১৯৯৩ সালে আমার কাছে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির কিছু মেয়ে আসতো। ফ্যাক্টরিতে মেয়েদের টাকা-পয়সায় ঠকানো, মেয়েদের বেতন কম দেওয়া, বড় পদে মেয়েদের নিয়োগ না করা, ম্যাটারনিটি লিভ না দেওয়া, অসুখ-বিসুখে ছুটি না দেওয়া, যৌন হয়রানির শিকার করা, ওভারটাইম করতে বাধ্য করা, রাতবিরেতে ট্রান্সপোর্ট না দেওয়া ইত্যাদি অনেক অভিযোগ করতো। আজ ২৩ বছর পর গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির খবর নিয়ে দেখি, আগের সেই অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। মেয়েরা আগের মতোই দারিদ্র্যের শিকার, আগের মতোই মেয়ে হওয়ার কারণে কাজটা বেশি করতে হয়, বেতনটা কম পেতে হয়, আগের মতোই তারা যৌন হয়রানির শিকার। আর মাঝে মাঝে তো আমরা দেখিই কী করে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিগুলোয় আগুন লাগছে আর পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে ফ্যাক্টরির ভেতর আটকে পড়া শত শত বস্ত্র-বালিকা।
১৯৭৬ সালে বাংলাদেশে প্রথম গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির শুরু, নব্বই দশকে হৈহৈ করে এর বাণিজ্য গেল বেড়ে। আজ যা কিছুই দেশ থেকে রপ্তানি করা হয়, তার মধ্যে আশি ভাগই গার্মেন্টস। তিরিশ লক্ষের চেয়েও বেশি গার্মেন্টস শ্রমিকদের ৮৫ ভাগই মেয়ে। সভ্য হলে এই দেশ এই মেয়েদের মাথায় তুলে রাখতো। বাংলাদেশ বলেই এদের কী করে আরও ঠকানো যায়, কী করে আন্তর্জাতিক শ্রমিক আইন লঙ্ঘন করে এদের নির্যাতন করা যায়, কী করে মেশিন হিসেবে কিন্তু মানুষ হিসেবে বিচার করা না যায়, জাতিসংঘের সব রকম বৈষম্য থেকে নারীর মুক্তির আহ্বানকে তুচ্ছ করে নারীকে বৈষম্যের শিকার করে রাখা যায়- এসবে বাংলাদেশের পুরুষতন্ত্র বিষমই দক্ষ।
গার্মেন্টসে মেয়ে-শ্রমিক নেওয়ার পেছনে মেয়েদের প্রতি শ্রদ্ধা ভালোবাসা নয়, যা কাজ করে তা হলো মেয়েদের 'সস্তা মাল' বলে ভাবার মানসিকতা। সস্তা মাল সস্তায় মেলে। সস্তা মালের দেখভাল করার দরকার হয় না। সস্তা মাল কী খাবে কী পরবে তা না ভাবলেও চলে। সস্তা মাল দুঃখ-কষ্ট সইতে পারে। সস্তা মাল ডিমান্ড করে না। সস্তা মালের কাছ থেকে শ্রম আদায় করে নাও। সস্তা মালকে মারো ধরো, মুখ খুলবে না। সস্তা মালরা মরে গেলেও কারও কিছু যায় আসে না।
একই কাজ করে একটা পুরুষ পারিশ্রমিক পায় বেশি, একটা মেয়ে পায় কম। এই সমস্যা শুধু বাংলাদেশে নয়, এই সমস্যা সারা পৃথিবীতে। মেয়েদের যে কম বেতন দেওয়া হয়, তার কারণ, 'জেন্ডার স্টেরিওটাইপ'। জেন্ডার স্টেরিওটাইপের বাংলা কী আমি জানি না, তবে জেন্ডার স্টেরিওটাইপ মানে কোন লিঙ্গ কী চরিত্রের তার সম্পর্কে কিছু বদ্ধমূল আর ভুলভাল বাঁধাধরা ধারণা। মেয়েদের সম্পর্কে পুঁতিগন্ধময় বিশ্বাস, যে বিশ্বাস সহজে মন থেকে দূর করা যায় না।
জেন্ডার স্টেরিওটাইপ হলো, মেয়েদের টাকা পয়সা উপার্জনের খুব একটা দরকার নেই কারণ স্বামীর উপার্জনেই সংসার চলে; মেয়েদের বেতন পুরুষের বেতনের সমান হওয়ার দরকার নেই, কারণ পুরুষের মতো মেয়েদের অত দায়িত্ব নিতে হয় না; মেয়েদের বেতনটা স্বামীর বেতনের বাইরে শুধুই খানিকটা বাড়তি টাকা পয়সা; মেয়েরা ঘরের বাইরে কাজ না করলেও চলে, কিন্তু স্বামীকে কাজ করতেই হবে; মেয়েরা উঁচুপদে চাকরি করতে পারবে না, কারণ মেয়েরা ঝুটঝামেলা সামলাতে পারবে না, কঠিন হতে পারবে না, সিদ্ধান্ত নেওয়ায় পারদর্শী নয়, তাছাড়া মেয়েরা উচ্চাকাঙ্ক্ষী নয়, আত্দবিশ্বাসী নয়, তার ওপর আবার মেয়েদের বাচ্চা লালন পালনের ব্যাপার থাকে; মেয়েরা হিসেবে কাঁচা, বুদ্ধিতে-বিচক্ষণতায় কাঁচা, প্রয়োজনে ভ্রমণ করতে পারবে না, রাতে চলাফেরা করতে পারবে না; মেয়েরা সেবাযত্ন করায় দক্ষ, পুরুষেরা দায়িত্ব নেওয়ায় দক্ষ; মেয়েরা মা হতে চায়, দীর্ঘকাল চাকরি-বাকরি করতে চায় না; সন্তানের দেখভাল করতে হয় বলে মেয়েরা চাকরিতে মনোযোগ দিতে পারে না। দক্ষ মেয়েদেরও শুধু মেয়ে হওয়ার কারণে উঁচু পদে কাজ করতে দেওয়া হয় না। লিঙ্গ বৈষম্য সবখানে, ঘরে বাইরে, অফিসে আদালতে। মেয়েদের চাকরি পাওয়াটা সহজ নয় কিন্তু চাকরি হারানোটা সহজ। জগৎ বদলাচ্ছে, মেয়েরাই অনেক সময় সংসার চালায় একা, স্বামী-সন্তানের ভরণ পোষণও করে। তারপরও মেয়ে বলেই তারা দায়িত্বজ্ঞানহীন হিসেবে চিহ্নিত হয়। মেয়েরা অঙ্ক কম জানে, বিজ্ঞান কম বোঝে, এরকম ধারণাও ঢুকে আছে মানুষের মনে ও মস্তিষ্কে। কোনও রকম প্রমাণ ছাড়াই মেয়েদের সম্পর্কে নেতিবাচক কিছু বিশ্বাস সেই কত সহস্র বছর আগে ঢুকেছে মানুষের মধ্যে, তা থেকে মুক্তি আজও মানুষের নেই। এই ধারণাগুলোর জন্যও মেয়েরা কোনও কাজে পারদর্শী হয়েও যোগ্য পদ বা সম্মান পায় না। মেয়েদের সম্পদ মেয়েদের শরীর, এই বিশ্বাসও শেকড় গেড়ে বসা। সে কারণে, মেয়েদের শরীরটার দিকেই চোখ পড়ে মানুষের। মেয়েরা কতটা জানে, কতটা বোঝে, কতটা দক্ষ, সেটা কেউ জানতে চায় না, মেয়েদের গুণের দিকটা গৌণ হয়ে ওঠে। মেয়েদের যৌন সামগ্রী হিসেবে দেখা হয় বলে মেয়েদের মধ্যে যাদের বয়স অল্প, যারা দেখতে সুন্দর, কিছু কিছু চাকরি পেতে তাদের অসুবিধে হয় না। বিভিন্ন চাকরিতে, বিশেষ করে শো-বিজনেসের চাকরিতে আমরা কাস্টিং কাউচের গল্প শুনেছি। মেয়েদের ব্যবহার করা হয় নিজের যৌন স্বার্থে। প্রায় মেয়েই কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। যে দেশে মেয়েদের অধিকার এবং স্বাধীনতা যত কম, সে দেশে মেয়েদের যৌন হয়রানির হার তত বেশি।
সবার আগে এই নারীবিদ্বেষী বিশ্বাসগুলোকে বিনাশ করতে হবে। এসবের বিনাশ না হলে এসব বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে যে লিঙ্গ বৈষম্য গড়ে উঠেছে, সেই লিঙ্গ বৈষম্যকে বিনাশ করা সম্ভব নয়। অসুখ দূর করতে হলে অসুখের কারণ দূর করতে হয়, তা না হলে অসুখ সারে না।
পৃথিবীর জনশক্তির অর্ধেক নারী। এই অর্ধেক জনশক্তিকে যদি দুর্বল বলে ভাবা হয়, ছলেবলে কৌশলে যদি তাদের পারদর্শিতা দেখানোর সুযোগ কেড়ে নেওয়া হয়, যদি তাদের শোষণ করা হয়, নির্যাতন করা হয়, যদি তাদের কাজকে কাজ বলে না ভাবা হয়, উপার্জনকে উপার্জন বলে না ধরা হয়, যদি তাদের যোগ্য সম্মান তাদের না দেওয়া হয়, তাদের সমতা আর সমানাধিকারকে গুরুত্ব না দেওয়া হয়, দায়িত্ববান, কর্মঠ, নিষ্ঠ, জ্ঞানী, বুদ্ধিমতী ও দক্ষ হওয়ার পরও যদি তাদের তা না ভাবা হয়, শুধু মেয়ে বলেই না ভাবা হয়, তবে এই লজ্জা সম্পূর্ণই এই দুর্ভাগা জাতির! মেয়ে বলেই যদি তাদের হাঁড়ি ঠেলার, রাঁধা বাড়ার, সন্তান উৎপাদন আর লালন পালন করার বস্তু, আর আবেগের পিণ্ড বলে ভাবা হয়, মেয়ে বলেই তাদের কিছু কম বুদ্ধির, কিছু কম যুক্তির, কিছু কম সম্মানের, কিছু কম মর্যাদার, কিছু কম মানুষ বলে ভাবা হয় এবং সেই ভাবনা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে যদি না পারে, তবে সেই সমাজের, সেই দেশের লোকেরা মেয়েদের জ্ঞান বুদ্ধি পাওয়ার যোগ্য নয়। তারা বরং ধীরে ধীরে নিজেদের বিনাশ করার প্রক্রিয়ার দিকে এগোচ্ছে।
লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।