ফের কাড়াকাড়ি শুরু হয়েছে জুলাই গণ অভ্যুত্থানে অবদানের কৃতিত্ব নিয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন ঘিরে চলছে কাদা ছোড়াছুড়ি। আগামী ৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে এ নির্বাচন। ডাকসু নির্বাচনি প্রচারণায় এগিয়ে থাকার কৌশল হিসেবে জুলাই গণ অভ্যুত্থানের কৃতিত্ব নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে।
সম্প্রতি ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় নেতা সাদিক কায়েমের এক বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, ‘শিবির নেতা সাদিক কায়েম সম্প্রতি একটা টকশোতে বলেছেন, ছাত্রশক্তির গঠনপ্রক্রিয়ায় শিবির যুক্ত ছিল, শিবিরের ইনস্ট্রাকশনে আমরা কাজ করতাম। এটা মিথ্যাচার।’
নাহিদ আরও বলেন, ‘সাদিক কায়েম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোনো সমন্বয়ক ছিল না। ৫ আগস্ট থেকে এ পরিচয় সে ব্যবহার করেছে। অভ্যুত্থানে শিবিরের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কারণে সাদিক কায়েমকে প্রেস ব্রিফিংয়ে বসার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু সাদিক কায়েমরা অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে ঢালাও প্রচারণা করেছে এই অভ্যুত্থান ঢাবি শিবিরই নেতৃত্ব দিয়েছে। আমরা সামনে শুধু পোস্টার ছিলাম। অভ্যুত্থানে শিবিরের ভূমিকা কেউ অস্বীকার করে নাই। কিন্তু এই অভ্যুত্থান শিবিরের একক নয়, শিবিরের ইনস্ট্রাকশন বা ডিরেকশনেও হয় নাই।’
এরই মধ্যে বরিবার রাতে ডাকসু নির্বাচনের সম্ভাব্য প্রার্থী সাদিক কায়েমের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগের আঙুল তুলেছেন ডাকসুর আরেক সম্ভাব্য প্রার্থী। অভিযোগকারী হলেন বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের ঢাবি শাখার আহ্বায়ক ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক আবদুল কাদের।
তিনি অভিযোগ করেছেন, বিগত ফ্যাসিবাদী আমলে বর্তমানে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের হয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর নিপীড়ন চালিয়েছে কিছু গুপ্ত শিবির নেতা। তাদের বিরুদ্ধে জুলাই গণ অভ্যুত্থানে ছাত্রলীগের হয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার অভিযোগও করেছেন আবদুল কাদের। ৫ আগস্টের ঘটনার পর থেকে ‘গুপ্ত শিবির’ সদস্যরা প্রকাশ্য রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছেন। তৎকালীন ঢাবি শিবির সভাপতি সাদিক কায়েম ওই সময় ছাত্রলীগে ঢুকে পড়া শিবির নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা না করতে সুপারিশ করেছিলেন। ছাত্রলীগের হয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়নের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন হলের বেশ কয়েকজনকে ছাত্রশিবির সংশ্লিষ্ট হিসেবে পরিচয় দিয়ে সামনে এনেছেন তিনি। অন্তত সাতজন ‘গুপ্ত শিবিরে’র নাম উল্লেখ করে আবদুল কাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি পোস্ট শেয়ার করেছেন। অভিযুক্তরা হলেন,
মাজেদুর রহমান (বিজয় একাত্তর হল) : ২০১৯-২০ সেশনের শিক্ষার্থী শাহরিয়াদকে রাতভর মারধরের ঘটনায় নেতৃত্ব দেন। আবদুল কাদেরের দাবি, তিনি একই মাদরাসায় পড়ার সুবাদে জানতেন মাজেদুর ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন, কিন্তু ক্যাম্পাসে এসে ‘ভয়ংকর নিপীড়ক’ হয়ে ওঠেন।
মুসাদ্দিক বিল্লাহ (ঢাবি ছাত্রলীগ দপ্তর সম্পাদক) : ২০১৭-১৮ সেশনের এই নেতাকে আবদুল কাদের তাঁর জেলার বলে উল্লেখ করেছেন, যাঁর পরিবার জামায়াতপন্থি এবং তিনি নিজেও শিবিরের সাথী ছিলেন। তবে ‘পদ-পদবির জন্য তিনি কট্টর ছাত্রলীগ’ হয়ে ওঠেন এবং পূর্বে কোনো কমিটিতে না থেকেও সরাসরি ঢাবি শাখা ছাত্রলীগের দপ্তর সম্পাদক পদ পান।
আফজালুন নাঈম (জসীমউদ্দীন হল) : ২০১৬-১৭ সেশনের এই শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে গেস্টরুমে দুর্ব্যবহার ও নিপীড়নের অভিযোগ এনেছেন আবদুল কাদের। তিনি উল্লেখ করেন, এই নাঈম এখন জামায়াত-শিবিরের ‘আইকন’ শিশির মনিরের বিশেষ সহকারী।
ইলিয়াস হোসাইন (মুজিব হল) : ২০১৬-১৭ সেশনের এই নেতা জুনিয়রদের কাছে ‘ত্রাসের নাম’ ছিলেন। মিছিল-মিটিংয়ে যাওয়ার জন্য শিক্ষার্থীদের সর্বোচ্চ চাপ দিতেন, গেস্টরুমে ‘অসহ্য মেন্টাল টর্চার’ করতেন এবং ছাত্রলীগের পদও পেয়েছিলেন। ৫ আগস্টের পর এই ইলিয়াস ‘শিবিরের বড় নেতা’ হিসেবে আবির্ভূত হন এবং এখন শিবিরের ‘ইমামদের’ সঙ্গে চলাফেরা করেন।
মো. শাহাদাত হোসেন ওরফে সোহেল (মুহসীন হল) : ২০১৭ সালে ইসলামিক পেজে লাইক দেওয়ায় শিবির সন্দেহে পাঁচ শিক্ষার্থীকে রাতভর নির্যাতনের মাধ্যমে হলছাড়া করার ঘটনায় অভিযুক্ত ১৩ ছাত্রলীগ নেতার একজন। আবদুল কাদেরের দাবি, শাহাদাত ‘শিবির হিসেবে সর্বমহলে পরিচিত’ ছিলেন। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে এই মামলা হওয়ার পর সাদিক কায়েম শাহাদাতকে নিয়ে পোস্টকারীর সঙ্গে যোগাযোগ করে তদবির করেন।
হাসানুল বান্না (জহুরুল হক হল) : ২০২১-২২ সেশনের এই শিক্ষার্থীকে আবদুল কাদের ‘গুপ্ত শিবির’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন, যাঁরা ছাত্রলীগের হল ক্যান্ডিডেটদের পেছনে থেকে ‘তেলবাজি ও চাটুকারিতায় অনন্য’ ছিল। ৫ আগস্টের পর বান্না শিবিরের সদস্য সম্মেলনে গিয়ে নিজেকে সদস্য হিসেবে প্রকাশ করেন এবং এখন শিবিরের জহুরুল হক হল শাখার ‘বড় নেতা’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন।
রায়হান উদ্দিন (স্যার এ এফ রহমান হল) : ২০১৮-১৯ সেশনের এই শিক্ষার্থী ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী ছিলেন এবং হল ক্যান্ডিডেটের ‘একনিষ্ঠ অনুসারী’ ছিলেন। আবদুল কাদেরের দাবি, এই রায়হান ৫ আগস্টের পর শিবিরের ‘বড় নেতা’ হিসেবে হাজির হয়েছেন এবং তার আগের ফেসবুক আইডি মুছে ফেলেছেন।
হাসান সাঈদী (বিজয় একাত্তর হল) : আবদুল কাদেরের অভিযোগ, এই সাঈদী শিবিরের সাথী ছিলেন এবং পরে একাত্তর হল ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। নিজেকে ‘লীগার’ প্রমাণ করতে তিনি ‘উগ্রপন্থা’ বেছে নেন এবং কাগজপত্রে নাম পরিবর্তন করে ‘সাঈদ’ রাখেন। অবশেষে তিনি একাত্তর হল ছাত্রলীগের উপদপ্তর সম্পাদক হন। আবদুল কাদের আরও উল্লেখ করেন, সাঈদীসহ কয়েকজন ছাত্রলীগার মিলে দুই ব্যবসায়ীকে অপহরণ করে তিন দিন আটকে রেখেছিলেন, যার জন্য তিনি গ্রেপ্তার ও ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কৃত হন। জুলাইয়ের ১৫ তারিখে ছাত্রলীগের হামলায় আহত শিক্ষার্থীরা ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা নিতে গেলে সাঈদী সেখানে গিয়েও আহতদের ওপর হামলা করেন। সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সহযোগিতায় সাঈদী ক্যাম্পাসের বাইরে পরীক্ষা দিতে গেলে শিক্ষার্থীরা তাঁকে আটক করেন। তখন শিবিরের তৎকালীন ঢাবি সভাপতি সাদিক কায়েম তাঁকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য তদবির করেন। আবদুল কাদের আরও অভিযোগ করেন, ছাত্রলীগের হয়ে নিপীড়ন-নির্যাতন চালানো এমন কয়েকজনের বিষয়ে শিবিরের তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সাদিক কায়েম ফোন কল দিয়ে মামলা না দিতে তদবির করেছিলেন। প্রমাণ হিসেবে আবদুল কাদের তার পোস্টে সাদিক কায়েমের সঙ্গে কথোপকথনের একটি স্ক্রিনশট শেয়ার করেছেন। তাতে দেখা যায়- অভিযুক্ত বোরহান উদ্দিন রাজন ও মনির হুসেন জুলাই আন্দোলনে ছাত্রলীগের হামলার সঙ্গে জড়িত নন বলে বার্তা পাঠিয়েছেন সাদিক কায়েম। এদিকে আবদুল কাদেরের এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পালটা জবাব দিয়েছেন সাদিক কায়েম। এক পোস্টে সাদিক কায়েম দাবি করেছেন, তিনি এমন কোনো অনুরোধ করেননি। তিনি চেয়েছেন- নিরপরাধ কেউ যেন মামলায় না জড়ায়। সে জন্য তথ্য যাচাইয়ের অনুরোধ করেছেন।
সাদিক কায়েম বলেন, স্ক্রিনশটে যাদের নাম যুক্ত আছে, তারা কেউই শিবিরের না। ৫ আগস্টের পর থেকে তারা শিবিরের কোনো পদে বা কর্মসূচিতে ছিলেন না। ফলে, ছাত্রলীগে লুকিয়ে থাকা শিবিরকে বাঁচাতে সহায়তা করার বয়ানটি সম্পূর্ণ মিথ্যা।