গত বছরের ৫ আগস্ট ছিল ফ্যাসিবাদমুক্তির দিন। মানুষ স্বৈরাচারের কবল থেকে মুক্ত হয়েছিল, বাংলাদেশ হয়েছিল আরেকবার স্বাধীন। আর এবারের ৫ আগস্ট হলো মানুষের আকাঙ্ক্ষা পূরণের দিন, অনিশ্চয়তা-শঙ্কা দূর হওয়ার দিন। সব জল্পনাকল্পনা-শঙ্কার অবসান ঘটিয়ে ৫ আগস্ট (মঙ্গলবার) রাতে প্রধান উপদেষ্টার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণটি ছিল যেন তীব্র দাবদাহের পর এক পশলা বৃষ্টির মতো। প্রধান উপদেষ্টা তাঁর কথা রাখলেন। প্রমাণ করলেন অঙ্গীকার পূরণের মাধ্যমেই তিনি এ অনন্য উচ্চতায় আসীন। প্রধান উপদেষ্টার এ ভাষণ দেশে স্বস্তির হিমেল পরশ ছড়িয়ে দিয়েছে। এ গুরুত্বপূর্ণ ভাষণে তিনি নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট সময়সীমা ঘোষণা করেছেন। ঘোষণা করেছেন নির্বাচনের রোডম্যাপ। আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির মধ্যে পবিত্র রমজানের রোজার আগে নির্বাচন হবে সেটি আনুষ্ঠানিকভাবে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হলো। এ ঘোষণা পুরো জাতির জন্য ছিল প্রত্যাশিত, বহুলকাঙ্ক্ষিত। দেশে রাজনৈতিকসংকট ও অনিশ্চয়তার মধ্যে ১৩ জুন প্রধান উপদেষ্টা লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। ওই সাক্ষাৎকারের পর একটি যৌথ ঘোষণা দেওয়া হয়। সে ঘোষণায় ফেব্রুয়ারির মধ্যে সংস্কার এবং বিচারকাজের সুনির্দিষ্ট অগ্রগতির মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠানের অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু তারপর নানানরকম টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়। সংস্কারের নামে দেশে ঐকমত্য কমিশন একের পর এক জটিলতা সৃষ্টি করতে থাকে। বৈঠকের পর বৈঠক হতে থাকে। রাষ্ট্র সংস্কারের নামে নতুন নতুন বিষয় নিয়ে পুরো নির্বাচন অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়। অনেকেই ভাবছিলেন, শেষ পর্যন্ত নির্বাচন হয়তো হবে না। রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষুদ্র একটি অংশ এবং সুশীল সমাজের একটি অংশ দেশে নির্বাচন চাইছে না-এটা স্পষ্ট হতে থাকে। নির্বাচনের বদলে জগদ্দল পাথরের মতো একটি অনির্বাচিত সরকার যেন ক্ষমতায় টিকে থাকে সে রকম আকাঙ্ক্ষা স্পষ্ট হচ্ছিল অনেকের মধ্যে। কিন্তু এ সময় একদিকে যেমন ড. মুহাম্মদ ইউনূস ধৈর্য এবং বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন, অন্যদিকে রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি এবং দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং সংযমের পরিচয় দিয়েছেন। রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে যে অনভিপ্রেত বিতর্ক এবং বিভক্তি সৃষ্টির চেষ্টা হয়েছিল, সে ফাঁদে তাঁরা পা দেননি। বরং এ ক্ষেত্রে তারেক রহমানের নির্দেশনায় সংস্কার কমিটিতে গিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ রাজনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন। এ রাষ্ট্র সংস্কারের বৈঠকগুলোয় বিএনপি প্রমাণ করেছে বড় দল হিসেবে তারা তাদের অবস্থানে অনড় থাকে না। তারা গণতান্ত্রিক রীতিনীতি এবং চর্চায় বিশ্বাস করে। বিএনপি একের পর এক ছাড় দিয়েছে জাতীয় ঐক্যের স্বার্থে, গণতন্ত্রের স্বার্থে, নির্বাচনের স্বার্থে। এটাই হলো গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। একটি রাজনৈতিক দল যতই জনপ্রিয় এবং শক্তিশালী হোক না কেন, তারা ভিন্নমতের কথা শোনে এবং ভিন্নমতকে জায়গা করে দেয়। এ বৈঠকগুলোয় বিএনপি অনেক বিষয়ে ছাড় দিয়ে ঐক্য অটুট রেখেছে এবং নির্বাচনের পথ প্রশস্ত করেছে। তার পরও নির্বাচন শেষ পর্যন্ত হবে কি না তা নিয়ে অনেকের সংশয়, সন্দেহ ছিল। সেসব সংশয়, সন্দেহের কারণ ছিল দেশের বিদ্যমান নানান পরিস্থিতি। একের পর এক মবসন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, বৈষম্যবিরোধী কিছু ছাত্রনেতার বেপরোয়া ভয়ংকর রূপে আত্মপ্রকাশ দেশে উদ্বেগজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। এসব ঘটনা শেষ পর্যন্ত দেশ কোন দিকে নিয়ে যাবে তা নিয়ে জনমনে সৃষ্টি হয়েছিল হতাশা এবং আতঙ্ক। বিশেষ করে ৫ আগস্টের আগেই একজন ছাত্র উপদেষ্টা ফেসবুকে ‘আরেকটি এক-এগারোর পদধ্বনির’ কথা লিখে এ শঙ্কা আরও বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টা অত্যন্ত ধীরস্থিরভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি এসব বিভক্তি এবং নানান মতের মধ্যে জনগণের কণ্ঠস্বরটি গ্রহণ করেছেন, জনগণের আকাঙ্ক্ষা গ্রহণ করেছেন।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ধন্যবাদ দিতে চাই এ কারণে যে তিনি জনগণের অভিপ্রায়ের কথা শুনেছেন। জনগণের আকাঙ্ক্ষার কথা শুনেছেন, সেই আকাঙ্ক্ষার অনুরণন ঘটিয়েছেন তাঁর বক্তব্যে। এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয় ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত এক বছরে জনবিচ্ছিন্ন হননি, বরং জনগণের ভাবনা, দুঃখকষ্টগুলো প্রতি মুহূর্তে শুনছেন এবং সেই দুঃখকষ্ট লাঘবের চেষ্টা করছেন। গণতন্ত্রের যে অঙ্গীকার এক বছর আগে করেছেন, তা পূরণে তিনি অটল। মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা, এখন নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়েছে। নির্বাচনের জন্য আর ছয় মাস মাত্র হাতে আছে। ছয় মাস খুবই স্বল্প সময়। এ সময়ের মধ্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আপনাকে করতে হবে অত্যন্ত কঠোরভাবে। আমরা জানি আপনি একজন সফল মানুষ। আপনি একজন দায়িত্ববান মানুষ এবং আপনি একজন বিচক্ষণ ব্যক্তিত্ব। আপনি যে দায়িত্ব নেন সে দায়িত্ব সফলতার সঙ্গে সম্পন্ন করেন। অতীতে আপনার কোনো ব্যর্থতার রেকর্ড নেই। আর সে কারণেই আপনার ওপর দেশবাসীর আস্থা আছে। নির্বাচনের এ বৈতরণি আপনার নেতৃত্বেই পার হতে হবে। এ সময়টা হবে অত্যন্ত কঠিন, বন্ধুর এবং ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ। মনে রাখতে হবে, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো না, অর্থনৈতিক অবস্থা নাজুক। এ রকম একটি পরিস্থিতির মধ্যে অবাধ-সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। এজন্য এখন থেকে কঠোরভাবে আপনাকে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশে একটা অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচনের বড় প্রয়োজন প্রধান উপদেষ্টা তাঁর ভাষণেই বলেছেন। বহুদিন দেশের মানুষ ভোট দিতে পারে না। কাজেই মানুষের ভোটাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার এ অভিযাত্রা খুব সহজ নয়। যারা গণতন্ত্রবিরোধী শক্তি আছে, তারা এ নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ, বিতর্কিত এবং বানচাল করার জন্য নানা রকম চেষ্টা চালিয়ে যাবে, এটা বলাই বাহুল্য। সে চেষ্টা প্রতিরোধ করে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে অবাধ-সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করা এখন প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব। দেশবাসী বিশ্বাস করে, আস্থা রাখে যে ড. মুহাম্মদ ইউনূস সে দায়িত্ব সফলভাবে পালন করতে পারবেন। নির্বাচনের জন্য এখন দেশের সামনে পাঁচটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমত এ নির্বাচন নিয়ে যেন কোনো বিরোধ সৃষ্টি না হয়। এ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর বিএনপিসহ সিংহভাগ রাজনৈতিক দল একে স্বাগত জানিয়েছে। গত বছর জুলাই বিপ্লবে অংশগ্রহণকারী প্রায় সব শক্তি নির্বাচনের ঘোষণা স্বাগত জানিয়েছে। বৃহত্তর জনস্বার্থে তারা নির্বাচনের তারিখ মেনে নিয়েছে। এটিই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। গণতন্ত্রের সব সিদ্ধান্ত আপনার পক্ষে যাবে না। সব সিদ্ধান্ত আপনার পছন্দ হবে না। তার পরও যেটি সবার সিদ্ধান্ত সেটি মেনে নেওয়ার চর্চাই হলো গণতান্ত্রিক রীতি। এখন জনগণের ম্যান্ডেট নেওয়ার জন্য তারা জনগণের কাছে যাবে, জনগণের মতামত গ্রহণ করবে এবং জনগণের কাছে নিজেদের কর্মসূচি পেশ করবে। একটা প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনি লড়াইয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করবে। শেষ পর্যন্ত জনগণই ক্ষমতার উৎস।
দ্বিতীয়ত এ নির্বাচন পরিচালনার জন্য আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যে রকম থাকা দরকার, তা এখনো নেই বললেই চলে। দ্রুত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কঠোর এবং নির্মোহভাবে সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ এবং মব বাহিনী দমন করতে হবে। কোনো দল বা প্রভাবশালী ব্যক্তির ছত্রছায়ায় যেন মব বাহিনী কোনো প্রতিষ্ঠান দখল না করতে পারে, চাঁদাবাজি করতে না পারে, জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে না পারে সে ব্যাপারে এখন থেকেই অন্তর্বর্তী সরকারকে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রয়োজনে এখানে সশস্ত্র বাহিনীর নজরদারি বাড়াতে হবে।
সশস্ত্র বাহিনী প্রত্যাশা করেছিল ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হবে। সে প্রত্যাশিত সময়ের কাছাকাছি নির্বাচন দেওয়া হয়েছে। এ দেশের জনগণ সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি অত্যন্ত আস্থাশীল, শ্রদ্ধাশীল। জনগণ আশা করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিশেষ করে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সশস্ত্র বাহিনী পুলিশ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী অন্যান্য বাহিনীকে সহযোগিতা করে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করবে। এটি কোনো কঠিন কাজ নয়। আন্তরিকতা থাকলে পক্ষপাতহীনভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে এটি সহজেই সম্ভব।তৃতীয়ত এ নির্বাচন ঘিরে পতিত ফ্যাসিবাদ এবং স্বৈরাচার নানা রকম ষড়যন্ত্র করতে পারে। নানা রকম অপপ্রচার, গুজবের মাধ্যমে নির্বাচনব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। সেটি প্রতিরোধে অবশ্যই অন্তর্বর্তী সরকার কাজ করবে বলে দেশবাসী বিশ্বাস করে।
চতুর্থত এ নির্বাচন কেবল দেশের মানুষের জন্যই জরুরি নয়, আন্তর্জাতিক পরিম লের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সারা বিশ্বই নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে থাকবে। কাজেই কোনো বন্ধু দেশকে যেন ভুল বুঝিয়ে নির্বাচন সম্পর্কে বিভ্রান্ত না করা হয় সে ব্যাপারে অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই সচেতন থাকতে হবে। বৈশ্বিক কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়াতে হবে। শুধু সরকার নয়, রাজনৈতিক দলগুলোকে এ ব্যাপারে তৎপর হতে হবে। মনে রাখতে হবে, আন্তর্জাতিকভাবে এ নির্বাচন কোনোভাবেই যেন প্রশ্নবিদ্ধ না হয়।
পঞ্চমত এ নির্বাচনের আগে একটি স্বস্তির পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। এক বছর ফ্যাসিবাদবিরোধী অভিযানের নামে নিরীহ ব্যবসায়ী, শিল্পপতি এবং সাধারণ মানুষ নানানরকম হয়রানির শিকার হয়েছেন। ব্যবসাবাণিজ্য বন্ধ। অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান অচল হয়ে আছে। কোনো কোনো ব্যবসায়ীকে ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ তকমা দিয়ে অকারণে হয়রানি করা হচ্ছে। নির্বাচনের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির জন্য এসব হয়রানি এবং নিপীড়ন অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। সুনির্দিষ্টভাবে যারা হত্যার সঙ্গে জড়িত, যারা ব্যাংক লুটেরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হোক আপত্তি নেই। কিন্তু ঢালাওভাবে সবাইকে স্বৈরাচারের দোসর বলে হয়রানি করার প্রবণতা বন্ধ করতে হবে। নির্বাচন করতে হবে উৎসবমুখর পরিবেশে। এ রকম হয়রানি, দমনপীড়নে দেশে আতঙ্ক থাকবে এবং মানুষ ভোট দিতে পারবে না। দেশবাসী প্রত্যাশা করে আগামী ফেব্রুয়ারিতে দেশে গণতন্ত্রের উৎসব হবে। সে উৎসবে সব মানুষ নির্ভয়ে তাদের পছন্দের ব্যক্তিকে ভোট দেবেন। নির্বাচনে যে ফলাফলই হোক না কেন, অংশগ্রহণকারী সব রাজনৈতিক দল তা মেনে নেবে। পরাজিত দল বিজয়ী দলকে অভিনন্দন জানাবে। সবাই মিলেমিশে নতুন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় আমরা একসঙ্গে হাঁটব।
অদিতি করিম : নাট্যকার ও কলাম লেখক
Email : [email protected]