মহাখালী বাস টার্মিনালে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য এসেছিলেন সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘৩২ বছর ধরে যাত্রীবাহী দূরপাল্লার বাস চালাই। অনেক দিন ধরে চোখ দিয়ে পানি পড়ছে, চুলকায়। ধুলাবালির কারণে এমনটা হচ্ছে ভেবে চিকিৎসা করাইনি। বেশ কিছুদিন ধরে দেখতে সমস্যা হচ্ছে। টার্মিনালে ফ্রি ক্যাম্পে পরীক্ষা করালে জানতে পারি চোখের পাওয়ারে সমস্যা হয়েছে। চশমা পরতে হবে। আমি যে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত এবং ডায়াবেটিসের মাত্রা ১৭, তা-ও জানতাম না।’ সাইফুলের মতো ৭০-৭৫ শতাংশ চালক চোখের সমস্যায় ভুগছেন। এর মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশ চালক সমস্যার বিষয়ে জানতেন না। রাজধানীর পাঁচটি স্থানে ১ হাজার চালকের স্বাস্থ্য পরীক্ষায় উঠে এসেছে এ তথ্য। চালকের দৃষ্টিজনিত সমস্যার কারণে সড়ক দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ছে। গত ছয় মাসে দেশে ৩ হাজারের বেশি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ২ হাজার ৯৪৩ জন। এর জন্য যেমন অদক্ষ চালক দায়ী, তেমন অসুস্থতাও বড় কারণ। তাই সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে চালকদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা নিয়ে বাড়ছে সচেতনতা। ২৯ থেকে ৩১ জুলাই তিন দিন ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্পে ১ হাজার চালকের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়েছে। ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ এবং সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের আয়োজনে এ মেডিকেল ক্যাম্প হয়। বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা দিয়েছে বারডেম হাসপাতাল, হার্ট ফাউন্ডেশন। চক্ষুসংক্রান্ত সেবা দিয়েছে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, দৃষ্টি উন্নয়ন সংস্থা এবং আল নূর হাসপাতাল। চোখের পাওয়ারের সমস্যায় বিনামূল্যে চশমা দিয়েছে ভিশন স্প্রিং এবং আল নূর হাসপাতাল। রাজধানীর বিআরটিসি তেজগাঁও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, তেজগাঁও ট্রাক টার্মিনাল, সায়েদাবাদ ও মহাখালী বাস টার্মিনাল এবং গাবতলী বিআরটিসি ট্রেনিং সেন্টারে এ ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প অনুষ্ঠিত হয়। দৃষ্টি উন্নয়ন সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. শাহীন রেজা চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘মেডিকেল ক্যাম্পে ১ হাজার চালকের চক্ষু পরীক্ষা করে ৭০-৭৫ শতাংশ চালকের চোখে সমস্যা পাওয়া গেছে। তাঁদের প্রায় ৬০ শতাংশ সমস্যার বিষয়ে জানতেন না। বেশির ভাগ চালকের চোখের পাওয়ারে সমস্যা পাওয়া গেছে। ২০-২৫ জন চালকের ছানিজনিত সমস্যা রয়েছে। রাতকানা, গ্লুকোমাসহ অন্য কোনো রোগ আছে কি না, তা-ও দেখা হয়েছে।
এসব রোগীকে ক্যাম্প থেকে বিনামূল্যে চিকিৎসা, চশমা এবং ওষুধ দেওয়া হয়েছে। ২০২৩ সালে পরিচালিত ক্যাম্পে আমরা প্রায় ৭৩ শতাংশ চালকের দৃষ্টিজনিত সমস্যা পেয়েছিলাম।’
তিনি বলেন, ‘এ চালকরা যে শুধু চোখের সমস্যায় ভুগছেন এমন না, তাঁদের ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপের মতো অন্যান্য অসুস্থতাও রয়েছে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, চালকদের স্বাস্থ্য সমস্যার কারণে এক-তৃতীয়াংশ দুর্ঘটনা ঘটে।’ সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে যানবাহন চালকদের স্বাস্থ্যগত বিষয়ে নজর দেওয়া প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন তিনি। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের সড়ক দুর্ঘটনার মাসিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে ৩ হাজার ৩৯টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। প্রাণ হারিয়েছে ২ হাজার ৯৪৩ জন এবং আহত হয়েছে ৩ হাজার ৫৭৮ জন। ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের রোগতত্ত্ব ও গবেষণা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী বলেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনার অনেক কারণের মধ্যে যানবাহন চালকদের অসুস্থতা, চোখের সমস্যাও রয়েছে। মালিকপক্ষ চালকদের স্বাস্থ্যগত দিকে নজর না দেওয়ায় মর্মান্তিক দুর্ঘটনার সাক্ষী হতে হয়, ঝরে যায় প্রাণ। দুর্ঘটনা কমাতে চালকদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার বিষয়ে উদ্যোগ জরুরি।’