দিন যত গড়াচ্ছে সরকারের ভেতর অস্থিরতাও যেন বাড়ছে। একের পর এক ভুল জায়গায় হাত দিচ্ছে। মাত্র কদিন আগে বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে ন্যস্ত করার নামে কার্যত তা ক্ষমতাসীন সরকারের কুক্ষিগত করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। ৩ আগস্ট সম্প্রচার নীতিমালা অনুমোদন করেছে লীগ সরকারের মন্ত্রিসভা। সঙ্গে সঙ্গে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। অন্য সবার পক্ষে সরকারি মহলের বিবেকবান মানুষ, বিশেষ করে গণমাধ্যম সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাও বলছেন, সম্প্রচার নীতিমালার 'যমটুপি' পরিয়ে সরকার আসলে সংবাদ মাধ্যমের টুঁটি চেপে ধরারই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ যেন ঠিক সেই চুয়াত্তর-পঁচাত্তরের কিছু ঘটনার পুনরাবৃত্তি। সেই সময়কালের কথা যাদের মনে আছে তারা এখনো ভেবে অাঁতকে ওঠেন যে, বিচার বিভাগ ও সংবাদমাধ্যমের ওপর হস্তক্ষেপ করে কী সর্বনাশটাই না করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় অদম্য এক বীরোত্তম কী করে কষ্টে অর্জিত গণতন্ত্রের কফিনে এক এক করে পেরেক ঠুকলেন, বেদনাবিধুর দৃষ্টিতে জাতি তা প্রত্যক্ষ করল। মনে হয়েছে বহু যুদ্ধে বিজয়ী এক বীর কীসের ভয়ে (সে কী জনবিচ্ছিন্নতার ভয়?) যেন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন এবং বাকশাল নামক এক প্রাচীরঘেরা প্রাসাদে সুরক্ষা পেতে চাইছেন। কিন্তু সে প্রাচীর তাকে সুরক্ষা দিল না। এমন কী বিভ্রমের অনুবর্তী হয়ে প্রাচীরঘেরা 'বাকশালি প্রাসাদে' ক্ষমতার যে দেউল তিনি নির্মাণ করেছিলেন, তাও টিকল না। নিষ্ঠুর নিয়তি সবই কেড়ে নিল।
না, কাউকেও ভয় দেখাচ্ছি না। ইতিহাসের করুণ, বেদনার্ত অধ্যায়ের এক একটি পাতা ওলট-পালট করছি আর ভাবছি, এটাই ইতিহাসের শিক্ষা যে, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা গ্রহণ করে না। আশ্চর্য! আমাদের দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি- ক্ষমতায় থাকলে এদের চেহারা একরকম, আর বিরোধী দলে থাকলে আরেক রকম। গণতন্ত্রের মুক্তি, সংবাদ মাধ্যম ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা বলতে বলতে এই কদিন আগেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা-নেত্রীরা মুখে ফেনা বের করে ফেলেছেন। তখন গণতন্ত্র তাদের কাছে সুখের বাতায়ন, মুক্ত সংবাদমাধ্যম ও স্বাধীন বিচার বিভাগ পরম বন্ধু কিংবা কুটুম। কিন্তু এখন যেন চোখের বিষ, ঘোর শত্রু। এখন তারা গণতন্ত্রের শরীরের ওপর ভারী রোলার চালিয়ে 'উন্নয়নের' কার্পেটিং করতে চান। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকে যখন বেরোয় যে, আগে উন্নয়ন, পরে গণতন্ত্র- বিস্ময়ে তখন হতবাকই হতে হয়। বিচার বিভাগ ও সংবাদমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের বেপরোয়া উদ্যোগ প্রধানমন্ত্রীর সেই ঘোষণার নিষ্ঠুর বাস্তবায়নেরই এক একটি কৃষ্ণ অধ্যায় বলে বিবেচিত হতে পারে ভবিষ্যতে। তখন হয়তো তা সংশোধনের কিংবা 'শাপমোচনের' সময় আর অবশিষ্ট থাকবে না।
বিচার বিভাগ নিয়ন্ত্রণের লীগ সরকারের উদ্যোগের বিরুদ্ধে কথাবার্তা খুব একটা হয়নি। বিচারপতিদের অবস্থান এমন একটা স্পর্শকাতর স্থানে যে, সেখান থেকে কিছু বলার বা প্রতিবাদের কোনো সুযোগ নেই। বঙ্গবন্ধু যখন বিচারকদের চাকরিচ্যুত বা পদচ্যুত করার ক্ষমতা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছিলেন, তখনো কোনো জোরালো প্রতিবাদ আসেনি। এবারও ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন ও নূরে আলম সিদ্দিকীসহ দু'একজনের কিছু সাহসী বক্তব্য ছাড়া আইনাঙ্গন থেকে তেমন কোনো জোর আওয়াজ শোনা যায়নি। কিন্তু সম্প্রচার নীতিমালার বিরুদ্ধে বুলন্দ আওয়াজ উঠেছে চতুর্দিকে। মিডিয়া মালিক-কর্মীদের মতো দেশের বিশিষ্টজনরাও 'জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা' নিয়ে শঙ্কিত। ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়েও তারা উদ্বিগ্ন। তাদের মতে, সরকার একটি কমিশন গঠনের আগে নীতিমালার নামে সম্প্রচার মাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। এটা নিপীড়নমূলক কালাকানুন। সম্প্রচার নীতিমালার নামে সরকার মানুষের মত প্রকাশ ও কথা বলার স্বাধীনতাকে স্তব্ধ করছে। অতিদ্রুত সম্প্রচার কমিশন গঠন করলে দেশে-বিদেশে ভুল বার্তা যাবে না। সব বিভ্রান্তি কেটে যাবে। কিন্তু এ ব্যাপারে প্রচণ্ড একটা ঝড় তোলা না গেলে লীগ সরকার পিছু হঠবে বলে মনে হয় না।
সংবাদমাধ্যমের প্রকৃত স্বাধীনতা ছাড়া গণতন্ত্র ও সুশাসনের কথা কল্পনাও করা যায় না। গণতন্ত্র থাকলে, সুশাসন থাকলে সংবাদমাধ্যমে সত্যের প্রকাশ ঘটে। কিন্তু সত্যের নির্মোহ প্রকাশ যদি কোনো দুর্বল সরকারের মুখোশের আড়ালে লুকানো চেহারা উন্মোচন করে নিন্দিত নরকের পথ দেখিয়ে দেয়, তখনই জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন, জনশক্তির ওপর ভরসাহীন সরকার নানা কালাকানুনের 'যমটুপি' পরিয়ে সংবাদমাধ্যমের চোখ-মুখ আটকে দেয়, কণ্ঠরোধ করে টুঁটি চেপে। কিন্তু কতদিন এভাবে চালানো যায়? বাংলাদেশে এর আগেও চারটি মাত্র দৈনিক পত্রিকা সরকারের নিয়ন্ত্রণে রেখে বাদবাকি সব পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। হাজার হাজার মিডিয়াকর্মী বেকার হয়েছিল, কেউ কেউ পেশা ত্যাগ করে কোনোমতে বেঁচেছিলেন, সিনিয়র সাংবাদিক গোলাম কিবরিয়ার মতো কেউ কেউ বায়তুল মোকাররমে ফুটপাতে ফলের দোকান দিয়ে জীবিকানির্বাহ করেছিলেন। গণমাধ্যমকে যারা নিষ্ঠুরভাবে বিপর্যস্ত করেছিলেন, তারা যখন মহাবিপর্যয়ের মুখে পড়েন তাদের পক্ষে দাঁড়ানোর শক্তি তখন আর গণমাধ্যমের অবশিষ্ট ছিল না। অথচ অন্যায়, অসত্য আর অসুন্দরের বিরুদ্ধে, বীভৎস তাণ্ডবের বিরুদ্ধে মিডিয়া বা সংবাদমাধ্যম এক সাহসী ও বলিষ্ঠ প্রতিবাদের 'দাবানল'।
প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার ওপর লীগ সরকারের রাষ্ট্রভাব আকস্মিক নয়। অধিকাংশই এক সময় শাসক লীগকে প্রমোট করেছে। একটি মাত্র দৈনিক পত্রিকা লীগ সরকারের বিরুদ্ধে দুঃসাহসী ভূমিকা পালন করেছে। সংবাদমাধ্যমে ভুলভ্রান্তি হয় না তা নয়। তা শোধরানোর বা সংবাদমাধ্যমকে শোভন পন্থায় শাসন করার পথ আমাদের প্রচলিত আইনেই আছে। সে পথে না গিয়ে সরকার 'আমার দেশ' পত্রিকা প্রকাশের পথে যে অন্তরায় সৃষ্টি করেছে তা স্রেফ ভিন্ন মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণের নামান্তর। পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান দীর্ঘদিন ধরে কারারুদ্ধ। কী তার অপরাধ? তা কী জামিনের অযোগ্য? সরকারি দলের ফাঁসির আসামি ক্ষমা পেয়ে যায়, কারাগারে তার শাদি মোবারক হয়। অথচ একজন সৎ ও সাহসী সম্পাদক স্ত্রী-পরিবারের সঙ্গে ঈদও করতে পারেন না; কী নিষ্ঠুর আচরণ! চ্যানেল ওয়ান, দিগন্ত টিভি, ইসলামী টিভি বন্ধ করে দেওয়ার পক্ষে লীগ সরকারের যুক্তি বড়ই দুর্বল। এসব সংবাদমাধ্যমের শত শত কর্মী এখন বেকার, খেয়ে না খেয়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন তারা। এটা সংবাদমাধ্যমের এই অংশটির প্রতিই নয়, ভিন্ন মত ও তা প্রকাশের প্রতি সরকারের অসহিষ্ণু আচরণ। ভিন্ন মত গুঁড়িয়ে দেওয়ার এ এক সর্বনাশা দাম্ভিকতা। এমন দম্ভ-দাম্ভিকের জন্য শুভ নয়। দেশে-বিদেশে এর প্রমাণ আছে অনেক। স্বৈরাচার এরশাদও সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতা হরণে উদ্যত হয়েছিল। জবাব পেয়েছে এবং যথাযথ পরিণতিও ভোগ করেছে। বেগম খালেদা জিয়াও দরবেশ ছিলেন না। একুশে টেলিভিশনসহ কয়েকটি প্রিন্ট মিডিয়ার সঙ্গে তার সরকারের আচরণও নিন্দিত হয়েছে এবং তাও ইতিহাসের অন্তর্গত বিষয়ই হয়ে আছে।
লীগ সরকারের 'জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা' আলোচ্য নিবন্ধের প্রতিপাদ্য বিষয়। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে জাসদের দলীয় পত্রিকা দৈনিক গণকণ্ঠ অফিসে হামলা ও পত্রিকা অফিসে তালা দিয়ে পত্রিকার সম্পাদক দেশবরেণ্য কবি আল মাহমুদসহ অন্যান্য সাংবাদিক গ্রেফতারের প্রতিবাদে বিপ্লবী কণ্ঠ(!), বঙ্গবন্ধুকে এই কারণে ফ্যাসিস্ট বলে অভিহিতকারী, সাবেক গণবাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ড এখন বঙ্গবন্ধুকন্যার অন্যতম সিপাহশালার (প্রকৃত আওয়ামী লীগাররাও নাকি এত বিশ্বস্ত নন), তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু এই সম্প্রচার নীতিমালার মধ্যে গণতন্ত্রের সৌরভের(!) কথা বলছেন। এক সময় দৈনিক গণকণ্ঠ অফিসে হামলা, সম্পাদককে গ্রেফতার ও পত্রিকা বন্ধে যিনি ফ্যাসিবাদের 'যম' দেখেছিলেন, তথ্যমন্ত্রী 'কুদরতি কুরসিতে' বসে 'আমার দেশ' পত্রিকা অফিসে পুলিশের ন্যক্কারজনক অভিযান ও টেনেহেঁচড়ে সম্পাদককে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া, অন্য কোনো শোভন ও যুক্তিসঙ্গত আইনগত পথে না গিয়ে তিনটি ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া বন্ধ করে দেওয়া এবং সম্প্রচার নীতিমালার আবরণে সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধের স্বৈরতান্ত্রিক পদক্ষেপকে গণতন্ত্রের পথে 'অগ্রসর' যাত্রা বলে মহানন্দে বাদ্য বাজাচ্ছেন, ভাবতে কষ্ট লাগে।
সাংবাদিকদের দুটি ইউনিয়ন সরকারের সম্প্রচার নীতিমালাকে প্রত্যাখ্যান করে সরকারকে এই কণ্টকিত পথে আর না এগুনোর পরামর্শ দিয়েছে। তথ্যমন্ত্রীর কথায় তাদের কারোরই আস্থা নেই। বেসরকারি টেলিভিশন মালিকদের সংগঠন অ্যাটকোও এই নীতিমালা নিয়ে শঙ্কিত। তাৎপর্যপূর্ণ একটি কথা বলেছেন একাত্তর টিভি চ্যানেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোজাম্মেল বাবু। তিনি বলেছেন, যেসব বিষয়ে নীতিমালায় বিধিনিষেধ আরোপের কথা বলা হয়েছে, সেসব বিষয়ের ব্যাখ্যা দেবে কে? একটি জাতীয় দৈনিককে তিনি বলেছেন, সম্প্রচার কমিশন গঠন না করে তথ্য মন্ত্রণালয়ের হাতে ক্ষমতা সংরক্ষিত রেখে সম্প্রচার নীতিমালা অনর্থক বিভ্রান্তি সৃষ্টি করবে। মনে হবে মিডিয়াকে সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। তার বক্তব্যের তাৎপর্যপূর্ণ অংশটি হলো, 'যে দেশে জাতীয়তা ও ইতিহাস দুই রকম এবং জাতির জনক দুজন, সে দেশে একটি নিরপেক্ষ কমিশন স্থাপন না করে একটি সাবজেক্টিভ নীতিমালা চাপিয়ে দিলে ঝামেলা বাড়া ছাড়া কমবে না।' তিনি কোন দৃষ্টিতে কথাটি বলেছেন জানি না, তবে এর ব্যাখ্যাটা এমনও করা যেতে পারে যে, দুই জাতীয়তা, দুই ইতিহাস ও দুই জাতির জনকের মধ্যে শাসক লীগের পছন্দের জাতীয়তা, ইতিহাস চাপিয়ে দেওয়ার ব্লুপ্রিন্ট অনুযায়ীই সম্প্রচার নীতিমালাটি প্রণয়ন করেছে সরকার। সাংবাদিক ইউনিয়নের একাংশ এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল কিন্তু এই আওয়াজ ইতিমধ্যে তুলেছে। সম্প্রচার কমিশন গঠনের কথা বলা হলেও কোন প্রক্রিয়ায়, কাদের নিয়ে তা গঠিত হবে তা নীতিমালায় বলা নেই। সার্চ কমিটি নামক বাছাই টিমটি সরকারি পছন্দের টিম হবে না তার নিশ্চয়তা নেই। বলা চলে তারা সার্চ কমিটি কর্তৃক বর্তমান নির্বাচন কমিশন গঠনের মতো লীগপন্থি ও সরকারি অনুগতদের নিয়েই গঠিত হবে। সে ক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, তথ্য কমিশনের মতো গণআস্থাহীন আরেকটি কমিশনই হবে এটি, যা লীগ সরকারের মনোরঞ্জন বা মনোতুষ্টির চেষ্টায়ই হরহামেশা রত থাকবে। সে কমিশন কখন হবে তাও সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়নি। অন্তর্বর্তীকালীন এই সময়জুড়ে সংবাদমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের সর্বময় ক্ষমতা থাকবে তথ্য মন্ত্রণালয়ের হাতে। এটা শিয়ালের কাছে মুরগি পাহারা রাখার মতো ঘটনা হয়ে যাবে বলেই আশঙ্কা সবার। বলা হচ্ছে, চালাকিটাও এই কারণেই করা হয়েছে। এ ব্যাপারে প্রতিক্রিয়ায় সাবেক ছাত্রলীগ ফাউন্ডেশনের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী বলেছেন, সাম্প্রতিক সময়ে দুটি ভয়াবহ এবং স্বৈরাচারীর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে ক্ষমতাসীনরা। একটি হচ্ছে বিচারকদের ইমপিচমেন্টের ক্ষমতা সরকারকে দেওয়া, অপরটি সম্প্রচার নীতিমালার মাধ্যমে গণমাধ্যমের লাগাম টেনে ধরা। এই নীতিমালাগুলো বাস্তবায়নের উদ্যোগ শুধু ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদদের জন্যই নয় বরং সামাজিক বিপর্যয়ের মতো একটি মারাত্দক অপরাধ হবে (মানবজমিন, ৬ আগস্ট, ২০১৪)। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন, ড. আকবর আলি খান, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মিজানুর রহমান শেলী, অধ্যাপক আসিফ নজরুল, ড. তুহিন মালিক প্রমুখও সরকারের মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত সম্প্রচার নীতিমালার ব্যাপারে উদ্বেগ ও শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
এটা মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, সরকার জেনে-বুঝেই এই বিপদসংকুল পথে পা বাড়িয়েছে। এখন তাদের সামনে আর কোনো বিকল্প নেই বলেই কী তারা নিরুপায় হয়তো তাই। ভুলটা তারা করতে শুরু করে ২০১১ সালে শাসনতন্ত্রে কালো হাত বাড়িয়ে। পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নাকচ করে দিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে তারা যে সংকটের সূচনা করে সেই সংকট থেকেই উদ্ভব হচ্ছে আরও নতুন নতুন সংকট। এই সংকটের অক্টোপাস থেকে সম্ভবত তাদের মুক্তি নেই। জনগণ থেকে তাদের বিচ্ছিন্নতার ছবি পরিষ্কার। নিশ্চয়ই 'সেলফিতে' নিজেরাও তা দেখছে। তাই বোধ হয় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে- যে জনগণের মাঝে ঠাঁই নেই, সেই জনগণের আবার কীসের অধিকার? যে গণমাধ্যম জনগণের চিন্তা-বিশ্বাস আর আশা ও স্বপ্নের কথাই বলে, সরকারের তোষামোদ করে না সে গণমাধ্যমের আবার কীসের এত স্বাধীনতা? সম্প্রচার নীতিমালার ফাঁসই এদের প্রাপ্য। এটাই হয়তো লীগ সরকারের বিবেচনা।
পঞ্চদশ সংশোধনীর পর সরকারের ওপর জনমত ব্যাপকভাবে বিগড়াতে থাকে। দমনমূলক পন্থা অনুসরণ করে সরকার। মামলা-মোকদ্দমা, জেল-জুলুম, গুলি-হত্যা-সন্ত্রাস চলতে থাকে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে পাঁচটি সিটি নির্বাচনে শাসক লীগের চরম ভরাডুবিতে লিপিবদ্ধ হয়ে যায় সরকারের ভাগ্যলিপি। ভাগ্য বদলের জন্য তারা হাঁটতে থাকে উল্টা পথে। দলীয় ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে গুঁড়িয়ে দেয় বিরোধী দলের নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে গড়ে তোলা আন্দোলন। সরকারের নিপীড়নমূলক কর্মকাণ্ড জনগণ মুখ বুজে সহ্য করে জামায়াতে ইসলামীর তাণ্ডবের কারণে। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াতের কয়েকজন নেতার ফাঁসির দণ্ডের প্রতিবাদে তারা যে সহিংসতা চালায় জনগণ তা সমর্থন করেনি। জামায়াতীদের দলীয় আন্দোলন ও বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের তত্ত্বাবধায়কের আন্দোলন একাকার হয়ে যায়। জামায়াতীদের চালাকি ও কূটকৌশলের কাছে হেরে যায় বিএনপি। বিএনপির জামায়াতপন্থি 'ডানমিয়ারা' ইন্ধন জোগায় জামায়াতকে। তাতে লীগ সরকার রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চালানোর সুযোগটাও পেয়ে যায়। সরকার বিরোধী দলের আন্দোলন নিষ্ঠুরভাবে দমিয়ে দিতে পারলেও জনগণের সমর্থন আদায়ে কিন্তু তারা সফল হয়নি। জনগণের মধ্যে সরকারের অবস্থান যে অতি দুর্বল তা সরকার জানত। দেশি গোয়েন্দা সংস্থার এ সম্পর্কিত প্রতিবেদনের খবর মিডিয়ায়ও এসে গিয়েছিল। তাছাড়া লীগ সরকারের বিদেশি মুরবি্ব রাষ্ট্রের তথ্য-পরামর্শও নিশ্চয়ই ছিল। এটা ধারণা করাই যায় যে, বিদেশি মুরবি্বর পরামর্শেই তারা নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বদলে দেয়। অথচ মিডিয়ায় এসেছিল যে, প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের আগের দিন পর্যন্ত সংবিধান সংশোধন কমিটি তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা রাখার পক্ষে ছিল। কমিটি সভার এ সংক্রান্ত প্রসিডিংসও পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। একজনের হুকুমেই সব বদলে যায়। উচ্চ আদালতের দোহাই বাহানা মাত্র। উচ্চ আদালতও আরও দুই টার্ম তত্ত্বাবধায়ক রাখার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। তারা তা গ্রাহ্য করেনি। নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে ফের ক্ষমতা পাবে না তা লীগ সরকার ও তাদের বিদেশি মুরবি্ব দল জানত। তাই জনগণ, জনমত এসবের কোনো ধার ধারেনি তারা। বিএনপিসহ অন্যান্য কার্যকর বিরোধী দলকে নির্বাচনের বাইরে রাখার সব 'ইঞ্জিনিয়ারিং' সম্পন্ন করে দেশি-বিদেশি জনমতকে উপেক্ষা করেই তারা দশম সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করে। ৫ জানুয়ারি ভোটের আগেই ১৫৩ জন লীগ ও লীগপন্থি 'কুটুম' অটো এমপি হয়ে যান। ৫ তারিখ যে ১৪৭ আসনে লোক দেখানো নির্বাচন হয় বিরোধী দল বলছে তা ছিল একটা প্রহসন। বেগম জিয়া বলছেন ৫ পার্সেন্ট ভোট পড়েছে তাতে। সরকারের 'গৃহপালিত' নির্বাচন কমিশন বলেছে ৪০ পার্সেন্ট। জিন-পরীরা এ ভোট দিয়ে গেল নাকি? অনেক চেষ্টা-তদবির করেও ১৫-১৬ পার্সেন্টের বেশি ভোটার কেন্দ্রে নিতে পেরেছে বলে নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকদের কেউ বলছেন না। ৩০০ আসনে ভাগ করলে সে হার তো ৬-৭ পার্সেন্টই হয়। ৩৯ কেন্দ্রে একটি ভোটও পড়েনি। সেখানে কী কোনো আওয়ামী লীগার নেই অর্থাৎ প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনে প্রকৃত আওয়ামী লীগারদেরও সায় ছিল না। তেমন একটি নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারের নৈতিক ভিত্তি তো দুর্বলই থাকার কথা। সংবিধানের ৬৫ (২) অনুচ্ছেদের প্রসঙ্গ টেনে বিরোধী দল এ সরকারকে অনির্বাচিত অবৈধ বলছে। ওই অনুচ্ছেদে বলা আছে, 'একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকাসমূহ হইতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আইনানুযায়ী নির্বাচিত তিনশত সদস্য লইয়া এবং এই অনুচ্ছেদের (৩) দফায় কার্যকরতাকালে উক্ত দফায় বর্ণিত সদস্যদিগকে (সংরক্ষিত কোটায় মহিলা সদস্য) লইয়া সংসদ গঠিত হইবে, সদস্যগণ সংসদ সদস্য বলিয়া অভিহিত হইবেন।' এই ধারা বিবেচনায় বিএনপিসহ বিরোধী দলের বক্তব্য উড়িয়ে দেওয়া যায় কী? ১৫৩ আসনে কোনো নির্বাচনই হয়নি। ১৪৭ আসনের নির্বাচনও হয়েছে প্রশ্নবিদ্ধ। এই ভোট ও ভোটারবিহীন 'নির্বাচনে' সাব্যস্ত সংসদ সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত(!) হয়েছেন সংরক্ষিত আসনের ৫০ জন নারী। এই সংসদের 'পুষ্টিমান' যে কী পরিমাণ তা বেশি ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের বোধ হয় প্রয়োজন নেই। গণরায়হীন এই সংসদ, গণবিচ্ছিন্ন এই সরকার টিকে থাকার জন্যই সর্বশেষ চেষ্টা হিসেবে বিচারবিভাগ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের বেপরোয়া সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পৃথিবীর দেশে দেশে গণবিচ্ছিন্ন শাসকরা যুগে যুগে তা-ই করেছে। আবার ইতিহাস এই সাক্ষ্যও দিচ্ছে যে, বারবার প্রতিবার তারা পরাস্তও হয়েছে। আখেরে জয় হয়েছে জনগণের। সব জনবিচ্ছিন্ন সরকারই ইতিহাসের এই অমোঘ সত্যটি ভুলে যায় যে, জনগণ কখনো পরাজিত হয় না।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
ই-মেইল : kazi.shiraz@yahoo.com