক্রি করতে দেখা গেছে।
এ বিষয়ে সিটি গ্রুপের করপোরেট অ্যাফেয়ার্স ডিরেক্টর বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম ৪০ শতাংশ বেড়েছে। গত ৫ ডিসেম্বর ট্যারিফ কমিশন আমাদের ডেকেছিল। সেখানে সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছি। বিশ্বজিৎ আরও বলেন, সরকার ১০ শতাংশ শুল্ক কমালেও উৎপাদন ব্যয় বেশি। এ ছাড়া বর্তমান পরিস্থিতিতে লাভ হওয়ার নিশ্চয়তা না থাকায় ব্যাংকগুলো ঋণপত্র (এলসি) খুলতে ইতস্তত করছে। তিনি বলেন, আমরা সরকারকে প্রস্তাব দিয়েছি আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে সয়াবিন তেলের দাম বাড়াতে।
বরিশালের বাজারে সয়াবিন তেলের সংকট : বরিশালের নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, বরিশালের বাজারগুলোতেও বোতলজাত সয়াবিন তেলের সংকট দেখা দিয়েছে। বিক্রেতারা জানিয়েছেন, বর্তমানে কোনো কোম্পানি বোতলজাত সয়াবিন তেল নিয়ে আসে না। যারাও আসে এক কিংবা দুই লিটারের বোতল। পাঁচ লিটারের কোনো বোতল নেই। এসব বোতলজাত তেল এক কার্টনের বেশি দিতে চায় না। সেই এক কার্টন কিনলে সঙ্গে ধরিয়ে দেয় সরিষার তেল, আটা, ময়দা সুজি, চিনিগুড়া চালের কিংবা নুডুলসের প্যাকেট। তাই আমরাও সেইভাবে বিক্রি করি।
বগুড়ার বাজারে মিলছে না বোতলজাত সয়াবিন তেল, বিপাকে ক্রেতারা : বগুড়ার নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, বগুড়ার বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেলের সংকট দেখা দেওয়ায় বিপাকে পড়েছেন ক্রেতারা। দুই-একটি দোকানে পাওয়া গেলেও বোতলের গায়ের দরের চেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে। গত শনিবার বগুড়ার রাজাবাজার, ফতেহ আলী বাজার ও কলোনি বাজারসহ অন্যান্য বাজার ঘুরে এই দেখা গেছে। পাঁচ লিটারের বোতল পাওয়া গেলেও এক-দুই লিটারের বোতল নেই। বোতলজাত সয়াবিন তেলের সংকটে বেড়েছে খোলা সয়াবিন ও পাম তেলের দাম।