এক এক করে ৩১টি বছর পার হয়ে গেছে। অ্যাডমিরাল মাহবুব আলী খান আমাদের মাঝে নেই। তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। চলে গেছেন বহুদূরের এক না-ফেরার দেশে। পেছনে ফেলে গেছেন তার প্রিয় স্বজনদের- তার প্রিয়তমা স্ত্রী, অতি আদরের দুই কন্যাকে। ফেলে গেছেন তিনি বন্ধু, সহকর্মী ও সহযোদ্ধাদের, আর ফেলে গেছেন অগণিত শুভানুধ্যায়ী, সুহৃদ, গুণগ্রাহী ও গুণমুগ্ধদের। অ্যাডমিরাল এম এ খানের ছিল ঘটনার ঘনঘটার বৈচিত্র্যে কর্মবহুল এক বর্ণাঢ্য বিস্তৃত জীবন। ক্যারিয়ারে তাকে অনেক চড়াই-উতরাই পার হতে হয়েছে, অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে। গভীর আত্দপ্রত্যয়ী কর্মনিষ্ঠ ও সাহসী মাহবুব আলী সামনে এগিয়ে গেছেন, কখনো থেমে থাকেননি, পিছে তাকাননি। মেধা, শ্রম ও মনোবল সম্বল করে তিনি সংগ্রাম করে গেছেন। অর্জন ধরা দিয়েছে। সাফল্য পা ছুঁয়েছে।
আসামে শিক্ষা-দীক্ষা-সংস্কৃতি সমৃদ্ধ সুপ্রসিদ্ধ ঐতিহ্যবাহী এক পরিবারে জন্ম নেওয়া মাহবুব আলী একটি বিদগ্ধ পরিশীলিত উৎকৃষ্ট পরিবেশে লালিত হয়েছেন, বড় হয়েছেন। তার পরিবার রাজনৈতিক এক বুনিয়াদি পরিবার। পিতা ব্যারিস্টার আহমদ আলী খান, নিখিল ভারত আইন পরিষদের সদস্য (এমএলএ) ছিলেন। ছিলেন আসাম কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট। হায়দরাবাদ নিজামের প্রধান আইন উপদেষ্টাও ছিলেন। পিতামহ খান বাহাদুর আজদার আলী খান ছিলেন তৎকালীন ভারতের প্রথম মুসলিম চিকিৎসাবিদ ও একজন প্রখ্যাত অধ্যাপক। কিন্তু মাহবুব আলী পরিবারের পরিচিত চিহ্নিত পথে হাঁটতে চাননি। তিনি পারিবারিক ঐতিহ্যের বাইরে গিয়ে দুঃসাহসিকতার এক ভিন্ন জীবন বেছে নেন। তিনি ঠিকানা গড়তে চান, ঘর বাঁধতে চান সাগরে। সাগর তাকে হাতছানি দেয়, সাগরের কল্লোল তাকে গান শোনায়। সাগরের নীল জলের দিগন্ত বিস্তার, সৈকতের বালুরাশি, উত্তাল তরঙ্গ, জোয়ার-ভাটার খেলা তাকে আকৃষ্ট করে। ছোটবেলায় জুলভার্নের Twenty Thousand’s Leagues under the Sea মাহবুব আলীকে এক রহস্য জগতের সন্ধান দেয়।
তারুণ্যোজ্জ্বল মাহবুব আলী পাকিস্তান নৌবাহিনীতে যোগদান করেন। তিনি নৌ ক্যাডেট হিসেবে কৃতিত্ব অর্জন করেন। উচ্চতর প্রশিক্ষণে যুক্তরাজ্যের ডারমাউথে রয়েল নেভাল কলেজে প্রেরিত হলে সেখান থেকে গ্র্যাজুয়েশন লাভ করেন এবং কৃতী নেভাল অফিসার হিসেবে যুক্তরাজ্যের মহামান্য রানী, রানী এলিজাবেথ কর্তৃক পুরস্কৃত হন। পাকিস্তান নেভাল স্টাফ কলেজ থেকেও তিনি স্নাতক করেন।
আমার সুযোগ হয়েছিল ষাটের দশকে পাকিস্তানে লে. কমান্ডার মাহবুব আলীর সঙ্গে পরিচিত হওয়ার। দীর্ঘদেহী, সুঠাম, সুদর্শন মাহবুব আলী তখন নৌবাহিনীর একজন চৌকস বাঙালি অফিসার। সেনাবাহিনীর একজন মেজর পদের সমমর্যাদায় লে. কমান্ডার। তুষারশুভ্র নৌ ইউনিফর্মে তাকে দৃষ্টি কেড়ে নেওয়া আরও চৌকস দেখাত। আমি তখন পাকিস্তান নেভি এমইএসে এজিই হিসেবে করাচিতে নিয়োগ পেয়েছি। করাচিতে সম্ভ্রান্ত আবাসিক এলাকা পিইসিএইচএসে আমার বাসা। পাশের বাসাটি ছিল লে. কমান্ডার মাহবুব আলী খানের। অ্যাডমিরাল খানকে গভীরভাবে চেনার ও জানার সুযোগ পাই যখন তিনি নৌবাহিনী প্রধান। আমি ১৯৮০ থেকে ১৯৮৪ পর্যন্ত বেইজিংয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসে প্রথম সামরিক অ্যাটাশি হিসেবে নিয়োজিত ছিলাম। তিনি তার নৌবাহিনী প্রধানের সময় প্রতি বছরই চীন সফরে এসেছিলেন। চীনের নৌঘাঁটি, নৌ স্থাপনাগুলো-নির্মাণ কারখানা, শিপইয়ার্ড ইত্যাদি সফর করে বেড়িয়েছেন। চীনা নৌপ্রধান ও অ্যাডমিরালদের সঙ্গে দীর্ঘ দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় বসেছেন। বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে শূন্য থেকে গড়ে তুলতে তাদের উদার সাহায্য ও সহযোগিতা কামনা করেছেন। তিনি প্রায়ই আমাকে যুদ্ধজাহাজ, নৌযান, গোলাবারুদ, নৌ সমরসম্ভার, পাইপলাইনের তথ্য ও খবরাদি জানতে টেলিফোন করতেন এবং নির্দেশনা দিতেন। তাকে আমি দেখেছি একজন দক্ষ টাস্ক মাস্টারের ভূমিকায়। আর আমি মনে করি তিনিও আমাকে দেখেছেন কার্য সম্পাদনে দায়িত্ববান একজন অক্লান্ত সৈনিকের ভূমিকায়।
বাংলাদেশ নৌবাহিনী আজ একটি আধুনিক ত্রৈমাত্রিক নৌবাহিনী। নৌবাহিনীতে নৌবিমান সংযোজিত হয়েছে, সাবমেরিন সংযোজিত হতে যাচ্ছে। বঙ্গোপসাগরে বিশাল যে সমুদ্রাঞ্চল সমুদ্রজয়ে আমাদের অর্জিত হয়েছে তার সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা রক্ষায় ও মূল্যবান সামুুদ্রিক সম্পদ সংরক্ষণে আধুনিক নৌবাহিনীর সুদৃঢ় ভিত্তি নিঃসন্দেহে প্রাজ্ঞ অ্যাডমিরাল এম এ খানই রচনা করে গেছেন। আমার মনে পড়ছে, একবার অ্যাডমিরাল এম এ খান চীন সফরে এক অন্তরঙ্গ পরিবেশে আমাকে বলেছিলেন, 'মাহবুব, তুমি আর্মি থেকে নেভিতে চলে আস। তোমাকে আমার নেভিতে অনেক প্রয়োজন। আমি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলাপ করে সম্মতি নিয়ে নেব। তুমি নেভিতে অনেক বেশি কন্ট্রিবিউট করতে পারবে। আমাদের নেভি উপকৃত হবে। সামনের দিনে নেভি অনেক বড় হবে, অনেক শক্তিশালী হবে। অনেক জাতীয় দায়িত্ব তার ওপর বর্তাবে। অনেক স্কোপ আসবে। আমাদের সমুদ্রসীমা স্থলসীমার চেয়ে অনেক বড় হবে। আমি মনে করি নেভিই হবে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সিনিয়র আর্ম। এটা একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ। আমি তা নিতে প্রস্তুত আছি।' আমি বিনয়ের সঙ্গে তার কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করি। আমি গভীরভাবে মুগ্ধ হই, আমার প্রতি তার আস্থা ও ভালোবাসার জন্য।
অ্যাডমিরাল খানের মৃত্যু এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। তার মৃত্যু, সামরিক ভাষায় বলতে হয়,to die with boots on. কর্তব্যরত অবস্থায় ইউনিফর্ম পরিহিত হয়ে মৃত্যু। তিনি তখন যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা। বাংলাদেশ বিমানের একটি যাত্রীবাহী ফোকার ফ্রেন্ডশিপ এফ-২৭ বিমান ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণের মুহূর্তে দুর্ঘটনায় পতিত হয়। একজন প্রমীলা বৈমানিক মৃত্যুবরণ করেন। দায়িত্বনিষ্ঠ কর্মপাগল অ্যাডমিরাল খান বিমানটির উদ্ধারকাজে বিরামহীনভাবে দুর্ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে তদারকি করছিলেন।
দীর্ঘ পরিশ্রমে পরিশ্রান্ত, পরিক্লান্ত অ্যাডমিরাল অসুস্থ হয়ে অকস্মাৎ ভূমিতে পড়ে যান। তাকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে আনা হয়। তিনি ৬ আগস্ট, ১৯৮৪ সালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মাত্র কিছু দিন আগে আমি সামরিক অ্যাটাশির দায়িত্ব শেষ করে চীন থেকে দেশে ফিরেছি। তার মৃত্যুতে আমি গভীর শোকাহত হই। তার নৌবাহিনী প্রধানের পুরো সময় আমি চীনে সামরিক অ্যাটাশির দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলাম, বিধায় তার ও তার অধীন বাহিনীর সঙ্গে আমার একটা গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। আমি তা গর্বভরে তখন উপভোগ করেছি। তার বার বার চীন সফরে তাকে আমি অভ্যর্থনা জানিয়েছি। তার সফরসঙ্গী হয়েছি। গোটা চীনের বিশাল বিস্তৃত সাগরকূলজুড়ে নৌঘাঁটি, নৌ স্থাপনা ঘুরেছি, তার দীর্ঘ শীর্ষ দ্বিপক্ষীয় নৌ আলোচনাগুলোয় অংশ নিয়েছি। সবই আমার দুমর্ূল্য ও দুষ্প্রাপ্য অভিজ্ঞতা, যা কখনো বিস্মৃত হওয়ার নয়। আজ তার একত্রিংশ মৃত্যুবার্ষিকীতে আমার বিনম্র শ্রদ্ধা তাকে জ্ঞাপন করছি। অর্পণ করছি আমার প্রিয় অ্যাডমিরালকে আমার তরবারি সালাম।
লেখক : সাবেক সেনাপ্রধান