'ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে পশ্চিমবঙ্গে আরও একজনের মৃত্যু'- গত কয়েক দিন ধরে রাজ্যের সব পত্রিকায় এই হেডলাইনটি সকলের নজর কাড়ছে। চায়ের দোকান কিংবা ট্রেন, ট্রাম, বাস- সর্বত্র এই নিয়ে চর্চাও চলছে। এক কথায় মানুষের ঘুম কেড়ে নিয়েছে মশাবাহিত এই রোগ।
কখনও উত্তর ২৪ পরগনা জেলা, কখনও হুগলী, হাওড়া, কখনও আবার কলকাতা শহর- ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে একের পর এক মৃত্যুর ঘটনায় আতঙ্কে পশ্চিমবঙ্গবাসী, উদ্বিগ্ন প্রশাসন।
গত দুই বছর ধরে করোনা ভাইরাসের ছোবলে মানুষের মৃত্যুর মিছিল দেখতে দেখতে কিছুটা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল সাধারণ মানুষ। যদিও বর্তমানে সেই সংক্রমণ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু তার জায়গা নিয়েছে ডেঙ্গু। মশা বাহিত এই রোগে যেভাবে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে, তাতে যথেষ্ট উদ্বেগ বাড়িয়েছে। রাজ্য জুড়ে সতর্কতামূলক প্রচার, প্রাশাসনিক স্তরে দফায় দফায় বৈঠক করেও কোনও লাভ হচ্ছে না।
বলা যেতে পারে ডেঙ্গুতে কার্যত গোটা রাজ্যেই মৃত্যুর মিছিল চলছে। প্রতিবছর বর্ষা শেষে ডেঙ্গু ম্যালেরিয়াসহ বিভিন্ন পতঙ্গবাহি রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পায়। এবারেও তার কোনো ব্যতিক্রম হয়নি। বর্ষার শেষে কলকাতা শহর এবং সংলগ্ন জেলাগুলিতে প্রতিদিন বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। স্বাভাবিকভাবেই কপালে চিন্তার ভাঁজ প্রশাসনের। শুধু কলকাতা নয়, একাধিক জেলাতেও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। তবে চলতি বছরে ডেঙ্গুর এই বাড়বাড়ন্তের পেছনে আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনাকেই দায়ী করেছেন চিকিৎসকদের একাংশ। আরেকটি অংশের অভিমত করোনার জেরে মানুষের শরীরে যে প্রভাব পড়েছে, তার জেরে মৃত্যুর প্রবণতা বাড়ছে ডেঙ্গুতে।
চলতি বছরে কলকাতাতেও একাধিক নতুন নতুন জায়গা থেকে ডেঙ্গু আক্রান্তের খবর পাওয়া যাচ্ছে। যার মধ্যে রয়েছে কসবা, যাদবপুর, মুকুন্দপুর, যোধপুর পার্ক, নেতাজি নগর, চিৎপুর, কাশিপুর, দমদম, বেলেঘাটা, পাইকপাড়ার মত ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা।
সম্প্রতি বেলেঘাটা ইনফেকশাস ডিজিস (আইডি) হাসপাতালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে ওই হাসপাতালের অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপার অনির্বাণ হাজরার। ৪০ বছর বয়সী ঐ তরুণ চিকিৎসকের মৃত্যুতে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনের অসহায়তার ছবিটাই ফুটে উঠে।
ডেঙ্গু বাসা বেধেছে রাজ্যটির ক্ষমতাসীন দল তৃণমূল কংগ্রেসের অন্দরেও। দলের সংসদ সদস্য অপরূপা পোদ্দারের স্বামী ও সন্তান উভয়ই ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি।
এমনকি বিদেশ থেকে কলকাতায় চিকিৎসা করতে আসা এক রোগীরও মৃত্যু হয়েছে ডেঙ্গুতে। গত সপ্তাহেই কলকাতার বেসরকারি হাসপাতালে (AMRI) চিকিৎসারত অবস্থায় মৃত্যু হয় ৫৮ বছর বয়সী শিপ্রা দাস নামে এক বাংলাদেশী নারীর।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে সরকারের ভূমিকা নিয়ে ইতিমধ্যে কলকাতা শহরে বিক্ষোভ, প্রতিবাদী মিছিলে শামিল হয়েছে বিরোধীরা। চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগ তুলে সরকারি হাসপাতাল বা নার্সিংহোমগুলোতেও বিক্ষোভ দেখানো দেখাচ্ছে রোগীর আত্মীয়, পরিজনরা।
এমন অবস্থায় কেন্দ্র সরকারকে চিঠি লিখেছেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে কেন্দ্রের হস্তক্ষেপের আবেদন জানিয়ে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী মনসুখ মান্ডব্য-কে চিঠি লিখে শুভেন্দু বলেন, "পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অদক্ষতার কারণে ডেঙ্গু পরিস্থিতি রাজ্যের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। রাজ্যের মানুষকে স্বস্তি দিতে ও রাজ্যের সরকারি কর্মকর্তাদের সহায়তা করতে আপনি এরাজ্যে চিকিৎসকদের কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিদল ও জনসাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পাঠান।"
ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর প্রকৃত সংখ্যার সঠিক তথ্য লুকাচ্ছে বলেও কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর কাছে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়েছেন শুভেন্দু।
সরকারিভাবে ডেঙ্গু আক্রান্ত কিংবা মৃত্যুর এখনো কোনো হিসাব পাওয়া না গেলেও বিভিন্ন সূত্র মারফত জানা যাচ্ছে গোটা রাজ্যে এখনো পর্যন্ত প্রায় ৫ হাজারের বেশি মানুষ সংক্রমিত হয়েছেন ডেঙ্গুতে। এর বেশিরভাগটাই উত্তর ২৪ পরগনা। রাজ্যের যে সমস্ত জেলায় ডেঙ্গুর পরিস্থিতি মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে তার মধ্যে অন্যতম এই জেলা। যেসব জায়গায় ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি সেই সব এলাকার মানুষদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে সংশ্লিষ্ট জেলা স্বাস্থ্য দপ্তর থেকে।
এদিকে কলকাতার হাসপাতালগুলোতে প্রতিদিনই বাড়ছে রোগীর সংখ্যা। জ্বর ছাড়া শরীরে ডেঙ্গুর অন্য কোন লক্ষণ না থাকলেও অনেকেই হাসপাতালে ভর্তি হয়ে যাচ্ছেন। এর পিছনে রয়েছে দুটি কারণ- একটি আতঙ্ক, অন্যটি চিকিৎসকারাও বাড়িতে রেখে চিকিৎসা করার ভরসা দিতে পারছেন না।
চিকিৎসক কিংবা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অভিমত এমন অনেক রোগী আসছেন, যাদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার কোন প্রয়োজনই নেই।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই রোগের পর্যাপ্ত পরিমাণ তথ্য, আক্রান্ত, মৃত্যু কিংবা সুস্থ হয়ে ওঠার সঠিক পরিসংখ্যান না থাকায় সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বাড়ছে।
বিডি প্রতিদিন/হিমেল