ভারতবর্ষের বিভক্তি দেখিনি কিন্তু পাকিস্তান বিভক্তিই শুধু দেখিনি, গর্বের বাংলাদেশ নামক দেশটির জন্মের সঙ্গে আমার দুর্দান্ত অংশগ্রহণও ছিল। এই তো দুই দিন আগেই ছাত্রলীগের এককালীন সাংগঠনিক সম্পাদক, সাধারণ সম্পাদক এবং পরবর্তীতে সভাপতি মনিরুল হক চৌধুরী (মনির ভাই) এসেছিলেন। বললেন, আমার হাতের লেখা সব কাগজ নাকি শহীদ মণি ভাই (শেখ ফজলুল হক মণি) Mountain ব্রিগেডের সঙ্গে বাংলাদেশে যুদ্ধের জন্য প্রবেশের সময় ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর সুরত সিংয়ের মাধ্যমে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামের Archive এ পাঠিয়েছেন। খুব ইচ্ছা হচ্ছে নিজের লেখা চিঠিপত্র এবং দলিলাদি দেখার জন্য। পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের অনেক গল্প শুনেছি বাপ-দাদার কাছ থেকে। এমন কি ঠাকুরমার মুখে। স্কুলের শিক্ষকদের কাছ থেকে। কিন্তু ভারতবর্ষের সঠিক বিভাজন উপমহাদেশের নেতারা করতে পারেননি। ব্রিটিশ কূটনীতির বেড়াজালে এখনো এই উপমহাদেশ জ্বলছে। জ্বলার পেছনের কারণ শুধু ধর্মভিত্তিক বিভাজন। তৎকালীন নেতৃত্বের ব্যর্থতা।
ভারতীয় ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারটির দাবি হিন্দু ধর্মের যতখানি, ততখানিই বৌদ্ধ ধর্মের। তাছাড়া দীর্ঘ শাসনের সুবাদে ইসলাম ধর্মের দাবিও অনেকখানি। ভারতে জৈন ধর্মেরও দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে এবং এখনো তা আছে। খ্রিস্টান, ইহুদি ও পার্সিরা এ উপমহাদেশে বসবাস করেছে। এমনকি এক শক্তিশালী মতবাদ হিসেবে শিখ ধর্মের উদ্ভব হয়। শিখ ধর্ম বিকশিত হয় হিন্দু ও ইসলাম এই উভয় ধর্ম থেকে উপাদান সংগ্রহ করে। (সূত্র : তর্কপ্রিয় ভারতীয়, পৃ. ৫৪) বঞ্চনা, শাসন, শোষণ, নির্যাতনের হাতিয়ার হিসেবে ধর্মকেই এই উপমহাদেশে বিশেষভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। এতে করে ধর্মনিরপেক্ষতার ভিতটি যেমন ভারতে দুর্বল হয়েছে তেমনি বাংলাদেশে '৭৫ থেকে '৯৬ ধর্মীয় আবেগে বঙ্গবন্ধু এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগের ধর্মনিরপেক্ষতা নিঃশেষ হয়ে গেছে।
১৯৪৮-এর পর তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে ছাত্রদের ন্যায্য আন্দোলনেও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ধর্মকে টেনে এনেছে। যে কোনো ন্যায্য দাবির আওয়াজ উঠলেই বলা হতো ভারতের চর বা হিন্দুদের দালালরা এসব সংঘটিত করছে। এই জিকির কিন্তু বেশি দিন টেকেনি। জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগসহ কট্টরপন্থি ইসলামী দলগুলো পাকিস্তানের বিভাজন আটকিয়ে রাখতে পারেনি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকেও তারা ভারতের দালাল বলে বারবার আখ্যায়িত করতে ভুল করেনি। কিন্তু তিনি ছিলেন রাজনীতির দার্শনিক। তার দর্শনকে বাস্তবায়ন করতে সময় লেগেছিল ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত।
আসলে ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তির কার্যকলাপ, সমাজতান্ত্রিক শক্তির চেয়েও আরও অধিক মহাপরাক্রম শক্তি হতে পারে বিধায় সুবিধাভোগী শক্তি সবসময়ই ধর্মের লেবাসকে লেলিয়ে দেয়। সাধারণভাবে বাংলাদেশে ১৯৭০ সালেও যে ধর্মীয় অনুপাতে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানের বিন্যাস নিয়ে চলছিল সে হিসেবে এদেশে কখনো কোনো কল-কারখানা, অফিস-আদালত বন্ধ রাখার প্রয়োজন হতো না। ইচ্ছা করলে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানরা কাজ করলে ঈদপর্বে মুসলিমদের এক মাসের ছুটিও দিতে পারতেন। তেমনি মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানরা একসঙ্গে কাজ করলে পূজায় হিন্দুদের এক মাস ছুটি দেওয়া কোনো ব্যাপার হতো না। এরকম অন্য ধর্মের বেলায়। রাজনীতিতে ধর্মের অনুপ্রবেশে সবসময় সংখ্যালঘুরাই নিষ্পেষিত ও দেশান্তরিত হয়। উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলিম সংখ্যালঘু। ইউরোপ-আমেরিকায় আমরা সবাই এশীয় বা কৃষ্ণ বর্ণীয়। সেখানে দুইপক্ষই সংখ্যালঘু।
১৯৭১ সালের নির্বাচনী প্রচারণায়, বঙ্গবন্ধুর এই ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশে, (অবশ্যই এর আগে দুই স্বৈরশাসক সংবিধানকে হিংস্র নখের ছোবল দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করেছিলেন) খালেদা জিয়া মিরেরসরাইয়ের এক জনসভায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, 'আপনারা কি সন্ধ্যায় মসজিদে আজানের ধ্বনি শুনতে চান, না উলুধ্বনি শুনতে চান, যদি আওয়ামী লীগকে ভোট দেন তাহলে উলুধ্বনি শুনতে হবে, মসজিদে আজান এবং নামাজ নিষিদ্ধ হয়ে যাবে।' আঠারোর্ধ্ব বয়সের কারও এই বক্তব্যে মানসিক বিকৃতি ঘটবে কিনা জানি না, তবে যাদের বয়স (Teen age) ১৩ থেকে ১৭ বা ১৩ বয়সের নিচে, তাদের মনে কি আঘাত পড়বে, ধর্মীয় বিশ্বাস তখন তাদের বিদ্রোহে রূপ নেবে এটা শতভাগ নিশ্চিত। একটা শিশু হয়তো ভাববে, মসজিদটা কি হিন্দুরা দখল করে নেবে। একই সঙ্গে ওই শিশুটির হিন্দুদের প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা জমবে, যা তার মনে দীর্ঘদিন স্থায়ীভাবে থাকবে। এরকম অনেক বক্তব্য, যাতে শুধু সাম্প্রদায়িক উসকানিই ছিল, যা তখন তার মুখ থেকে নিঃসরিত হয়েছিল। সত্যিকার মানুষ কখনো ধর্ম নিয়ে এরকম কথা বলতে পারেন না, অথচ তাকে রাষ্ট্রনায়ক হতে হয়েছে।
ষাটের দশকে আমরা যখন স্কুলে পড়তাম, তখন আমাদের আরবির শিক্ষক (ইসলাম ধর্ম পড়াতেন) যিনি আমাদের প্রধান শিক্ষক আবদুল কাদির মজুমদার স্যারের বড় ভাই জনাব এলাহী বঙ্ মজুমদার বাংলার শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে মাঝে মাঝে বাংলাও পড়াতেন। আমাদের বাংলার শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামের কবিতা পড়াতে গিয়ে হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে কী পার্থক্য তা বুঝাতে গিয়ে এক চমৎকার উদাহরণ দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, প্রাণ গোপাল দত্ত আর খালেক মজুমদার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আসলেও আমরা ছিলাম হরিহর আত্মা। তার উদাহরণটা হলো, প্রাণ গোপাল যদি মজুমদার বাড়িতে জন্ম নিত তাহলে তার নাম হতো খালেক বা মালেক এ জাতীয় কিছু, আর খালেক যদি ডাক্তার বাড়িতে (দত্তবাড়িতে) জন্ম নিত তাহলে তার নাম হতো গোপাল বা রাখাল এমন কিছু। আসলে সবাইকে এক স্রষ্টাই সৃষ্টি করেছেন। হিন্দু ধর্ম বিশ্বাসী মায়ের পেট থেকে আসা ছেলেটার নাম হয়ে থাকে হিন্দু সংস্কৃতিতে, তেমনি মুসলিম মায়ের গর্ভ থেকে বেরিয়ে আসা ছেলেটির নাম হয় মুসলিম সংস্কৃতির। সব শিশুর উৎপত্তি এক মায়ের গর্ভ থেকে। এ ছাড়া আর কোনো পার্থক্য নেই। সব ধর্মের মূল কথা একই। কোনো ধর্ম মিথ্যা বলতে দেয়নি, অন্যের অপকারও প্রশ্রয় দেয়নি। শারীরিক গঠনেও কোনো পার্থক্য নেই। আমার এখনো মনে হয় কী সুন্দর ব্যাখ্যা। আসলে এভাবেই ব্যাখ্যা হওয়া উচিত।
অনুরূপ আরেকটি ঘটনা ঘটল ১৯৮৮ সালে ২৪ জানুয়ারি লালদীঘি ময়দানে শেখ হাসিনার জনসভায় পুলিশ এবং তৎকালীন সরকারের লালিত সন্ত্রাসীদের গুলিতে ২৪ জনের মতো যুবককে প্রাণ দিতে হয় যাদের মধ্যে বেশ কিছু ছিল হিন্দু যুবক, যারা ছাত্রলীগ করতেন। সেটা এরশাদ আমলের ঘটনা। অধ্যাপক এম এ মতিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। যিনি অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন চিকিৎসাবিদ্যার, বিলেত থেকে এফআরসিএস করে প্রতিষ্ঠিত চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ হয়েছিলেন। মেধাবী ছিলেন বলেই, জিয়া-এরশাদ দুই আমলেই দাপটের সঙ্গে চালিয়েছিলেন। এর আগে কখনো কোনো ডাক্তার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতো স্পর্শকাতর মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাননি। ভবিষ্যতে কোনো ডাক্তার পাবেন কিনা, সন্দেহ। ২৪ জানুয়ারি যেহেতু অধিকাংশ শহীদ ছিলেন হিন্দু, তখন তিনি তার বন্ধুমহলে বললেন, এরা ইন্ডিয়ান অনুপ্রবেশকারী। সঙ্গে সঙ্গেই তার এক বন্ধু বললেন, তাহলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ করা উচিত। চালাক-চতুর মানুষটি কেন জিজ্ঞাসা করতেই, জবাব হলো বর্ডার বা সীমান্ত রক্ষার দায়িত্ব স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর। যেহেতু সীমান্ত অতিক্রম করে অনুপ্রবেশকারী এখানে প্রবেশ করেছে, তাই তুমি ব্যর্থ। লজ্জায় তখন কালো মানুষটার মুখটা ছাই বর্ণের হয়ে গেল।
আরেকটি মজার ঘটনা ঘটল ১৯৮৯ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়। তখনো লে. জে. হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সাহেবের শাসনকাল। প্রশাসন বা সরকার যে এখানে প্রত্যক্ষভাবে মদদ দিয়ে ঘটিয়েছিল, তার প্রমাণ হলো : দাঙ্গা শুরু হওয়ার দুই ঘণ্টা আগে পুলিশ চট্টগ্রামের বড় বড় মন্দিরের পুরোহিতদের নিরাপত্তা দিয়েছিলেন বা নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়েছিলেন। যেমনটি হলো পাহাড়তলীস্থ কৈবল্যধামের ধর্মগুরুকে দামি জিপে করে সরিয়ে নিয়ে পাঁচলাইশ থানায় কর্মরত একজন হিন্দু পুলিশ সেকেন্ড অফিসারের বাসায় নিরাপদে জামাই আদরে রাখা। হয়তোবা এরশাদ সাহেব তা জানতেন না! যখন আমরা প্রার্থনা করি, আমরা আমাদের মানবিক অভিজ্ঞতা, বিশ্বাস এবং বর্ণনাতীত ক্ষমতা (Transcend) দিয়ে বিশ্বাস করি সর্বোপরি এক ঐশ্বরিক শক্তি আছে (divine power) সেটা হতে পারে ঈশ্বর, আল্লাহ বা গড, যে কোনো নামেই থাকতে পারে। এবং এই শক্তিই আমাদের সন্দেহ এবং দুর্দশা দূর করতে পারে। ব্যর্থতা ঘুচাতে পারে, এমন কি সত্যের পথে চালাতে পারে। সুতরাং স্রষ্টা এক এবং অদ্বিতীয় এই মন্ত্র মনে ধারণ করেই ভারতের একাদশতম রাষ্ট্রপতি ড. এ পি জে আবদুল কালাম তার Wings of Fire গ্রন্থের ২৪ পৃষ্ঠায় অসাম্প্রদায়িকতার এক উজ্জ্বল উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। যেখানে 'শিক্ষাজীবন সমাপনান্তে সুফি সাধক হজরত নিজামুদ্দীনের শহর দিলি্লতে একটা ইন্টারভিউ দিয়ে দেরাদুনে Air force-এর পাইলট অফিসার চাকরির জন্য ইন্টারভিউ দিতে যান। ৮টি পদের জন্য ২৫ জন প্রার্থী। বোর্ড সেখানে বুদ্ধিমত্তার চেয়েও ব্যক্তিত্বকে বেশি গুরুত্ব দেন। ফলশ্রুতিতে তিনি নবম স্থান দখল করে চাকরি থেকে ছিটকে পড়েন। তাছাড়াও ওই ইন্টারভিউতে দৈহিক ফিটনেস এবং কথা বলার চাতুর্যতার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। তার ভাষায় “I was excited but nervous, determined but anxious, confident but tense” নবম স্থান দখল করে চাকরি না পেয়ে তিনি খুবই হতাশ হয়ে পড়েন। সেখানে তিনি, কাঠের খড়ম ও সাদাধুতি পরা গৌতমবুদ্ধের মতো দেখতে স্বামীজি সিভানন্দের সাক্ষাৎ নিলেন। জলপাই এবং কালো রংয়ের সৌম্য চেহারার হৃদয়ভেদী দৃষ্টি, শিশুসুলভ হাসি, করুণাময় বাক্য এবং ব্যবহার তাকে বিমোহিত করেছিল। তার ভাষায় মুসলিম নাম তার মনে কোনো রেখাপাত করেনি, কালাম জী কিছু বলার আগেই, স্বামীজি তাকে তার ব্যাখ্যার কারণ জানতে চাইলেন। যখন তিনি বললেন তার দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন এয়ারফোর্সের পাইলট হওয়ার স্বপ্নভঙ্গের কথা।
এবার আমি সত্যিকার একজন ধার্মিক, স্বল্প শিক্ষিত মানবিক গুণাবলীসম্পন্ন একজন মুসলিম প্রাথমিক শিক্ষকের উদাহরণ তুলে ধরছি। তিনি আমার বন্ধু ওমর ফারুকের বাবা। ফারুক পাঁচ ভাই ও এক বোনের সর্বকনিষ্ঠ। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়ার সময় ১৯৬৮-৭০ সালের দিকে সেই-ই ছিল আমার জানি দোস্ত। যদিও সে ছিল ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপের ছাত্র ‘A’ section। আর আমি ছিলাম প্রি মেডিকেল ‘B’ section এ। আমরা বায়োলজি। তার ছিল GTD (Geometrical & Technical Drawing)। অত্যন্ত সুন্দর অাঁকত সে। তার ভীষণ শখ ছিল স্থাপত্য প্রকৌশলী হবে। দুর্ভাগ্যক্রমে সে ১৯৭০ সালে বুয়েটে ভর্তি হতে না পেরে খুবই হতাশ। রাগ করে আর কিছুতেই ভর্তি হয়নি। অনেক অনুরোধ করে বললাম, চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হতে। কিছুতেই সে রাজি হয়নি।
'৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ১৯৭২ সালে সে ভারতে IITতে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেল। মজার ব্যাপার হলো আমি তখন ডাক্তার ১৯৭৭ সালে সে পাস করার পর হঠাৎ করে একদিন আমার হাসপাতালে এসে হাজির। সঙ্গে সুদর্শনা সমবয়সী বা বছর দুয়েকের ছোট দেবযানী শর্মা। পরিচয় পর্বে জানলাম সেও একজন আর্কিটেক্ট। বাবা একই প্রতিষ্ঠানের আর্কিটেক্টের অধ্যাপক। উদ্দেশ্য বাংলাদেশে দুজন বিয়ে করবে। দায়দায়িত্ব আমার ওপর। এবং একই সঙ্গে শুভকাজ সম্পন্ন করার পর কুমিল্লায় তার বাবার কাছে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্বও আমার। যেরকম ভয় পেয়েছিলাম, সেরকম কোনো বিপত্তি ঘটল না। বরং চাচা-চাচী সহজভাবে মেনে নিলেন। দুপুরে খেতে বসে চাচা, চাচিকে বললেন টেবিলে যেন গরুর মাংস না দেওয়া হয়। দেবযানী বলল, আমি ভেজিটেরিয়ান। টেবিলে মাংস থাকলে কোনো আপত্তি নেই। চাচা জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার আর কয় ভাইবোন আছে? জবাব, আমি একা। তিনি স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। সপ্তাহখানেকের মধ্যে তিনি প্রফেসর শর্মাকে টেলিফোন করে বাংলাদেশে আসার আমন্ত্রণ জানালেন। যোগাযোগের মাধ্যম আমি। প্রফেসর শর্মা আমার কাছে জানতে চাইলেন তার নিরাপত্তার ব্যাপার। আমি সব দায়িত্ব নিলাম। তিনি সপরিবারে এলেন, পরে কুমিল্লায় নিয়ে আসলাম। খাবার টেবিলে কোনো মাছ-মাংস নেই। শুধু সবজি। চাচা প্রস্তাব দিলেন, আমার ছয়টি সন্তান। ওমর সবার ছোট, জেদি এবং অনেক আদরের আমাদের সবার। আপনার একমাত্র সন্তান দেবযানী। আমার ছেলেকে যদি দেবযানীসহ আপনাকে দিয়ে দেই, আপনি নিতে রাজি আছেন। ওমরের জন্য কোনো আইনি জটিলতা হবে কিনা? ইত্যাদি অনেক প্রশ্ন। চাচার প্রশ্নগুলো শুনে মনে হচ্ছিল, তার হৃদয়টা খান খান হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তিনি তাই করলেন। ওমর দেবযানীরা আহমেদাবাদে সতীশ শর্মার নেতৃত্বে বিরাট স্থাপত্যকর্ম করেছেন। চাচা যতদিন বেঁচেছিলেন প্রায়ই যেতেন। চাচিমা শুরুতে কষ্ট পেয়েছিলেন। চাচার একটা জবাব, তোমার আরও পাঁচজন আছে। তাদের সবেধন নীলমণি এখানে থাকলে কেউ খুশি হতো না।
ধর্মের রাজনীতির সবসময় উদ্দেশ্য ছিল অভিন্ন। ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে অদ্যাবধি। এসব আগ্রাসনের মূলনীতি ছিল লুটপাট, ধ্বংস এবং ধর্ষণ বা নির্যাতন। সর্বশেষ এবং চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল ক্ষমতায় টিকে থাকা। উদ্দেশ্য ছিল জনগণের দৃষ্টি সমস্যা থেকে অন্যত্র সরিয়ে দেওয়া। কবিগুরু ১৯০২ সালে এক প্রবন্ধে লিখেছিলেন, 'ভারতবর্ষের যে ইতিহাস আমরা পড়ি এবং মুখস্থ করিয়া পরীক্ষা দিই, তাহা ভারতবর্ষের নিশীথকালের একটা দুঃস্বপ্ন কাহিনী মাত্র। কোথা হইতে কাহারা আসিল, কাটাকাটি মারামারি পড়িয়া গেল, বাপে-ছেলে, ভাইয়ে-ভাইয়ে সিংহাসন লইয়া টানাটানি চলিতে লাগিল, এক দল যদি বা যায়, কোথা হইতে আর একদল উঠিয়া পড়ে। পাঠান, মোগল, পর্তুগিজ-ফরাসি-ইংরেজ সকলে মিলিয়া এই স্বপ্নকে উত্তরোত্তর জটিল করিয়া তুলিয়াছে।'
ভারতের ইতিহাসের মধ্যে অবশ্যই অনেক দুঃস্বপ্নের উপাদান রয়েছে। কিন্তু এ ছাড়াও রয়েছে সংলাপ ও আলোচনা এবং সাহিত্য, সংগীত, চিত্রকলা, স্থাপত্য, বিচারব্যবস্থা ও আরও বহু সৃজনশীল ক্রিয়াকলাপের ক্ষেত্রে বহু প্রসারিত যৌথ প্রয়াস। এর মধ্যে রয়েছে সেসব পন্থা যা ভিন্নমতাবলম্বীদের শান্তিপূর্ণভাবে পাশাপাশি থাকতে দেয়; সবাই পরস্পরের সঙ্গে অবিশ্রাম মারামারি করে চলে না। এই উপমহাদেশে হিন্দু ও মুসলমানরা বিভিন্নভাবে কত অসংখ্য সাংস্কৃতিক, বৈজ্ঞানিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে একে অপরের সঙ্গে সহযোগিতা করেছেন, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। কত অসংখ্য ঘটনায় একে অপরের সঙ্গে সুখ, দুঃখ, বেদনা ভাগ করে নিয়েছেন।
লেখক : সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।