২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে ছিল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী জনসভা। প্রধান অতিথি ছিলেন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা। মঞ্চ করা হয়েছিল একটি ট্রাকে। জনসভার ছবি তুলতে আমরা কয়েকজন ফটো সাংবাদিক ওই ট্রাকে অবস্থান নিয়েছিলাম।
দলীয় নেতাদের বক্তব্য শেষে প্রধান অতিথির বক্তব্য দিতে দাঁড়ালেন শেখ হাসিনা। আমরা ছবি তুলছি। বক্তব্য প্রায় শেষ পর্যায়ে। তখন আমাদের মধ্যে কেউ কেউ তাকে ‘নেত্রী’, ‘আপা’ সম্বোধন করে সুবিধামতো ভঙ্গিতে ছবি তুলতে মাইক্রোফোনের সামনে ডান বা বাঁ-পাশে ঘুরতে বলছিলাম। তিনি সেভাবে অবস্থান করলেন। ছবি তোলা শেষ। তিনি নেমে যাবেন। তখনো আমাদের মধ্য থেকে কেউ কেউ তাকে আরও কিছু ছবি তুলতে খানিকটা সময় দাঁড়াতে অনুরোধ করেন। আমরা ছবি তুলছি। এমন সময় হঠাৎ বিকট শব্দ। পরপর কয়েকটি বিস্ফোরণ। চারদিকে চিৎকার-চেঁচামেচি। নেত্রী শেখ হাসিনাকে ঘিরে ঢাকা সিটি মেয়র মোহাম্মদ হানিফ, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, কাজী জাফর উল্লাহ মানববর্ম করে রেখেছেন। আর দলের সাধারণ সম্পাদক মো. জিল্লুর রহমান দুই হাতে কান চেপে ধরে মাথা নিচু করে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করছেন। আমার ডান পাশে দাঁড়ানো আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের কপাল থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। সেই রক্তে আমার মুখ ও শার্ট ভিজে যায়। হঠাৎ মনে হলো কী করছি আমি! নিজেকে আগে বাঁচাতে হবে। নেতাদের তৈরি মানব বর্মের নিচে মাথা লুকিয়ে ক্যামেরাটি তুলে ধরে কোনো কিছু না দেখে কেবল শার্টার ক্লিক করে যাচ্ছি। মুহূর্তেই মনে হলো মাথার ওপর মানববর্মের সেই পিরামিডটা আর নেই। আমি একা। উঠে দাঁড়ালাম। ট্রাক থেকে তাড়াহুড়া করে নিচে নেমে পড়লাম। নিচে নেমে যে দৃশ্য চোখে পড়ল তা ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নকেও হার মানায়। এক বিভীষিকাময় পরিবেশ। চারপাশে সারি সারি ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ, দলা-মোচড়ানো অবস্থায় পড়ে আছে। আহত নেতা-কর্মীরা কাঁতরাচ্ছেন মৃত্যু-যন্ত্রণায়। রক্তে ভেসে গেছে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ। আহতদের উদ্ধার করতে বিভিন্ন স্থান থেকে ছুটে আসছে মানুষ। সেই ভয়াল হামলার ধাক্কা পুরোপুরি সামলে উঠতে পারিনি। কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে আছি বলে মনে হচ্ছিল। একটা সময় মনে হলো, আরে আমার তো ছবি তুলতে হবে। দ্রুত একের পর এক ক্লিক করে যাচ্ছি। সামনে পড়ে আছেন আইভি রহমান। তার ছবি তুলে সামনের দিকে এগুচ্ছি আর ক্লিক করে যাচ্ছি। সামনে চোখে পড়ল আওয়ামী লীগের একজন নিবেদিত কর্মী, আমাদের ‘আদাচাচা’। দেয়ালে হেলান দিয়ে রিকশার চাকা ধরে বসে আছেন। মুহূর্তের মধ্যে চোখে চোখ পড়তেই মনে হলো, তিনি যেন কিছু একটা বলতে চাইছেন। আমি তার ছবি তুলছি। সে মুহূর্তে তার চোখের ভাষাটা বুঝেও যেন বুঝতে পারিনি। কারণ, আমি তো ফটো সাংবাদিক। সে মুহূর্তে আমি ছবি তোলার নেশায় বিভোর। ছবি তোলার জন্য হন্যে হয়ে ছুটছি। আদাচাচার চোখের করুণ আকুতি আমাকে আটকাতে পারেনি। ছুটে আসা সাধারণ মানুষ বোমায় আহতদের বাঁচাতে তাদের নিয়ে হাসপাতালে ছুটছে। চারপাশে আহতদের আর্তনাদ, নেতা-কর্মীদের ছোটাছুটি, অজস্র যানবাহনের হর্ন, কোনো কোনোটিতে জ্বলছে আগুন, বিক্ষুব্ধ জনতা গাড়ি ভাঙছে। সবমিলিয়ে এক বিক্ষুব্ধ পরিবেশ। এর মধ্যেই ছবি তুলতে তুলতে এক সময় জিরো পয়েন্টে এসে দাঁড়িয়েছি। শার্ট-প্যান্ট রক্তে ভিজে আছে। এ অবস্থা দেখে সহকর্মীরা অনেকে ভেবেছে আমিও আহত হয়েছি। তারা যখন জিজ্ঞাসা করল আমি আহত হয়েছি কি না তখন যেন আমার সম্বিত ফিরল। শরীরে হাত বুলিয়ে দেখে নিলাম। না, শরীরে আঘাত লাগেনি। ‘আমার কিছু হয়নি’- বলে প্রেসক্লাবে চলে আসি। প্রেসক্লাবে এসে পোশাক বদলে এক সহকর্মীর দেওয়া টি-শার্ট পরে অফিসে যাই। ছবি জমা দিয়ে বাসায় ফিরি। বাসায় ঢুকতেই বউ-বাচ্চা প্রবল আবেগে আমাকে জড়িয়ে ধরে। তাদের শঙ্কা ছিল আমি হয়তো আহত হয়েছি। হাজার প্রশ্ন তাদের। ঘটনার পর থেকেই বিভিন্ন চ্যানেলে সংবাদ প্রচার হচ্ছিল। আমি কাপড়-চোপড় না পাল্টেই খবর দেখতে বসে পড়লাম। ভাবতে লাগলাম কীভাবে সৃষ্টিকর্তা নিজহাতে শেখ হাসিনাসহ আমাদের রক্ষা করেছেন। একটা গ্রেনেড ট্র্যাকের ভেতর পড়লেই আওয়ামী লীগ সভানেত্রীসহ নেতা-কর্মী এবং আমরা যে চার/পাঁচজন ফটো সাংবাদিক ট্রাকে ছিলাম সবাই মারা যেতে পারতাম। সংবাদের এক পর্যায়ে দেখলাম আমাদের সবার প্রিয় সেই আদাচাচা মারা গেছেন। এতক্ষণ নিজেকে সামলালেও সে মুহূর্তে আর সামলাতে পারলাম না। বুক ফেটে কান্না এলো। কান্না দেখে আমার স্ত্রী রুমী সান্ত্বনা দিতে থাকে। সে ভেবেছিল আমি ভয় পেয়েছি। নিজেকে খানিকটা সামলে নিয়ে তাকে আদাচাচার ঘটনা বললাম। আদাচাচার সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের কথা বললাম। আদাচাচার সঙ্গে সব সাংবাদিকের সম্পর্ক ভালো ছিল। সাংবাদিকরাও তাকে খুব ভালোবাসতেন। পার্টিকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসতেন। কোনো জনসভা বা অনুষ্ঠান কাভার করতে আসা সাংবাদিকদের জন্য বাসা থেকে আদা শুকিয়ে আনতেন। খেতে দিতেন সাংবাদিকদের। আমাদের কয়েকজনকে তিনি একটু বেশি ভালোবাসতেন। স্ত্রী রুমী আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে টাওয়াল এনে বলল, গোসল করে এসো। শাওয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছিল। কোনোভাবেই নিজেকে ক্ষমা করতে পারছিলাম না। বার বার মনে হচ্ছিল চাচাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত ছিল। তাহলে হয়তো তিনি প্রাণে বেঁচে যেতেন। আদাচাচার মৃত্যুর ঘটনায় আমি আজও নিজেকে ক্ষমা করতে পারিনি।
শিরোনাম
- জ্বালানি তেলের নতুন দাম নির্ধারণ
- দাবানলে জ্বলছে ইসরায়েল, হন্য হয়ে পালাচ্ছেন বাসিন্দারা
- দেশব্যাপী শব্দদূষণবিরোধী অভিযানে ২৬৫ হাইড্রোলিক হর্ন জব্দ
- তথ্য উপদেষ্টার সঙ্গে তুরস্কের রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাৎ
- পুঁজিবাজারে সূচক কমলেও লেনদেন বেড়েছে
- গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে মৃত্যু নেই, হাসপাতালে ভর্তি ২৯
- দেশের রিজার্ভ বেড়ে ২৭ বিলিয়ন ডলার
- মুহুর্মুহু রকেট হামলায় বিপর্যস্ত মার্কিন রণতরী, বাধ্য হলো পিছু হটতে
- ছাত্রলীগের নির্যাতনের সহযোগী শিক্ষক-কর্মকর্তার বিচারের দাবিতে ঢাবি ছাত্রদলের বিক্ষোভ
- মিরাজের ঘূর্ণিতে তিনদিনেই জিতল বাংলাদেশ
- প্রিপেইড গ্যাস মিটার নিয়ে প্রতারণা এড়াতে তিতাসের সতর্কবার্তা
- শিল্পীদের মেধাসম্পদ সংরক্ষণে কাজ করছে সরকার : শিল্প উপদেষ্টা
- সাবেক প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমেদের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
- ১১৯তম প্রাইজ বন্ডের ড্র, প্রথম বিজয়ী নম্বর ০২৬৪২৫৫
- রাজধানীর উত্তরায় ঢাবির বাসে হামলা, গ্রেফতার ৫
- প্রথম আলোর বিরুদ্ধে মামলার আবেদনকারীকে হুমকির অভিযোগ
- এক ঠিকানায় মিলবে সব ‘নাগরিক সেবা’
- এনসিপি কোনো নির্বাচনি জোটে যাবে না : নাহিদ
- দেশে শ্রমিক সমাজ সবচেয়ে অবহেলিত : রিজভী
- কালকিনিতে হাতকড়াসহ পালানো আসামি গ্রেপ্তার
যেভাবে রক্ষা পেয়েছিলাম
আবু তাহের খোকন
অনলাইন ভার্সন

এই বিভাগের আরও খবর
সর্বশেষ খবর

গোবিপ্রবির এএসভিএম বিভাগের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের অবস্থান কর্মসূচি
৩ মিনিট আগে | দেশগ্রাম

চুয়াডাঙ্গায় সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাস ও সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ
৩২ মিনিট আগে | দেশগ্রাম