বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের নিয়ে বিপুল সংখ্যক ছাত্র-জনতার উপস্থিতিতে জুলাই গণ অভ্যুত্থানের রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক স্বীকৃতির অঙ্গীকার রেখে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ ঘোষণা করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ঘোষণাপত্রে গণ অভ্যুত্থানে শহীদদের জাতীয় বীর ঘোষণা করা হয়। এতে বলা হয়, শহীদদের পরিবার, আহত যোদ্ধা এবং আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতাকে প্রয়োজনীয় সব আইনি সুরক্ষা দেওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে। ২৮ দফার ঘোষণাপত্রে বলা হয়, ‘৫ আগস্ট ২০২৪ সালে গণ অভ্যুত্থানে বিজয়ী বাংলাদেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হিসেবে এই ঘোষণাপত্র প্রণয়ন করা হলো।’ ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা থেকে শুরু করে ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলন ঘোষণাপত্রে স্থান পেয়েছে।
জুলাই গণ অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তিতে গতকাল জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় অস্থায়ী মঞ্চে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ পাঠ করেন প্রধান উপদেষ্টা। বিকাল ৫টা ২২ মিনিটে তিনি ঘোষণাপত্র পাঠ শুরু করেন। মঞ্চের দুই পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা। বৃষ্টির মধ্যেই বক্তব্য শুরু করে ড. ইউনূস বলেন, ‘আল্লাহর রহমত হচ্ছে। সেই রহমত সঙ্গে নিয়েই ঐতিহাসিক ঘোষণা পাঠ করছি।’ অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত নেতা-কর্মী ও সমর্থকরা ছাতা হাতে কিংবা ভিজে দাঁড়িয়ে ছিলেন। প্রতিকূল আবহাওয়া সত্ত্বেও পুরো অনুষ্ঠান বিপুল সংখ্যক মানুষের উপস্থিতিতে শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়। ঘোষণাপত্র পাঠ শেষে উপস্থিত রাজনৈতিক দলের প্রধানদের সঙ্গে কোলাকুলি বা বুক মেলান তিনি। অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া নেতাদের মধ্যে ছিলেন- বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান এবং সালাহউদ্দিন আহমেদ, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর, নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না, জামায়াতের মিয়া গোলাম পরওয়ার, এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান জোনায়েদ সাকি। মঞ্চের সামনে বসা ছিলেন সরকারের অন্যান্য উপদেষ্টা, বিভিন্ন দলের নেতাসহ অন্যরা। অনুষ্ঠানস্থলে রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে ছিল পারস্পরিক শুভেচ্ছা বিনিময়ের উষ্ণতা। জাতীয় সংগীত পরিবেশনার মাধ্যমে শুরু হয় ‘জুলাই পুনর্জাগরণ’ অনুষ্ঠান। এর পরই মঞ্চে আসেন প্রধান উপদেষ্টা। পাঠ করেন ২০২৪ সালের গণ অভ্যুত্থান-ভিত্তিক ঐতিহাসিক দলিল ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’। দলিলটি রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নিয়ে চূড়ান্ত করে অন্তর্বর্তী সরকার।
জুলাই ঘোষণাপত্রে বলা হয়, যেহেতু বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সংকট মোকাবিলায় গণ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত জনগণের সার্বভৌমত্বের প্রত্যয় ও প্রয়োগ রাজনৈতিক ও আইনি উভয় দিক থেকে যুক্তিসঙ্গত, বৈধ ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। আরেক অংশে বলা হয়, বাংলাদেশের আপামর জনগণ দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই ভূখণ্ডে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বিবৃত সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের ভিত্তিতে উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়নের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছে। যেহেতু স্বাধীন বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রণয়ন পদ্ধতি, এর কাঠামোগত দুর্বলতা ও অপপ্রয়োগের ফলে স্বাধীনতা-পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকার মুক্তিযুদ্ধের জনআকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ হয়েছিল এবং গণতন্ত্র ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকারিতা ক্ষুণ্ন করেছিল। জুলাই ঘোষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে শেখ হাসিনার দেশ ছেড়ে যাওয়ার বিষয়টিও।
বলা হয়, ‘অবৈধ শেখ হাসিনা সরকারের পতন, ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ ও নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের লক্ষ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে জনগণ অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে। ৫ আগস্ট ঢাকা অভিমুখে লংমার্চ পরিচালনা করে। ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনরত সব রাজনৈতিক দল, ছাত্র-জনতা তথা সর্বস্তরের সব শ্রেণি, পেশার আপামর জনসাধারণের তীব্র আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে গণভবনমুখী জনতার উত্তাল যাত্রার মুখে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।’ ঘোষণাপত্রে বলা হয়- অবৈধভাবে ক্ষমতা ধরে রাখতে আওয়ামী লীগ সরকার ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে তিনটি প্রহসনের নির্বাচন করেছে। আওয়ামী লীগ এদেশের মানুষকে ভোটাধিকার ও প্রতিনিধিত্ব থেকে বঞ্চিত করেছে। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, তথাকথিত উন্নয়নের নামে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী নেতৃত্বে সীমাহীন দুর্নীতি, ব্যাংক লুট, অর্থ পাচার ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংসের মধ্য দিয়ে বিগত পতিত দুর্নীতিবাজ আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশ ও এর অমিত অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে বিপর্যস্ত করে তোলে এবং এর পরিবেশ, প্রাণবৈচিত্র্য ও জলবায়ুকে বিপন্ন করে। তিনি বলেন, শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দল, ছাত্র ও শ্রমিক সংগঠনসহ সমাজের সর্বস্তরের জনগণ গত প্রায় ১৬ বছর নিরন্তর গণতান্ত্রিক সংগ্রাম করে জেলজুলুম, হামলা-মামলা, গুম-খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়। বাংলাদেশের জনগণ যুক্তিসঙ্গত সময়ে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ একটি নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত জাতীয় সংসদে প্রতিশ্রুত প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে দেশের মানুষের প্রত্যাশা, বিশেষত তরুণ প্রজন্মের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী আইনের শাসন ও মানবাধিকার, দুর্নীতি, শোষণমুক্ত, বৈষম্যহীন ও মূল্যবোধসম্পন্ন সমাজ এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে।
‘জুলাই স্মৃতি জাদুঘর’ পরিদর্শন প্রধান উপদেষ্টার : গতকাল জুলাই গণ অভ্যুত্থান দিবস উপলক্ষে গণভবনে নির্মাণাধীন ‘জুলাই গণ অভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘর’-এর নির্মাণকাজের অগ্রগতি পরিদর্শন করেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। জাদুঘরটি ২০২৪ সালের ঐতিহাসিক জুলাই অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট, সংগ্রাম, শহীদ এবং বিজয়ের দলিলরূপে নির্মাণাধীন রয়েছে। এর আগে জুলাই গণ অভ্যুত্থান দিবস উপলক্ষে জেলা প্রশাসনের উদ্দেশে এক ভিডিও বার্তায় প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আজ আমরা পুরো জাতি একসঙ্গে স্মরণ করছি এমন একটি দিন, যা এদেশের ইতিহাসে গভীর ছাপ রেখে গেছে। ৫ আগস্ট শুধু একটি বিশেষ দিবস নয়, এটি একটি প্রতিজ্ঞা, গণজাগরণের উপাখ্যান এবং ফ্যাসিবাদী শাসন থেকে জাতির পুনর্জন্মের দিন। তিনি বলেন, ‘মানুষের বুকে গুলি চালিয়ে শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা আঁকড়ে রাখতে চেয়েছিল ফ্যাসিবাদী সরকার। তারা নির্বিচারে গুলি করেছে, গ্রেপ্তার করেছে, ইন্টারনেট বন্ধ করে হত্যাকাণ্ডের তথ্য লুকাতে চেয়েছে, রাতের অন্ধকারে এলাকায় এলাকায় অভিযান চালিয়ে ছাত্রদের আটক করেছে।’ তিনি দেশবাসীকে কোনো ধরনের নিপীড়নের কাছে মাথা না নোয়াতে এবং গণতান্ত্রিক, বৈষম্যহীন ও জনকল্যাণকর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান।