সুস্থ সবল এবং চেতনায় সমৃদ্ধ বাংলাদেশ আমরা পেয়েছিলাম একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে। ৯ মাসের যুদ্ধে দেশের সব কিছু ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সুস্থ সবল বলছি এ কারণে যে, সদ্য জন্ম নেওয়া রাষ্ট্রটির শরীরে কোনো রোগবালাই বা ক্ষত চিহ্ন ছিল না, অভাব-অনটন ছিল। আর চেতনার শক্তির কাছে কামান, বন্দুক যে কত অসহায় সেটি তো আমরা প্রমাণ করে দিলাম ২৩ বছর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং একাত্তরের ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। এ জন্য নেপোলিয়ন তার শেষ জীবনে সেন্ট হেলনার নির্জন প্রকোষ্ঠে বসে ছেলেকে চিঠিতে জানিয়েছিলেন, 'এই পৃথিবীতে দুটি ক্ষমতা আছে, যার একটি হলো তলোয়ার আর অন্যটি চেতনা। শেষ বিচারে চেতনার কাছে তলোয়ারের পরাজয় অনিবার্য।' ইন্দ্রিয় হলো মানুষের সব কাজের চালিকাশক্তি। এটি প্রধানত তিন ভাগে বিভক্ত- জ্ঞানেন্দ্রিয়, কর্মেন্দ্রিয় এবং অন্তরিন্দ্রিয়। এই তিন ক্যাটাগরির ইন্দ্রিয়ের আওতায় আবার অনেক উপ-ইন্দ্রিয় মানুষকে পরিচালিত করে। সে হিসাবে মানুষের ইন্দ্রিয় মোট ১৪টি। জ্ঞানেন্দ্রিয়ের আওতায় চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, ত্বক ও জিহ্বা এই পাঁচটি উপ-ইন্দ্রিয়। কর্মেন্দ্রিয়ের আওতায় আছে আরও পাঁচটি- বাক, হস্ত, পদ, পায়ু, উপস্থ। আর অন্তরিন্দ্রিয়ের আওতায় কাজ করে- মন, বুদ্ধি, অহংকার এবং চিত্ত। এই ১৪টি ইন্দ্রিয় শক্তির মূল পরিচালকের আসনে আছে মন। মন তাড়িত হয় চেতনার দ্বারা, যার অপর নাম মনের অনুভূতি। চেতনার বহুবিধ দিক থাকে। প্রেম-ভালোবাসা, আশা-আকাঙ্ক্ষা থেকে শুরু করে দেশপ্রেম, মানবপ্রেম ইত্যাদি। চেতনার মধ্যে শুভ, অশুভ দুটো দিকই আছে। তাই দেখা যায় অশুভ চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মানুষ খুনখারাবি, রাহাজানি, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, লুটতরাজে লিপ্ত হয় এবং সারা জীবন উঠতে-বসতে ঘুষ দুর্নীতিতে লিপ্ত থাকার পরেও নিজের জেল্লা নিজেই প্রকাশ করতে সামান্য লজ্জাবোধ পর্যন্ত থাকে না। একই কারণে ধর্মান্ধ জঙ্গিদের মুখে শোনা যায় অমুককে হত্যা করেছি ইসলাম কায়েম করার জন্য। অথচ সব ধর্মেই মানুষ হত্যা মহাপাপ। দেশপ্রেমের চেতনার উৎসস্থল নিজ নিজ দেশের ঐতিহাসিক গৌরবোজ্জ্বল ঘটনাপ্রবাহ। সে জন্য দেখা যায়, যেসব জাতি আজ উন্নতির উচ্চ শিখরে পৌঁছেছে তারা তাদের ইতিহাসের গৌরবোজ্জ্বল ঘটনাগুলোকে শত শত বছর ধরে রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে দিপ্যমান রেখেছে, যাতে অনাগত কাল ধরে আগত নতুন প্রজন্মের মনে দেশপ্রেমের চেতনা সৃষ্টিতে উৎসস্থলের কোনো ঘাটতি না থাকে। বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের মনে দেশপ্রেমের চেতনার উৎসস্থল প্রোথিত রয়েছে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ২৩ বছরজুড়ে সংগ্রামের ঘটনাসমূহ, একাত্তরের ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহ এবং তারপর ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের বিশাল ক্যানভাসের মধ্যে। কিন্তু অর্ধসত্য, সত্যমিথ্যার মিশ্রণ ও পরিপূর্ণ মিথ্যা দ্বারা ওই সব চেতনার উৎসস্থলগুলোকে কলঙ্কিত করা হয়েছে এবং নতুন প্রজন্মের কাছ থেকে আড়াল করার চেষ্টা হয়েছে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পঁচাত্তর পরবর্তী দুই সামরিক শাসক দ্বারা এবং জামায়াত-বিএনপি সরকারের মেয়াদে। তারা এখনো সেই চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। তাই লন্ডনে অবস্থিত এক ফেরারি আসামির মুখে শোনা যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নাকি রাজনৈতিকভাবে ব্যর্থ হয়েছেন! একটা দেশকে স্বাধীন করে দেওয়ার চেয়ে বড় কোনো রাজনৈতিক অর্জন আর থাকে নাকি? অর্বাচীনতা এবং মূর্খতারও একটা সীমা আছে বলে এতদিন জানতাম। একজন মানুষ যেমন শরীরের আঘাতের চিহ্ন বা ক্ষত নিয়ে আরেকজন পরিপূর্ণ ক্ষতহীন মানুষের মতো বেড়ে উঠতে পারে না, তেমন রাষ্ট্রের গায়ে যদি ক্ষত চিহ্ন থাকে তাহলে সেই রাষ্ট্রও প্রত্যাশা অনুযায়ী এগোতে পারে না। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির গায়ে প্রথম গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয় বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। এই ক্ষত যাতে শুকাতে না পারে এবং দিন দিন তা যেন আরও গভীরতর হয় তার জন্য স্বঘোষিত খুনিদের বিচার না করার আইন করা হয় এবং তাদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদাসহ বাংলাদেশের দূতাবাসে চাকরি দেওয়া হয়। সভ্য দেশের কোনো মানুষের সঙ্গে আলোচনাকালে এ প্রসঙ্গ এলে আমাদের লজ্জা পেতে হয়। তারপর জাতীয় চার নেতা, যারা মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের কর্ণধার ছিলেন তাদের ১৯৭৫ সালের নভেম্বর মাসে জেলখানার মধ্যে হত্যা করে রাষ্ট্রের গায়ে দ্বিতীয় ক্ষতটি তৈরি করা হয়। তৃতীয় ক্ষতটি তৈরি করেন পঁচাত্তরের রক্তাক্ত অধ্যায়ের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া প্রয়াত জেনারেল জিয়াউর রহমান। তিনি গণমানুষ বা সংসদের অপেক্ষা না করে এককভাবে সামরিক অর্ডিনেন্সের মাধ্যমে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ২৩ বছর সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধের দর্শন ও চেতনাবাহী প্রায় চলি্লশটি শব্দ, বাক্য ও ধারা বাহাত্তরের সংবিধান থেকে বাদ দিয়ে দেন। বাংলাদেশের মানুষকে ভাবতে হবে প্রধান সামরিক প্রশাসক হয়ে জিয়াউর রহমান কেন এত তাড়াহুড়া করে, এত নগ্নভাবে রাষ্ট্রের সংবিধানকে ক্ষতবিক্ষত করলেন। স্বাভাবিক পরিস্থিতি ও পার্লামেন্টের জন্য তিনি অপেক্ষা করতে পারলেন না কেন? এ প্রশ্নের সঠিক উত্তরের মধ্যে নিহিত আছে স্বাধীনতার ৪৩ বছর পরেও বাংলাদেশের রাজনীতি এখনো কী কারণে ভয়ানক বিপরীতমুখী ও সাংঘর্ষিক হয়ে আছে। কেন সেখান থেকে রাজনীতি আজও বের হতে পারছে না। এই তৃতীয় ক্ষতের জায়গাটি আরও ভয়াবহ ও গভীরতর হয় সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম বানানোর মধ্য দিয়ে। যে জামায়াত, রাজাকার, আলবদর বাহিনী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে একত্রিত হয়ে একাত্তরে সারা বাংলাদেশে হত্যা, ধর্ষণ, অগি্নসংযোগ ও লুটতরাজ চালিয়েছে তাদের ১৯৭৬ সালে পুনরায় বাংলাদেশে রাজনীতি করার সুযোগ পাওয়ার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের গায়ে চতুর্থ ক্ষতটি তৈরি হয়। দ্বিতীয় সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদ এই ক্ষতের আরও বিস্তৃতি ঘটিয়েছেন। বিএনপি তাদের ২০০১-২০০৬ মেয়াদে জামায়াতের দুজন চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীকে পূর্ণ মন্ত্রী বানিয়ে রাষ্ট্রের এই চতুর্থ ক্ষতটিকে ভয়াবহ স্থানে নিয়ে যায়। ২০০৯ সালে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক শক্তি ক্ষমতায় এসে বহু বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে ওই ক্ষতগুলো থেকে বাংলাদেশকে বের করে আনার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কিন্তু এ পর্যন্ত বেশ কিছু দূর অগ্রসর হলেও আরও অনেক পথ যেতে বাকি। এই বাকি পথের মধ্যে সব যুদ্ধাপরাধীর বিচার দ্রুত সুসম্পন্ন করা একান্ত অপরিহার্য ও জরুরি হয়ে পড়েছে। সব সম্ভবের বাংলাদেশে কখন যে কী হয় তা অনুমান করা কষ্টকর। ২০১০ সালে এই বিচার শুরু হওয়ার পর জামায়াত-শিবিরের স্পর্ধা ও ঔদ্ধত্য আমরা দেখেছি। বিচার বানচাল করার জন্য ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ৩ তারিখে মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায় তাণ্ডব চালিয়ে পার্কিং করা অগণিত গাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে ত্রাসের সৃষ্টি করে ওই জামায়াত-শিবিরের ক্যাডাররা। পরের দিন ৪ ফেব্রুয়ারি শাপলা চত্বরে সমাবেশ করে হুমকি দেয় তাদের নেতাদের কিছু হলে সারা দেশে আগুন জ্বলবে এবং গৃহযুদ্ধ বাধিয়ে দেওয়া হবে। পরের দিন ৫ ফেব্রুয়ারি ট্রাইব্যুনালের রায়ে কাদের মোল্লার প্রত্যাশিত ফাঁসির দণ্ডের পরিবর্তে যাবজ্জীবন হলে সারা বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম ফুঁসে উঠে। উত্তাল হয় ঢাকার শাহবাগ চত্বর। ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি আরেক মশহুর যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে ফাঁসির দণ্ডাদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল। ওই দিন বিকাল থেকে জামায়াত-শিবিরের সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনী দেশব্যাপী সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর চালায় নির্মম পাশবিক নির্যাতন এবং জ্বালাও-পোড়াও। তারা বিশ্রামরত পুলিশের ওপর আক্রমণ চালিয়ে কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে হত্যা করে। পুলিশের পাল্টা গুলিতে নিহত হয় শিবিরের কয়েকজন ক্যাডার। ১ মার্চ ২০১৩, সিঙ্গাপুরের এক সংক্ষিপ্ত সফর শেষে দেশে ফেরেন বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। ওইদিন বিকালে তিনি হুকুম দেন বিএনপি ও তার অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মীদের জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে যোগ দেওয়ার জন্য। তার পরিণতিতে কয়েক দিন ধরে দেশব্যাপী বিএনপি-জামায়াতের ভয়াবহ তাণ্ডব চলে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিদ্যুৎকেন্দ্র তারা ভস্মীভূত করে। এতসব বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে গত ডিসেম্বর মাসে কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হলে বাংলাদেশের মানুষ আবার আশান্বিত হয়। কিন্তু ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকেন্দ্রিক ঘটনা এবং সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জ ও ফেনীর ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের বিষয়গুলোর জের ধরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি কেন যেন সবার দৃষ্টির আড়ালে চলে যাচ্ছে। মানুষের মনে সৃষ্টি হচ্ছে অনাকাঙ্ক্ষিত প্রশ্ন ও বিভ্রান্তি, যার থেকে ফায়দা উঠানোর চেষ্টায় নেমেছে সেসব রাজনৈতিক দল যারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায় না এবং মুক্তিযুদ্ধের সব গৌরবকে ম্লান করতে চায়। এ পর্যন্ত সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ থেকে চূড়ান্ত নিষ্পত্তির পর একটি মাত্র বিচারের রায় কার্যকর হয়েছে। এখন শুধু দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর চূড়ান্ত রায় আপিল বিভাগে অপেক্ষমাণ। আরও পাঁচ-ছয়টি কেস আপিল বিভাগে শুনানির জন্য পেন্ডিং আছে। ট্রাইব্যুনালে রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ আছে আরও দুই-তিনটি কেস। তার মধ্যে আলবদর বাহিনীর প্রধান মতিউর রহমান নিজামীর রায় ট্রাইব্যুনালে অপেক্ষমাণ দুই মাসেরও অধিক সময় ধরে। এর পূর্বে আপিল বিভাগে কাদের মোল্লার রায় এত দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষমাণ ছিল না। ইতোপূর্বে ট্রাইব্যুনালেও অপেক্ষমাণ রায় এত বেশি দিন পেন্ডিং থাকেনি। দেশের অভ্যন্তরে এই যুদ্ধাপরাধীদের নিজেদের অর্থনৈতিক ও ক্যাডার শক্তি, তাদের দোসরদের রাজনৈতিক শক্তি, বিদেশে কোটি কোটি ডলারের লবিং নিয়োগসহ পাহাড়সম বাধা অতিক্রম করে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর মতো অসীম নৈতিক সাহস ধারণ করেন বিধায় এই বিচার হচ্ছে এবং একটি ফাঁসির রায়ও কার্যকর হয়েছে। বাকি বিচারও সম্পন্ন হবে এবং রায়ও কার্যকর হবে, শেখ হাসিনার প্রতি এ বিশ্বাস মানুষের আছে। কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়। বিলম্বের কারণে বিএনপি এটি নিয়ে রাজনীতির মাঠকে ঘোলা করার চেষ্টা করছে এবং মানুষকে বিভ্রান্ত করার সুযোগ পাচ্ছে। আর দিন যত যাচ্ছে জামায়াত-শিবিরের ক্যাডার বাহিনী পরিকল্পনার জাল বিস্তার করার বেশি সুযোগ পাচ্ছে। তারা রায় বেরোনোর পর কীভাবে দেশব্যাপী তাণ্ডব চালাবে, যেমনটি তারা করেছিল ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে, তার প্রস্তুতি চলছে।
সময় যত পাবে জামায়াত-শিবির তাদের বিশাল অর্থের ভাণ্ডার ব্যবহার করে দেশের বিভিন্ন জায়গায় রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডসহ বড় বড় নাশকতামূলক কাজ চালিয়ে সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যতিব্যস্ত রাখবে, সুযোগমতো নাস্তানাবুদ করে ছাড়বে। টাকার কাছে সরকারের প্রশাসন ও সরকারি দলের লোকজনও যে কাবু হয়ে যায় তা তো আর নতুন করে বলার দরকার নেই। টাকার মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কতিপয় সদস্যের নৈতিক পদস্খলন ঘটাতে পারলে তখন তাদের আরও পোয়াবারো। বহুমুখী প্রোপাগাণ্ডায় ফোর্সের মনোবল ভেঙে দেওয়াই তাদের লক্ষ্য, যাতে যুদ্ধাপরাধীদের রায় কার্যকর হওয়ার পর তারা যে ভয়াবহ তাণ্ডব চালাবে সেই ভয়ে রায় কার্যকর করা থেকে সরকার যেন বিরত থাকে। যত সময় যাবে, সেই সময়ের তারা বেশি বেশি অপব্যবহার করবে। ওই একই লক্ষ্যে তারা অঢেল টাকা ঢেলে সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাবে। ইতিপূর্বে সাঈদী ও অন্যদের রায়কে কেন্দ্র করে তারা যে তাণ্ডব চালিয়েছিল সেটিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর ভূমিকা রেখেছিল র্যাব। নারায়ণগঞ্জের মর্মান্তিক ঘটনায় র্যাবের তিনজন সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠার সুযোগে বিএনপির পক্ষ থেকে সম্পূর্ণ বাহিনীকে বিলুপ্তির দাবি জানানো হচ্ছে। আক্কেলমান্দের জন্য ইশারাই কাফি হ্যায়! কার মনে যে কী আছে তা একমাত্র ভবিতব্যই বলতে পারেন। আর আগামীতে কে কী করবেন তাও আমরা জানি না। তবে বিগত দিনের উদাহরণ যদি ভবিষ্যৎ বোঝার জন্য কোনো গাইডলাইন হয় তবে তা কোনো শুভ বার্তা দিচ্ছে না।
জামায়াত-শিবির তো আছেই, অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তি যারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে তারা বসে নেই। তারা দেশে-বিদেশে যত না প্রকাশ্যে তার চেয়ে অনেক বেশি গোপন তৎপরতা চালাচ্ছে। সুতরাং বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যারা যুদ্ধাপরাধের বিচার চায় তাদের শুধু সরকারের দিকে তাকিয়ে বসে থাকলে চলবে না। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো সংঘবদ্ধভাবে সোচ্চার হতে হলে সংগঠনের দরকার। নিঃস্বার্থভাবে কাজ করার মতো সাংগঠনিক নেতৃত্ব দরকার। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য সবচেয়ে বেশি সরব হওয়ার কথা ছিল যে সংগঠনটির, সেই মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের (মুক্তিযোদ্ধা সংসদ) কোনো অস্তিত্ব নেই এক বছর যাবৎ। আর মুক্তিযোদ্ধা সংসদ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শকে বাঁচিয়ে রাখার সংগ্রাম বাদ দিয়ে যদি শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্য হাজার-পাঁচশ করে টাকা বিলিবণ্টনে ব্যস্ত থাকে তাহলে তো আর কথা নেই। বিগত দিনে আমরা তাই-ই দেখেছি। সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম গঠিত হওয়ার পরে দারুণ প্রশংসনীয় কাজ করেছিল তরুণ প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য। কিন্তু গত দুই-তিন বছর তাদের কোনো উপস্থিতি আর নেই বললেই চলে। বাঙালি চেতনার ধারক-বাহক সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো এ বিষয়ে বিগত সময়ে ব্যাপক কাজকর্ম করেছে। মনে হয় তারাও যেন এখন নীরব নিস্তব্ধ ভূমিকা নিয়েছে।
জামায়াতে ইসলামীকে সংগঠন হিসেবে বিচার করার বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি আইনি বিতর্ক শুরু হয়েছে। আইনে কি আছে সেটি দেখার প্রধান দায়িত্ব রাষ্ট্রের এবং তারপর যারা আইন বিশারদ আছেন তাদের। কিন্তু তাদের সবার জানা উচিত এবং আমি মনে করি তারা জানেন যে, দেশের তরুণ সমাজসহ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ জামায়াতের মতো বিষফোঁড়া বাংলাদেশের গায়ে আর একদিনও রাখতে চায় না। মানুষের এই চাওয়াকে মূল্য দেওয়ার জন্য বিচারের পক্ষে অবস্থানকারী সব সংগঠন ও মানুষকে সোচ্চার হয়ে গগনবিদারি আওয়াজ তোলা এখন জরুরি।
লেখক : কলামিস্ট ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।
ই-মেইল : [email protected]