১.
আমেরিকা বলেছে আইসিসের চেয়েও ভয়ংকর সন্ত্রাসী আছে পৃথিবীতে, ওদের নাম খোরাসান। ওসামা বিন লাদেনের ৩৩ বছর বয়সী ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধা মুহসিন আল ফাদলি খোরাসানের নেতৃত্ব দিচ্ছে। এই মুহসিন আমেরিকার টুইন টাওয়ার আক্রমণের নীল নকশা আগে থেকেই জানতো। সিরিয়ায় যাওয়ার আগে মুহসিন ছিল ইরানে। ইরানের ছোটখাটো আল-কায়দা দলটিকে চালাতো। মুহসিনকে জ্যান্ত ধরতে পারলে সাত মিলিয়ন ডলারের পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিল। ইরান থেকে তার দলের লোকেরা পাকিস্তানে আর সিরিয়ায় পালিয়ে গেছে। সিরিয়ায় আল-কায়দার নুসরা ফ্রন্ট থেকে বেরিয়ে আসা দলটিই খোরাসান।
এই খোরাসানগুলোর টার্গেট শুরু থেকেই ইওরোপ আর আমেরিকা। আইসিসের চেয়েও বর্বর যে কেউ থাকতে পারে পৃথিবীতে, তা আমার দুঃস্বপ্নের মধ্যেও ছিল না। খোরাসানদের নিশ্চয়ই পারমাণবিক বোমা নেই, নৌবাহিনী নেই, বিমান বাহিনী নেই, আধুনিক সব অস্ত্রশস্ত্র নেই, তবে কী কারণে তারা আইসিসের চেয়েও ভয়ংকর? সম্ভবত এই জন্যই ভয়ংকর যে আইসিস মধ্যপ্রাচ্যে সন্ত্রাস করেই স্বস্তিতে থাকবে কিন্তু খোরাসান নকশা আঁকছে কী করে ইওরোপ আর আমেরিকার মাটিতে সন্ত্রাস করা যায়।
ইওরোপ আর আমেরিকা এখনও পৃথিবীতে একটুখানি জায়গা- যেখানে বর্বরগুলোর সন্ত্রাস থেকে বাঁচার জন্য আশ্রয় নেওয়া যায়। এই নিরাপদ ভূমিটুকুকেও যদি সন্ত্রাসীরা ধ্বংস করে ফেলে, তবে সততা আর সাহস যাদের সম্বল, যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমাজটাকে সভ্য বানাবার চেষ্টা করছি, বিপদে আপদে তাদের আর কোনও জায়গা থাকবে না যাওয়ার। নিরাপত্তার সম্ভবত ছুট্টি হয়ে যাচ্ছে।
২.
না, একেবারে আশার কোনও আলো নেই চারদিকে, এমন বলবো না। কিছু আরব দেশকে সঙ্গে নিয়ে আমেরিকা এখন আইসিস আর আল-কায়দার সন্ত্রাস বন্ধ করার দল বানিয়েছে। এর মধ্যেই সিরিয়ার আলকায়দার ঘাঁটিগুলোয় বোমা ফেলতে শুরু করেছে। এই দুই ভয়ংকর সন্ত্রাসী দলকে অকেজো করতে না পারলে এরা আমাদের পৃথিবীকে নিশ্চিতই একটা হত্যা আর হিংসার পৃথিবী বানিয়ে ফেলবে।
অনেকের মতো আমিও ইরাকে আর আফগানিস্তানে আমেরিকার বোমা ফেলা সমর্থন করিনি। ইরাকের এই ছিন্নভিন্ন অবস্থার জন্য আমি আমেরিকাকে দায়ী করি। আমেরিকার বিদেশ নীতিতে প্রচুর ভুল। এই নীতির শিকার অনেক দেশ, অনেক মানুষ। আমেরিকার বিদেশ নীতির প্রতিবাদ সবসময়ই আমি করি। কিন্তু আইসিস আর আল-কায়দার বিরুদ্ধে আমেরিকার আক্রমণকে আমি একশ ভাগ সমর্থন জানাচ্ছি।
অনেকে বলে আমেরিকা ইরাকের যে সর্বনাশ করেছে, মধ্যপ্রাচ্য সমস্যায় তাদের একেবারেই নাক গলানো উচিত নয়, আরব দেশগুলোই করবে যা করার, আরব দেশের সমস্যা আরব দেশই সমাধান করবে, আইসিস আর আল-কায়দার বিরুদ্ধে যুদ্ধ আরব দেশই করবে। শুনতে চমৎকার। কিন্তু আইসিস আর আল-কায়দা শুধু আরব দেশের সমস্যা নয়, ওরা সারা পৃথিবীর সমস্যা। ওরা সারা পৃথিবীকে নিজেদের সাম্রাজ্য বানাতে চায়, সারা পৃথিবীর প্রতিপক্ষদের নিশ্চিহ্ন করতে চায়। ওদের দুষ্ট দূষিত আইডিওলজি দ্বারা মুসলিম যুব-সমাজের মগজধোলাই হচ্ছে প্রতিদিন। ওরা সারা পৃথিবীর জন্য খুব বড় এক হুমকি। আরব দেশকে দায়িত্ব দেওয়া হলে তারা কিছুই করবে না এই সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে। আরব দেশের মৌলবাদীরাই আইসিস আর আল-কায়দাকে টাকা-পয়সা আর সঙ্গী-সমর্থন দিয়ে বাঁচিয়ে রাখছে। অনেকে এও বলে, আমেরিকা ইরাকে আর আফগানিস্তানে বোমা ফেলেছিল বলে ব্যাকল্যাশ হয়েছে, সারা পৃথিবীতেই মুসলমানরা দলে দলে মৌলবাদী হয়েছে আর জঙ্গি হয়েছে, সুতরাং আইসিসকে খতম করার জন্য ফের যদি বোমা ফেলে আমেরিকা, তবে ফের পৃথিবী জুড়ে আইসিসপন্থীদের সংখ্যা বাড়বে।
আমি এই যুক্তি মানি না। যদি আইসিস গলা কাটতেই থাকে মানুষের, যেভাবে কাটছে; ইউটিউবের মাধ্যমে যদি মুণ্ডু কাটার কীর্তিকলাপ দেখাতেই থাকে, যেভাবে দেখাচ্ছে; সারা পৃথিবী থেকে মানুষ যদি যোগ দিতে থাকে আইসিসে, যেভাবে দিচ্ছে, তাহলেই যথেষ্ট। তাহলেই আইসিসপন্থীদের জন্ম রোধ করার শক্তি কারও থাকবে না। দিকে দিকে তো আইসিসপন্থী গজাচ্ছিলই, আমেরিকার মাথায় আইসিস ধ্বংসের চিন্তা আসার অনেক আগে থেকেই। যতদিন ধর্ম আছে, ততদিন কিছু মানুষ একে ব্যবহার করবেই নিজেদের ব্যবসায়িক এবং রাজনৈতিক স্বার্থে। আমেরিকা নাক গলাক বা না গলাক। বোমা ফেলুক বা না ফেলুক।
৩.
আল-কায়দার নুসরা ফ্রন্টের বাংলা-শাখা থেকে একজন আমাকে টুইট করেছিল কিছুদিন আগে, যেহেতু আমি লিখেছিলাম আইসিসদের মেরে ফেলা হলে আমি আপত্তি করবো না। কয়েকটি কাটা মুণ্ডুর ছবি পাঠিয়ে আমাকে বলেছিল, ‘অপেক্ষা করো যদ্দিন না তোমার মুণ্ডু কাটা হচ্ছে’। ওই টুইট দেখে আমি সত্যিই ভয় পেয়ে গেছিলাম। ওরা না করতে পারে, হেন জিনিস দুনিয়ায় নেই। আমি তখনও জানি না যে এই নুসরা ফ্রন্ট বড় ভয়ংকর, এদেরই আন্তর্জাতিক শাখাটির নাম খোরাসান, যে শাখাটিকে আমেরিকা মনে করছে আইসিসের চেয়ে বীভৎস।
মুণ্ডু কাটার ছবি অনেকের পক্ষে দেখা সম্ভব নয়। আমি কিন্তু দেখেছি বেশ কিছু। দেখেছি কী করে ওরা মানুষের গলায় ছুরি বসাচ্ছে। দেখেছি কী করে সারি বেঁধে মানুষকে হাঁটু গেড়ে বসিয়েছে, আর মাথায় গুলি করেছে। গলায় হাত বুলোতে বুলোতে আমি প্রায়ই বলি, তার চেয়ে মাথায় গুলি করো, ঢের ভালো। জবাই হওয়াটা কিছুতেই চাই না। আমি অনুভব করি যাদের জবাই করা হয়েছে তাদের কী রকম লেগেছিল যখন জবাই হচ্ছিল।
৪.
আইসিস আর আল-কায়দার মধ্যে পার্থক্য হলো, আইসিসের মতো আল-কায়দা মুণ্ডু কাটার ভিডিও ইউটিউব বা টুইটারের মাধ্যমে সারা বিশ্বকে দেখায় না। যে আমেরিকা গণতন্ত্র আর মানবাধিকারের কথা বলে বেড়াচ্ছে, সেই আমেরিকা কী করে সৌদি আরবকে বন্ধু বলে মানতে পারে, যে সৌদি আরবে গণতন্ত্র আর মানবাধিকারের চিহ্ন বলতে কিছু নেই? আর, সৌদি আরবই যদি আইসিসকে ফাণ্ড দিচ্ছে, তবে আইসিস নিধনে আমেরিকাকে সৌদি আরব কেন সহযোগিতা করছে? জানি অনেক হিসেব মিলবে না। রাজনীতির হিসেব অনেক সময় আমাদের মতো নিরীহ সুবুদ্ধির মানুষ মেলাতে পারে না। আমাদের মতো নিরীহ সুবুদ্ধির মানুষ আপাতত যেটা চাইছি সেটা হলো সন্ত্রাসমুক্ত পৃথিবী। আমেরিকা সন্ত্রাসের রাজা! তা মানি, ভুল কাজ অনেক করে আমেরিকা, মাঝে মাঝে কিন্তু সঠিক কাজও করে। সন্ত্রাস করে, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধও করে। আমেরিকা এ পর্যন্ত পৃথিবীর কোনও বড় সন্ত্রাসী গোষ্ঠিকে নির্বংশ করতে পারেনি, ঠিক। কিন্তু চেষ্টা তো করেছে। তাদের এই আইসিস আল-কায়দা নিধনের চেষ্টায় আমি তাই অভিনন্দন জানাই। লেখক : নির্বাসিত লেখিকা
শিরোনাম
- রোম সফর শেষে দেশের পথে প্রধান উপদেষ্টা
- চট্টগ্রামে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে কানাডার সহযোগিতা চাইলেন মেয়র
- চট্টগ্রামে ইয়াবা মামলায় সাজা: পাঁচ বছর কারাদণ্ড
- চট্টগ্রামে প্রকাশ্যে ছুরিকাঘাতে ছাত্রদল নেতা নিহত
- সততার সাহস : ভুল স্বীকারের মর্যাদা
- লক্ষ্মীপুরে মাদ্রাসার ছাত্র অপহরণ, পাঁচ দিনেও মেলেনি খোঁজ
- কুয়াকাটায় শৈবাল চাষ নিয়ে কর্মশালা
- ২০০ রানে হেরে আফগানিস্তানের বিপক্ষে হোয়াইটওয়াশ বাংলাদেশ
- মালয়েশিয়ায় ভূমিধসে প্রাণ গেল বাংলাদেশি শ্রমিকের
- টাইমের প্রচ্ছদে নিজের চুল ‘গায়েব’ দেখে ক্ষুব্ধ ট্রাম্প
- মিরপুরে অগ্নিকাণ্ড: নিহত ১৬ জনের মরদেহ ঢামেক মর্গে
- হোয়াইটওয়াশ এড়াতে বাংলাদেশের প্রয়োজন ২৯৪
- থাইল্যান্ডে মাদকসহ চার ইসরায়েলি সেনা গ্রেফতার
- অগ্নিদুর্ঘটনায় ১৬ জনের মৃত্যুতে তারেক রহমানের শোক
- অক্টোবরের ১৩ দিনে এলো ১২৭ কোটি ডলার রেমিট্যান্স
- মিসরে গাজা শান্তি সম্মেলন: দুই প্রেসিডেন্টের গোপন আলাপ ফাঁস
- মিরপুরে অগ্নিকাণ্ড : আলামত সংগ্রহ করছে সিআইডি
- মেক্সিকোর অর্ধশতাধিক রাজনীতিকের ভিসা বাতিল করল যুক্তরাষ্ট্র
- গাজার সব সীমান্ত খুলে দেওয়ার আহ্বান জাতিসংঘ ও রেড ক্রসের
- ৪৫ ফিলিস্তিনির মরদেহ পাঠাল ইসরায়েল
আমেরিকা, আইসিস আর আলকায়দা
তসলিমা নাসরিন
অনলাইন ভার্সন

এই বিভাগের আরও খবর
সর্বশেষ খবর