মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ার দৌলতপুর এলাকায় মেঘনা নদীতে ৩ শতাধীক যাত্রী নিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেল ৩ টায় ঝড়ের কবলে পড়ে ডুবে যাওয়া লঞ্চ এমভি মিরাজ-৪ আজ বিকেল সোয়া ৫ টায পুরোপুরি উদ্বার করা সম্ভব হয় নাই। তবে বিকেল ৫টার দিকে ডুবে যাওয়া লঞ্চটির মাথা জাগাতে দেখা গেছে।
এ পর্যন্ত ৩২ টি মরদেহ উদ্বার করা হয়েছে এবং আরো অনেক যাত্রী নিখোঁজ রয়েছে বলে তীরে সাতরিয়ে বেচে আসা যাত্রীদের দাবী। নিহত, আহত এবং নিখোঁজ যাত্রীদের বেশীর ভাগ যাত্রীর বাড়ি শরিয়তপুর জেলার নড়িয়া ও ভেদরগঞ্জ উপজেলায়। গজারিয়ার মেঘনা তীরে এখন শত শত মানুষের স্বজন হারানো কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছে সেখানকার আকাশ বাতাশ।
নাম পরিচয়:
এ পর্যন্ত উদ্বার হওয়া ৩২ টি মরদেহের মধ্যে ২০ জনের নাম পরিচয় পাওয়া গেছে। এবং তাদের মরদেহ তাদের স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তারা হলেন, শরিয়তপুর জেলার ভেদেরগঞ্জ উপজেলার কার্তিকপুর গ্রামের শ্রীদম দাশের ছেলে কৃষ্ণ কমল দাশ(৫০), সখিপুর উপজেলার দুলারচর গ্রামের সাজু দেওয়ানের স্ত্রী লাইলী বেগম(৫০), নড়িয়া উপজেলার সুরেশ্বর এর আরব আলী মালতের ছেলে আব্দুল জলিল মালত(৫০), একই উপজেলার রাহাপাড়া গ্রামের ফজলুল হক আকন্দের স্ত্রী সেতারা বেগম (৫৫), পাচগাঁও গ্রামের লিটন কাজীর স্ত্রী টুম্পা বেগম(২৬), লিটন কাজীর মেয়ে সুমনা(৮), কলকাঠি গ্রামের আব্দুল মান্নান দেওয়ান(৫০), নড়িয়ার এলাহী বক্সের ছেলে জামাল শিকদার(৫০), পন্ডিতসার গ্রামের মিজানুর রহমানের মেয়ে মাহি(৪), শুরেশ্বর দরবার শরিফের জালাল শিকদারের ছেলে আবির(২), পন্ডিতসার গ্রামের আব্বাস হোসেনের ছেলে মো: মানিক(১৪), চাকধ গ্রামের মাসুম মিয়ার ছেলে আব্দুল্লা আল রেদোয়ান(৪০), দিনারা গ্রামের ইদ্রিস শেখের স্ত্রী রাশিদা বেগম(৬০), নন্দনসার গ্রামের হোসেন আলীর ছেলে খোরশেদ আলী (৭৫), মঙ্গলসার গ্রামের জলিল মেলে্লার ছেলে ওসমান গনী মোল্লা(৪০), কলুকাঠি গ্রামের রহিম ফকিরের ছেলে ইসমাইল ফকির(৬৫), পাচগাঁও গ্রামের নূরুল ইসলামের ছেলে আব্দুল জলিল(৫৫), নড়িয়ার শাহিনুরের স্ত্রী রিয়া বেগম(২৫), পাইকপাড়া গ্রামের দুলাল বেপারীর স্ত্রী রহিমা বেগম(৫৫), উপালি গ্রামের রিপন মৃধার মেয়ে রিতু আক্তার (১২)। উদ্বার হওয়া অপর মরদেহ গুলির সনাক্ত করনের কাজ চলছে।
গতকাল রাতে নিখোজদের স্বজনেরা উদ্বারকারীদের পাশাপাশি নিজেরাও ট্রলার নিয়ে তাদের স্বজনদের খুজেছেন। আজ সকাল থেকে সকলের দৃষ্টি এখন এমভি মিরাজ- ৪ এর দিকে। স্বজনরা মনে করছেন ওই নিমজ্জিত লঞ্চের মধ্যেই প্রায় আড়াই'শ মরদেহ রয়েছে। তাই সময় যতই গড়িয়ে যাচ্ছে নিখোঁজদের স্বজনেরা ততই ক্ষোভে ফুসে উঠছেন। দুর্ঘটনার প্রায় ৩ ঘন্টা পর সন্ধা সাড়ে ৬টায ঘটনাস্থলে পৌঁছায় উদ্বারকারী জাহাজ প্রত্যয়।
দেশের সবচেয়ে শক্তিশালি উদ্বারযান প্রত্যয়ের এই প্রথম পরিক্ষায় তেমন কোন চমক দেখাতে পারে নাই। রাতভর ঢিলে ঢালা ভাবে উদ্বারকাজ করলেও ভোর হওয়ার সাথে সাথে খুব জোরে শোরে উদ্বার কাজ চালানো হয। নিমজ্জিত লঞ্চটি এক পাশে কাত হয়ে পলি এবং বালি দ্বারা ভরাট হয়ে যাওয়ায় এমভি মিরাজ-৪ কে উদ্বার করতে বেগ পেতে হচ্ছে বলে জানান, উদ্বার কাজে নিয়োজিত ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরী রিলিং সিডি মোস্তাফিজ।
এ ছাড়া ডুবুরীরা আরো জান লঞ্চটি দুর্ঘটনার কবলে পড়ার ঠিক আগ মুহুতেৃ বৃষ্টি থাকার কারনে তেরপল দ্বারা চারি পাশে ঢেকে রাখা ছিল। সেই সমস্ত তেরপল এবং লঞ্চে থাকা মালামাল পানিতে ফুলে গিয়ে লঞ্চের জানালা গুলি দেওয়ালের মত আবরন করে রেখেছে। এ কারনে তারা সাচ্ছন্দে লঞ্চের ভিতরে প্রবেশ করতে পারছেন না এবং এ কারনে উদ্বার কাজ ব্যাহত হচ্ছে। এবং ওই কারনেই লঞ্চের মধ্যে বেশকিছু মরদেহ রয়েছে বলে মনে করছেন উদ্বার কাজে নিয়োজিত কর্মীরা। উদ্বার কাজ অব্যাহত রয়েছে। তবে কখন দুর্ঘটনা কবলিত অনেক মরদেহের ভান্ডার এমভি মিরাজ-৪ উদ্বার করা সম্ভব হবে তা উদ্বারকারী কতৃপক্ষ জানাতে পারছেন না।
প্রতিটি মরদেহের জন্য ৭০ হাজার টাকা:
এ দিকে দুর্ঘটনা স্থলে নৌ-পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার গুলিকে বিআইডবি্লউটিসি'র কল্যান তহবিল থেকে প্রত্রেক মরদেহকে ৫০ হাজার টাকা করে এবং স্থানীয় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২০ হাজার করে টাকা করে মোট ৭০ হাজার টাকা দেওয়ার ঘোষনা দেন।
৩ সদস্য বিশষ্টি তদন্ত কমিটি গঠন:
নৌ-বানিজ্য অধিদফতরের ইঞ্জিনিয়ার এ্যান্ড শীপ সার্ভেয়ার এ এস এম সিরাজুল ইসলামকে প্রধান করে ৩ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটি আগামি ৭ দিনের মধ্যে তাদের প্রতিবেদন দাখিল করবেন বলেও জানানো হয়েছে।
বাবা আমারে ফেইল্যা যাইও না:
বাবা আমারে ফেইল্যা যাইওনা বাবা আমারে ফেইল্যা যাইও না। এই বলে ডুকরে ডুকরে কাদছেন আর আহাজারী করে বুক ফাটাচ্ছেন ১১ বছরে ছেলে হারা বাবা মোহাম্মাদ আলী। দুর্ঘটনার হাত থেকে সাতরিয়ে ১১ বছরের আরিফ নামের ছেলেকে ফেলে নিজে প্রানে বেচে আসা শরিয়তপুর জেলার ভেদরগঞ্জ এলাকার মোহাম্মাদ আলী (৪০) বারবার বুক চাপড়ে মূর্ছা যাচ্ছেন। তার কান্নায় মেঘনা পাড়ের আকাশ বাতাশ ভারি হয়ে উঠেছে। সে জানায় লঞ্চটি দুর্ঘটনায় পতিত হওয়ার ৩/৪ মিনিট আগে তার বুকের ধন মো: আরিফ তাকে জাপটে ধরে বলেছিল বাবা আমারে ফেইল্যা যাইওনা। কিন্তু আমি তারে ফেইল্যা আইছি।
আমি পারি নাই তারে বাচিয়ে আনতে। মরন ব্যাধি ক্যানসার তারে নিতে পারে নাই। আমার জমি বেইচা ৮ লাখ টাকা খরচ করে গেল ২ বছর হয় তারে ভালো করেছি। কিন্তু আজ আমার কি হয়ে গেল নিজেই আমার বুকের মানিককে ফেইল্যা আইছি। তার এই আর্তনাত আর আহাজারীতে চোখের পানি ধরে রাখতে পারছেন সেখানকার কেউ।
একই পরিবারের ৭ জনের ৬ জন নিখোঁজ:
একই পরিবারের ৭ জনের মধ্যে বেচে যাওয়া আলো (৩০)এখন পাগল প্রায়। সে সাতরিয়ে পাড়ে উঠতে পারলেও বাকী ৬ জন নিখোঁজ রয়েছে। আলো জানায় তারা দির্ঘ দিন যাবৎ ঢাকায় বসবাস করে আসছেন। শরিয়তপুরের নরিয়ায় তাদের পারিবারিক এক আত্মীয়ের বাড়িতে দাওয়াত খেতে ঢাকা থেকে শরিয়তপুর যাচ্ছিল তারা। কিন্তু তাদের আর সেই দাওয়াত খাওয়া হলো না। তার মেয়ে মাহি(৩) মামাতো ভাই শাকিল, সজিব, রুবেল, খালাতো বোন সোনিয়া এবং সোনিয়ার মেয়ে সায়মন নিখোঁজ রয়েছে।
দেইখ্যা বুইজ্যা ফেলাইছি ওইডা আমার বোন:
আজ সকাল ৮টার দিকে উদ্বার কারী জাহাজ প্রত্যয়ে দাড়িয়ে এক ভাই তার বোনের মরদেহ উদ্বার কারীদের হাতে দেখেই চিনে ফেলে ওইটা তার বোনের মরদেহ। সে প্রত্যয়ে দাড়িয়েই তার অপর এক স্বজনকে বলে ওইটা তার বোন কিনা। উত্তরে ওই স্বজন জানায় হ্যা ওটা তার বোন তখনই সে আহাজারী করতে থাকে আর বলতে থাকে আমি দেখ্যাই বুইজ্যা ফেলাইছি ওইডা আমার বোন। শরিয়তপুরের নরিয়ার আবুল কালমের আহাজারিতে প্রত্যয়ের অনেকের মন কাদে।
বর্ষার দুই মাস ছোট লঞ্চ চলাচল বন্ধ রাখার সিদ্বান্ত নেবে কতৃপক্ষ:
নৌ-পরিবহন মন্ত্রী মো: শাজাহান খান বলেছেন দুর্ঘটনা এড়াতে আগামিতে বর্ষার ২ মাস ছোট ছোট লঞ্চ চলাচল বন্ধ রাখার সিদ্বান্ত নিবে বিআইডব্লিউটিএ। তিনি বলেন বর্ষায় হঠাৎ ঝড়ের কবলে ছোট ছোট লঞ্চ নিজেকে সামাল দিতে ব্যার্থ হয়। সে ক্ষেত্রে অনেক সময় দুর্ঘটনা ও ঘটতে পারে তাই তিনি এ ধরনের সিদ্বান্তের কথা ভাবছেন।