রবিবার, ২৩ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

প্রশ্ন ফাঁসে সরকারি কর্মকর্তা উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান

চক্রের সাতজন ও তিন শিক্ষার্থী গ্রেফতার

নিজস্ব প্রতিবেদক

সরকারি বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস ও প্রশ্নের উত্তর শিক্ষার্থীদের কাছে সরবরাহ করে আসছিল একটি চক্র। সর্বশেষ শুক্রবার অনুষ্ঠিত প্রতিরক্ষা মহা হিসাব নিরীক্ষকের কার্যালয়ে অডিটর নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করেন চক্রের সদস্যরা। পরীক্ষার্থী সেজে পরীক্ষা শুরুর কয়েক মিনিটের মধ্যে প্রশ্ন ফাঁস করেন। পরে সেগুলোর উত্তর সরবরাহ করার মাধ্যমে মোটা অঙ্কের টাকা শিক্ষার্থীদের থেকে হাতিয়ে নেন। মহা হিসাব নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের (সিজিএ) বরখাস্ত কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান আজাদ ও বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মাহবুবা নাসরীন রূপার যোগসাজশে চক্রটি দীর্ঘদিন ধরেই বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করে আসছিল। চক্রটির কয়েকজন সদস্য আগেও বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করে গ্রেফতার হয়েছিলেন।

মাহমুদুল হাসান আজাদ ও মাহবুবা নাসরীন রূপাসহ এ চক্রের সাত সদস্য ও তিন শিক্ষার্থীকে গ্রেফতারের পর এসব তথ্য জানিয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। গ্রেফতার অন্যরা হলেন নোমান সিদ্দিকী, আল আমিন রনি, নাহিদ হাসান, শহীদ উল্লাহ, তানজির আহমেদ, রাজু আহমেদ, হাসিবুল হাসান ও রাকিবুল হাসান। শুক্রবার রাজধানীর মিরপুর, কাকরাইল ও তেজগাঁও  শিল্পাঞ্চল এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়। তাদের থেকে ৬টি ইয়ার ডিভাইস, ৬টি মাস্টার কার্ড মোবাইল সিম হোল্ডার, ৫টি ব্যাংকের চেক, ৭টি নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প, ১০টি স্মার্টফোন, ৬টি ফিচার মোবাইল, ১৮টি প্রবেশপত্র ও চলমান পরীক্ষার ফাঁস হওয়া ৩টি প্রশ্নপত্র সেট জব্দ করা হয়েছে।

গতকাল ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, শুক্রবার বেলা ৩টা থেকে বিকাল সোয়া ৪টা পর্যন্ত প্রতিরক্ষা মহা হিসাব নিরীক্ষকের কার্যালয়ের অধীনে ৫৫০টি অডিটর পদে নিয়োগের জন্য ৭০ নম্বরের এমসিকিউ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এনএসআই ও ডিবি গুলশান বিভাগ গোয়েন্দা তৎপরতার মাধ্যমে জানতে পারে, একটি চক্র এ নিয়োগ পরীক্ষা কেন্দ্র করে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া ও জালিয়াতির মাধ্যমে প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত। পরে ধারাবাহিক অভিযানে এ চক্রের ১০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। প্রথমে কাকরাইলে অবস্থিত নিউ শাহিন হোটেল থেকে অসাধু উপায় অবলম্বনকারী দুই পরীক্ষার্থীকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের দেওয়া তথ্যমতে কাফরুলের সেনপাড়া পর্বতার একটি অ্যাপার্টমেন্ট থেকে ডিভাইস, প্রশ্নপত্র, উত্তরপত্রের খসড়াসহ চারজনকে গ্রেফতার করা হয়। ডিবি পুলিশের অন্য দল বিজি প্রেস উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে অভিযান চালিয়ে পরীক্ষার্থী এবং অন্যতম পরিকল্পনাকারী মাহবুবা নাসরীন রূপাকে টাকা, ডিজিটাল ডিভাইসসহ গ্রেফতার করে। তার দেওয়া তথ্যমতে অন্য আসামিদের গ্রেফতার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, চক্রের একটি গ্রুপ পরীক্ষার আগে থেকে পরীক্ষার্থী সংগ্রহ ও অর্থ হাতিয়ে নেয়। নগদ, রকেট, বিকাশসহ মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস ও চাকরি পাইয়ে দিতে অর্থ লেনদেন হয়। টার্গেটকৃত পরীক্ষার্থীপ্রতি ১৪ থেকে ১৬ লাখ টাকার লিখিত চুক্তি হয়। যেহেতু এমসিকিউ পরীক্ষা তাই এমসিকিউ পরীক্ষায় পাস করার পরই ভাইভা। তাই এমসিকিউ পরীক্ষার আগে কিছু টাকা নিয়ে নেন চক্রের সদস্যরা। নিয়োগ পাওয়ার পর বাকি টাকা দেওয়ার চুক্তি হয়। চক্রের আরেকটি গ্রুপ ইলেকট্রনিক ডিভাইস, ইয়ার ডিভাইস, মাস্টার কার্ড মোবাইল সিম হোল্ডার ও বাটন মোবাইল টার্গেটকৃত পরীক্ষার্থীদের সরবরাহ করে। পরীক্ষা শুরুর ২-৩ মিনিটের মধ্যেই প্রশ্ন ফাঁস করে বাইরে পাঠানো হয় ডিভাইসের মাধ্যমে। বাইরে থেকে প্রশ্নের সমাধান করে ডিভাইসের মাধ্যমে ফের পাঠানো হয় পরীক্ষার্থীদের কাছে। ডিবি কর্মকর্তা হাফিজ আক্তার আরও বলেন, গ্রেফতার ব্যক্তিদের মধ্যে প্রতিরক্ষা মহা হিসাব নিরীক্ষকের কার্যালয়ের অডিটর মাহমুদুল হাসান আজাদ প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় ২০১৯ সালে বরখাস্ত হন। নাহিদ হাসান ও আল আমিন সিদ্দিকী প্রশ্ন ফাঁস বিষয়ে ২০১৩, ২০১৬ ও ২০১৯ সালে গ্রেফতার হয়েছিলেন। গ্রেফতার আসামিরা অন্য আসামিদের যোগসাজশে বিভিন্ন সোশ্যাল অ্যাপস, ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করে কেন্দ্র থেকে প্রশ্ন ফাঁস করে দেওয়া, বাইরের রুমে ওয়ানস্টপ সমাধান কেন্দ্র বসিয়ে স্মার্টওয়াচ, এয়ার ডিভাইস, মোবাইল এসএমএসের মাধ্যমে উত্তর সরবরাহের কাজ করেছেন। এর আগেও তারা বিভিন্ন ব্যাংক, অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন অধিদফতর, পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতর, কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ, সিটি করপোরেশন, বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন, হিসাব নিরীক্ষক কার্যালয়, জ্বালানি অধিদফতর, সমবায় অধিদফতর, খাদ্য অধিদফতর, সাধারণ বীমা করপোরেশনসহ অন্যান্য সংস্থার প্রশ্ন ফাঁস এবং উত্তরপত্র সরবরাহ করে বিপুল পরিমাণ টাকা বিভিন্ন ব্যাংক ও বিকাশের মাধ্যমে এবং নগদে হাতিয়ে নিয়েছেন। উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মাহবুবা নাসরীন রূপার ভূমিকা সম্পর্কে ডিবিপ্রধান হাফিজ বলেন, তার ভূমিকা ছিল মধ্যস্থতাকারীর। একটি গ্রুপ অর্থ সংগ্রহ করেছে। আরেকটি গ্রুপ ডিভাইস সরবরাহ করেছে। রূপা নিজে পরীক্ষা দিয়েছেন, সঙ্গে অন্য পরীক্ষার্থীদের কাছে ডিভাইস সরবরাহের কাজ করেছেন। গ্রেফতার ব্যক্তিদের মধ্যে শিক্ষার্থী তিনজন আর চক্রের সদস্য সাতজন। ১৮ জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে তাদের চুক্তি হয়েছিল। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত তদন্তে নয়জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ফাঁসকৃত প্রশ্নপত্রের উত্তর সরবরাহের তথ্য মিলেছে। এ চক্রের সঙ্গে আরও যারা জড়িত তাদের ধরতে অভিযান চলছে। পরীক্ষা বাতিল হবে কি না জানতে চাইলে এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, কোনো সংস্থাই চায় না পরীক্ষা বিতর্কিত হোক। পরীক্ষা বাতিল হবে কি না তা সংশ্লিষ্ট দফতরই সিদ্ধান্ত নেবে। এর আগে বিভিন্ন পরীক্ষায় জালিয়াতি করে জড়িতদের কয়েকজন বরখাস্ত হয়ে জেলও খেটেছেন।

সর্বশেষ খবর