কয়েক মাস আগের ঘটনা। উত্তর বাড্ডার একটি ঘরে ভাড়া থাকেন এক দম্পতি। একদিন সকালে ঘরের সামনের বারান্দা থেকে উধাও তাদের ১০ মাস বয়সী শিশু সন্তান জান্নাত। এদিক সেদিক খোঁজাখুঁজির পর থানা পুলিশ করা হলো। কিন্তু জান্নাতকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ১০ দিন পর সেই দম্পতিকে থানা থেকে জানানো হলো একটি শিশুর খোঁজ পাওয়া গেছে বনানীর কড়াইল বস্তিতে। তারা পুলিশসহ ছুটে চলল সেখানে। হ্যাঁ, খুঁজে পাওয়া গেছে তাদের জান্নাতকে। গ্রেফতার করা হয়েছে শিশু অপহরণকারীকে।
পুলিশ এ ঘটনাটি তদন্ত করে জানতে পারে চাঞ্চল্যকর তথ্য। পুলিশ জানতে পারে, জান্নাতকে বিকলাঙ্গ করে ভিক্ষাবৃত্তিতে ব্যবহার করতেই চুরি করা হয়েছিল। আর এই চুরিতে ব্যবহার করা হয়েছিল ১২ বছরের আরেক শিশু স্বপ্নাকে। পুলিশের হেফাজতে থাকা শিশু স্বপ্না জানিয়েছে, এর পেছনে বড় একটি চক্র আছে যারা শুধু প্রতারণা ও ভিক্ষাবৃত্তি ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের আখড়া রাজধানীর কড়াইল বস্তি। ঢাকা মহানগর পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, আমরা বাচ্চা চুরির সংঘবদ্ধ চক্রটিকে খুঁজে বের করতে তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছি। বাড্ডা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জানান, ‘ঘটনাটি জানার পরই পুলিশ তদন্ত শুরু করে। বাচ্চাটিকে কড়াইল বস্তি থেকে উদ্ধার করা হয়। যারা অসদুদ্দেশ্যে বাচ্চাটি নিয়ে গিয়েছিল তাদের কয়েকজনকে শনাক্ত করা হয়েছে।
জান্নাত উদ্ধার হলেও উদ্ধার হয় না অসংখ্য শিশু। যাদের বিকলাঙ্গ করে ভিক্ষাবৃত্তিতে ব্যবহার করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা জানায়, ভিক্ষাবৃত্তি ওপাচারের উদ্দেশ্যে শিশু চুরির সঙ্গে জড়িত রাজধানীর বিভিন্ন বস্তির কিছু নারী। তারা বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল থেকে শিশু চুরি করে। বাড্ডার ঘটনায় একজনকে পুলিশ গ্রেফতার করলেও এখনো গোয়েন্দাদের তালিকায় রয়েছে অনেকে। দ্রুতই তাদের গ্রেফতার করা হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। একটি সূত্র জানিয়েছে, ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট দিয়ে শিশুদের পাচার করা হয় বলে গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য রয়েছে। ২০১৬ সালের ৯ ডিসেম্বর শিশু পাচারকারী চক্রের সদস্য জান্নাতুল ফেরদৌস ফাতেমা ওরফে রুমা নামে এক নারীকে আটক করে রাজধানীর বিমানবন্দর থানার পুলিশ। এ অভিযানে নেতৃত্ব দেন সেখানকার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. এজাজ শফী। পুলিশ জানায়, রুমার গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলার গাজীবাড়ী। তিনি চানতারা নামে আট বছরের এক শিশুকে সিএনজিতে করে পাচার করছিলেন। বিমানবন্দর এলাকায় সিএনজিতে থাকাবস্থায় শিশুটি স্বাভাবিক হলে বিষয়টি বুঝতে পেরে চিৎকার করে। এ সময় আশপাশের লোকজন এবং পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে শিশুটিকে উদ্ধার করে এবং ওই নারীকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যায়। পরে তার বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে আদালতে পাঠানো হয়।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল সূত্র জানায়, ২০১৭ সালে হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগ থেকে খাদিজা নামের তিন মাসের এক শিশু চুরি করে নিয়ে যান অজ্ঞাত এক নারী। ওইদিনই পুলিশের কাছে হাসপাতালের আশপাশের সিসিটিভির ফুটেজ হস্তান্তর করা হয়। একই সঙ্গে ওইদিন রাতে শাহবাগ থানায় একটি মানব পাচার মামলা করা হয়। শিশুটিকে উদ্ধার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। শিশুটির বাবা বাহাদুর আলী জানান, এখন পর্যন্ত তার মেয়ের কোনো খোঁজ পাননি তারা। এর আগেও একই হাসপাতালের বার্ন ইউনিট থেকে আয়শা নামে ১৫ মাস বয়সী এক শিশু চুরির সময় পলি আক্তার নামে এক নারীকে আটক করেন দায়িত্বরত আনসার সদস্যরা। পরে পলি আক্তারের বিরুদ্ধে শিশু চুরির অভিযোগ এনে একটি মামলাও হয়। রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর থেকে অপহরণের শিকার হয় শিশু সুমাইয়া। ওই ঘটনার পরই থানায় মামলা হয়। পরে পাশের বাড়ির ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরায় ধারণ করা দৃশ্যে দেখা যায় বোরকাপরা এক নারী সুমাইয়াকে নিয়ে যাচ্ছেন। সাবিনা ইসলাম বৃষ্টি নামের ওই নারী আগে সুমাইয়াদের পাশের বাসায় ভাড়া থাকতেন। সন্দেহভাজন অপহরণকারী হিসেবে তার নাম ও মোবাইল ফোন নম্বর র্যাব-পুলিশকে দিয়েছিলেন সুমাইয়ার বাবা জাকির হোসেন। ২৭ এপ্রিল রাজধানীর জুরাইনের একটি বাসা থেকে সুমাইয়াকে উদ্ধার করা হয়। এর আগে রাজধানীর কাফরুলে রবিউল নামে শিশুর দুটি হাত কেটে বস্তিতে ফেলে রাখা হয়। এরপর ওই শিশুকে উদ্ধারের পর বিদেশে নিয়ে চিকিৎসা করিয়ে সংযোজন করা হয় দুটি কৃত্রিম হাত। এ ঘটনায় রাজধানীর কাফরুল থানায় একটি জিডি করেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নারী কর্মকর্তা রুকসানা কামার। শিশু রবিউল পরিবারের সঙ্গে গুলশানের কড়াইল বস্তিতে থাকত। ২০১৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি সে নিখোঁজ হয়। এর কয়েক দিন পর দুই হাত কাটা অবস্থায় কে বা কারা তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে পালিয়ে যায়। তখন রবিউলের মা নাসিমা বেগম অভিযোগ করেছিলেন, রবিউলের সৎ বাবা মো. জাহাঙ্গীর এ ঘটনা ঘটিয়েছেন। তখন পুলিশেরও ধারণা ছিল, ভিক্ষাবৃত্তি করানোর উদ্দেশ্যে বা ব্যক্তিগত ক্ষোভ থেকে জাহাঙ্গীর এমন নির্মম ঘটনা ঘটিয়েছেন। এ ঘটনায় বনানী থানায় মামলা হয়। পরে পুলিশ জাহাঙ্গীরসহ দুজনকে গ্রেফতার করে।
শিশু রবিউলকে দেশে কিছুদিন চিকিৎসার পর বেশ কয়েকজনের সহায়তায় কর্মকর্তা রুকসানা রবিউলকে যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ার এক হাসপাতালে ভর্তি করেন। সেখানে রবিউলের শরীরে কৃত্রিম দুটি হাত সংযোজন করা হয়। দেশে ফিরে ফরিদপুরে একটি স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে রবিউলকে ভর্তি করা হয়। এ ঘটনায় রবিউলের সৎ বাবা জাহাঙ্গীরসহ দুজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেন বনানী থানার তৎকালীন উপপরিদর্শক (এসআই) আমিনুল বাশার। রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর এলাকায় আট-নয় বছরের এক শিশুকে অ্যালুমিনিয়ামের পাতিলে আটকে রাখার চাঞ্চল্যকর খবর প্রকাশের পর সারা দেশে হৈচৈ পড়ে যায়। আর এসব কঙ্কালসার শিশুকে দিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি করানো হয়। এমন কঙ্কালসার শিশু দেখে হৃদয়বান মানুষ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। কিন্তু রাস্তার লোকজন জানেন না, সে অর্থ চলে যাচ্ছে সন্ত্রাসী চক্রের হাতে। কামরাঙ্গীরচরের ঘটনায় র্যাব অভিযান চালিয়ে এ চক্রের সদস্য শরিফুল ইসলাম ওরফে কোরবানকে গ্রেফতার করে। ভয়ঙ্কর এ সন্ত্রাসী চক্রের আস্তানাটি গড়ে উঠেছে রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরের আশ্রাফাবাদে। তবে কামরাঙ্গীরচরের ওই চক্রের মূল হোতা ছিল ওমর ফারুক নামের এক সন্ত্রাসী। র্যাবের অভিযানে গ্রেফতার হওয়া কোরবান স্বীকার করেন যে, চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে এ ধরনের কাজ করেছে। গত ২০০৪ সালে শরীফ নামের এক বালককে তারা কামরাঙ্গীরচরের বেড়িবাঁধে নিয়ে হাতের কব্জি কেটে পঙ্গু করে। এরপর তাকে দিয়ে ভিক্ষা করানো হয়। পরে ২০০৬ সালে রাহাত নামের আরেক শিশুকে তারা পায়ের রগ কেটে দেয়। রাহাতের বাড়ি যশোরে। আর ২০০৮ সালে অজ্ঞাতনামা একটি শিশুকে তারা ছয় মাস একটি পাতিলের মধ্যে আটকে রাখে। পরে তাকে বিকলাঙ্গ করে ভিক্ষায় ভাড়া দেওয়া হয়।