ফুলের কাঁটা একেই বলে!
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সগর্ব ঘোষণা ছিল, সিন্ডিকেট করলে আর তৃণমূল করা যাবে না। যারা সিন্ডিকেট চালাতে চান, তারা যেন তৃণমূলটা না করেন! বিরোধীদের লাগাতার কটাক্ষ ছিল, দলনেত্রীর এই ঘোষণা মানতে গেলে তৃণমূল দলটাই উজাড় হয়ে যাবে! বিধাননগর পুর-নিগমের নতুন মেয়রের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে সেই সিন্ডিকেটের কাঁটাই তৃণমূলকে বিঁধল মালা হয়ে!
বিধাননগর পুর-নিগমের প্রথম বোর্ডের পদাধিকারী ও কাউন্সিলরদের শপথের মঞ্চেই মেয়র সব্যসাচী দত্তকে মালা পরিয়ে দিলেন ‘সিন্ডিকেট-খ্যাত’ ভজাই সর্দার! শপথ দেখতে শুক্রবার সকাল থেকেই বিধাননগর পুরভবনের সামনে হাজার হাজার তৃণমূল কর্মীর থিকথিকে ভিড় জমছিল। রাজারহাট-নিউটাউন, সল্টলেকের দত্তাবাদ থেকে বাস, ম্যাটাডোর, মোটরবাইকে আসা কর্মীদের ভিড়ে অবশ্য তেমন চোখে পড়েনি সল্টলেকের অবাঙালি সমাজ এবং সাধারণ বাসিন্দাদের। শপথের শেষে মেয়র, ডেপুটি মেয়র, চেয়ারপার্সনকে মাল্যদান শুরু হতেই বিতর্কের সূত্রপাত। বিশৃঙ্খলার শুরুও তখনই। মালা পরানোর হুড়োহুড়ি, ঠেলাঠেলির মধ্যে হঠাৎ-ই মঞ্চে উঠে সদ্য শপথ নেওয়া মেয়র সব্যসাচীর গলায় মালা পরিয়ে দিয়ে এলেন ভজাই! সিন্ডিকেটের গোলমালে কিছু দিন আগেই পুলিশ যাকে গ্রেফতার করেছিল! যার ছেলে এ বারই তৃণমূলের টিকিটে বিধাননগর পুর-নিগমের কাউন্সিলর হয়েছেন।
ভজাইয়ের মাল্যদান-পর্ব দেখে উপস্থিত তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীদের চোখেমুখে স্পষ্টতই ছিল বিড়ম্বনার ছাপ। তৃণমূল নেত্রীর দেওয়া ঐক্যের বার্তা মেনে শপথ অনুষ্ঠানে ছিলেন শাসক দলের সব গোষ্ঠীর নেতা-মন্ত্রীরাই। ভজাই-পর্ব দেখে শপথ-মঞ্চে থাকা কৃষিমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু, সাংসদ দোলা সেন, বিধায়ক সুজিত বসু, পরিসংখ্যান মন্ত্রী রচপাল সিংহ, সাংসদ দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়, পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম, কারামন্ত্রী হায়দর আজিজ সফিরা প্রকাশ্যে কেউ কিছু বলেননি ঠিকই। কিন্তু উপস্থিত কর্মীরা বলেই ফেলেছেন, ‘‘ভোটের দিন এক বার মুখ পুড়েছে। এ বার ভজাইয়ের মঞ্চে ওঠা নিয়েও প্রশ্ন উঠবে!’’ অভিনন্দন নেওয়ার ভিড়ে স্বয়ং সব্যসাচীর মুখ অবশ্য ভাবলেশহীন ছিল। পরে তাঁর নির্বিকার জবাব, ‘‘অনেকে মালা দিয়েছেন। তার মধ্যে ভজাইও মালা দিয়েছে। তাতে অসুবিধা কী হয়েছে?’’
নতুন মেয়রকে ভজাইয়ের মালা পরানো নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও শপথের মঞ্চে কিন্তু ঐক্যের ছবিই তুলে ধরার চেষ্টা চালিয়েছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। কখনও মেয়র সব্যসাচী-চেয়ারপার্সন কৃষ্ণা চক্রবর্তী, কখনও বিধায়ক সুজিত বসু, সব্যসাচী এবং অন্যান্য কাউন্সিলর এক সঙ্গে ছবি তুলে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, ঐক্যবদ্ধ ভাবেই তাদের পুরবোর্ড চলবে। তবে এই ঐক্যের ছবিও সম্পূর্ণ হয়নি এ দিন! কারণ, খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বা বারাসতের সাংসদ কাকলি ঘোষ দস্তিদারের অনুপস্থিতি অস্বস্তি বাড়িয়েছে শাসক দলের। খাদ্যমন্ত্রী অবশ্য জানিয়েছেন, তার দফতরের অনুষ্ঠানে দিনভর ব্যস্ত থাকায় তিনি শপথে যেতে পারেননি। যদিও তাতে গুঞ্জন থামেনি।
ঐক্যের বার্তা দিতেই পুরমন্ত্রী ফিরহাদ বলেছেন, ‘‘কেউ একা উন্নয়ন করতে পারবে না। স্বপ্ন সফল করতে পথে নেমেছে টিম মমতা।’’ শপথের পরে বক্তৃতায় সব্যসাচীর ঘোষণা, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী আমাকে দায়িত্ব দিয়েছেন। বিধাননগর নিয়ে তার স্বপ্ন সকলে মিলে পূরণ করবই।’’ শপথ শেষ হতে না হতেই বিধায়ক, ডেপুটি মেয়র কিংবা চেয়ারপার্সনেরা নিজেদের অনুগামীদের নিয়ে পুরভবন ছেড়ে চলে যান। তার পরে একাই সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন নতুন মেয়র। ভোটের দিন সল্টলেকে সাংবাদিক নিগ্রহের ঘটনার জন্য দুঃখপ্রকাশ করে সব্যসাচী দাবি করেন, যারা ওই নিগ্রহের ঘটনা ঘটিয়েছে, তারা কেউ দলের সঙ্গে যুক্ত নয়। ভোটের দিন সাংবাদিক নিগ্রহের ঘটনায় তিন বিধায়ক সুজিত, পরেশ পাল ও অর্জুন সিংহ ও তাদের অনুগামীদের ভূমিকা নিয়ে ইতিমধ্যে তৃণমূল ভিতরে-বাইরে সমালোচনার মুখে পড়েছে। এমনকী, ভোটের দিন বিধাননগরে গা-জোয়ারির বাড়াবাড়িতে মুখ্যমন্ত্রী খুব সন্তুষ্ট নন, এমন বার্তা পেয়েই
জ্যোতিপ্রিয়বাবুর মতো কেউ কেউ শপথ অনুষ্ঠান এড়িয়ে গিয়েছেন বলে জল্পনা চলছে। মেয়রের মন্তব্য সে সব জল্পনাতেই ইন্ধন জোগাবে বলেই মনে করছেন স্থানীয় তৃণমূল কর্মীদের একাংশ।
সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা
বিডি-প্রতিদিন/ ১৭ অক্টোবর, ২০১৫/ রশিদা