একদিকে প্রাচ্য, অন্যদিকে পাশ্চাত্য। একদিকে বাঁশির করুণ সুর অন্যদিকে লিড আর বেইজ গিটারের উন্মাদনা। ছিল বেহালা, তবলা, সেতার ও সরোদের হৃদয় হরণ করা পরিবেশনা। সেই সঙ্গে রাগ, তাল, লয় আর খেয়ালের মুগ্ধতার মায়াজাল। আবাহনী মাঠজুড়ে সৃষ্টি হয় শাস্ত্রীয় সুরের মুগ্ধতা। দেশের সীমারেখা নির্ধারণের জন্য সীমারেখা থাকলেও সংগীতের কোনো সীমারেখা নেই সেটিই প্রমাণ হলো বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সংগীত উৎসবের ষষ্ঠ আসরের প্রথম রাতে। গতকাল সন্ধ্যায় শুরু হয় বেঙ্গল ফাউন্ডেশন আয়োজিত ‘বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সংগীত উৎসব’-এর এবারের আসর।
ড. এল সুব্রামানিয়াম এবং আসতানা সিম্ফনি ফিলহারমোনিক দলের অর্ধশতাধিক শিল্পীদের অর্কেস্ট্রাই ছিল প্রথম রাতের মূল আকর্ষণ। আর এই আকর্ষণের পরিবেশনার মধ্য দিয়ে শুরু হয় প্রথম রাতের আসর। চেলো, ভায়োলিন ও বাঁশিতে কাজাখস্তানের আসতানা সিম্ফনি ফিলহারমোনিক অর্কেস্ট্রার এই দলের সঙ্গে বেহালায় ছিলেন ভারতের প্রবাদপ্রতিম শিল্পী ড. এল সুব্রামানিয়াম। কাজাখস্তানের শিল্পীরা ওয়েস্টার্ন ক্ল্যাসিকাল এবং ড. এল সুব্রামানিয়াম বেহালায় প্রাচ্যের শাস্ত্রীয় সংগীতের অপূর্ব মেলবন্ধনে ‘শান্তি প্রিয়া’ নামের এই কম্পোজিশনের মাধ্যমে আবাহনী মাঠকে সুরের সাগরে পরিণত করেন। এরপর মঞ্চে আসেন ভারতীয় শিল্পী রাজরূপা চৌধুরী। রাগ অনিল মধ্যম-এ তিনি সরোদের সুরের মূর্ছনায় পুরো মাঠের শোতাদের বিমোহিত করে তোলেন। এই শিল্পীর সঙ্গে তবলায় ছিলেন পণ্ডিত অভিজিৎ ব্যানার্জি। এরপর গোয়ালিয়র, কিরানা এবং জয়পুর ঘরানায় খেয়াল পরিবেশন করেন ভারতের শিল্পী পদ্মা তালওয়ালকর। সেতারে সুরের খেলায় মায়াজাল সৃষ্টি করেন বাংলাদেশের শিল্পী ফিরোজ খান। এরপর ছিল বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়ের শিক্ষানবিস সুপ্রিয়া দাসের পরিবেশনা। ছিল ভারতীয় বংশীবাদক রাকেশ চৌরাশিয়া ও সেতারবাদক পূর্বায়ণ চট্টোপাধ্যায়ের পরিবেশনা। এর আগে সন্ধ্যায় বেহালায় আভোগী রাগে ভারতের সংগীতজ্ঞ ড. এল সুব্রামানিয়ামের সুর তোলার মধ্য দিয়ে এবারের উৎসবের সূচনা হয়। সূচনা পর্বে এই শিল্পীর সঙ্গে মৃদঙ্গমে সঙ্গত করেন রামামূর্তি ধুলিপালা, তবলায় পণ্ডিত তন্ময় বোস এবং মোরসিংয়ে ছিলেন সত্য সাই ঘণ্টাশালা। উদ্বোধনী এই পরিবেশনা শেষে অর্কেস্ট্রা নিয়ে মঞ্চে আসেন আস্তানা সিম্ফনি ফিলহারমোনিক। দলটি প্রথমে সিলেস কাজগালিব রচিত সিম্ফনির কিছু অংশ এবং পি আই চাইকভস্কির বিখ্যাত রচনা ‘সোয়ানলেক’-এর কিয়দংশ পরিবেশন করেন। প্রধান অতিথি হিসেবে গতকাল প্রথম রাতের আসরের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এতে বিশেষ অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, আবাহনী লিমিটেডের সভাপতি সালমান এফ রহমান, বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা, স্কয়ার গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অঞ্জন চৌধুরী ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী সেলিম আর এফ হোসেন। স্বাগত বক্তব্য রাখেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের। ‘সংগীত জাগায় প্রাণ’ প্রতিপাদ্যে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন আয়োজিত উৎসব এবার উৎসর্গ করা হয়েছে শিক্ষাবিদ ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামানকে। এবারের উৎসবের নিবেদক স্কয়ার গ্রুপ এবং সমর্থন করছে ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেড। আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, এ উৎসবের প্রতিটিতেই উপস্থিত থেকেছি, এটা আমার সৌভাগ্য। এ উৎসবে আমরা পাঁচ দিন নৃত্যগীতের মধ্যে অবগাহন করব। আমরা সবার আগে মানুষ হতে চাই, নিজেদের রুচিকে উন্নত করতে চাই। এ উৎসব সে পথেই প্রেরণা জোগাবে।
আসাদুজ্জামান নূর বলেন, সংগীত পরিশুদ্ধ করে আমাদের, আমাদের চিত্তকে উদার করে, আমাদের মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সাহায্য করে। সংগীত আমাদের মুক্তচিন্তা অধিকারী করে অসাম্প্রদায়িক হওয়ার প্রেরণা জোগায়। এ উৎসবের মধ্য দিয়ে সে মূল্যবোধ, চেতনাকে ধারণ করতে চাই। সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সংগীত আমাদের শক্তি জোগাবে। উৎসবটি আমাদের মধ্যে সেই চেতনার বিকাশ ঘটায়।হর্ষবর্ধন শ্রিংলা বলেন, শুধু বাংলাদেশে নয়, এটি এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় উচ্চাঙ্গ সংগীত উৎসব। বিশ্বের অন্যতম ধ্রুপদী উৎসবটি বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে শিল্পীদের টেনে এনেছে।
উৎসবের উদ্বোধনী মঞ্চে আবুল খায়ের ঘোষণা দেন, আগামী বছর এ উৎসব উৎসর্গ করা হবে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, ২০১৯ সালে ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ এবং ২০২০ সালে ছায়ানট সভাপতি সন্্জীদা খাতুনকে।
আজ দ্বিতীয় রাতের আসরে কত্থক নৃত্য পরিবেশন করবেন অদিতি মঙ্গলদাস ড্যান্স কোম্পানির শিল্পীরা। সমবেতভাবে তবলা বাদনে অংশ নেবেন বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। এরপর সন্তুর বাজিয়ে শোনাবেন পণ্ডিত শিবকুমার শর্মা, খেয়াল পরিবেশন করবেন পণ্ডিত উল্লাস কশলকর, সেতারে সুর তুলবেন ওস্তাদ শাহিদ পারভেজ খান এবং ধ্রুপদী পরিবেশন করবেন বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়ের শিক্ষার্থী অভিজিত কুণ্ডু। দ্বিতীয় রাতের পরিবেশনা শেষ হবে পণ্ডিত রনু মজুমদার বাঁশি এবং পণ্ডিত দেবজ্যোতি বোসের সরোদে যুগলবন্দী বাদনে।