গত ২১ আগস্ট বাংলাদেশ প্রতিদিনের শেষের পাতায় ‘একজন বিশ্বজিত্ নন্দীর প্রতিরোধ যুদ্ধের গল্প’ শিরোনামে আমার একটি লেখা ছাপা হয়। লেখাটি ছাপা হওয়ার পর অনলাইনে, অফলাইনে প্রচুর প্রতিক্রিয়া পেয়েছি, প্রতিক্রিয়া ছিল মিশ্র। তার কয়েকটি প্রতিক্রিয়া বেশ চিন্তা উদ্রেককারী। এতদিন পর ইতিহাসের একটি ধুলোপড়া উজ্জ্বল অধ্যায়ের পাতা উল্টানোতে অনেকেই সাধুবাদ জানিয়েছেন। প্রসঙ্গক্রমেই এসেছে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের সেকাল-একাল প্রসঙ্গও। এ বছর বঙ্গবন্ধুর ৪০তম মৃত্যুবার্ষিকী আওয়ামী লীগ ৪০ দিন ধরে পালন করছে। মন্ত্রণালয় বদলের সঙ্গে সঙ্গে যেন বদলে গেছেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলামও। মন্ত্রণালয়ে না হলেও দলে তিনি দারুণ সক্রিয়। আগে সৈয়দ আশরাফের নামে কোনো আমন্ত্রণপত্র এলেও আমরা ধরে নিতাম বেশিরভাগ অনুষ্ঠানে তিনি যাবেন না। এখন পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। তিনি নিয়মিতই কোনো না কোনো অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন এবং সময়মতো। এমনকি কোনো কোনো দিন একাধিক অনুষ্ঠানেও যাচ্ছেন। শুধু যাওয়া নয়, এসব অনুষ্ঠানে তিনি চমত্কার সব বক্তব্যও রাখছেন। গত মাসে এক মতবিনিময় সভায় সৈয়দ আশরাফ বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুবার্ষিকী সার্বজনীনভাবে পালনের আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু সেটা করার ক্ষেত্রে যে সবচেয়ে বড় বাধা আওয়ামী লীগই সেটাও সবচেয়ে ভালো বুঝেছেন সৈয়দ আশরাফই। শোক দিবসের এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, বঙ্গবন্ধু কোনো দলের নন, জাতির পিতা। দলীয় গণ্ডিতে আবদ্ধ করে রেখে আমরাই বঙ্গবন্ধুর প্রতি সবচেয়ে বড় অবিচার করেছি। শোক দিবসের আরেক অনুষ্ঠানে তিনি দলের নেতা-কর্মীদের খাই খাই স্বভাব ছাড়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। এটা ঠিক সৈয়দ আশরাফের নেতৃত্বে শোক দিবসের আয়োজন আগের কয়েক বছরের তুলনায় অনেক নিয়ন্ত্রিত ছিল। ১৫ আগস্ট মাইক বেজেছে, তবে অনেক কম। ব্যানার, পোস্টার, তোরণে হাইব্রিড প্রচারসর্বস্বতা চোখে লেগেছে। শোক দিবসের বিরানির প্যাকেটে বঙ্গবন্ধুর ছবি আর নেতাদের নাম ছিল। কেউ ভাবেনওনি, বিরানি খাওয়ার পর তো সবাই প্যাকেটটা রাস্তায় ছুড়ে ফেলবে, পদদলিত হবে বঙ্গবন্ধুর ছবি। শোকের এ উত্কট আয়োজনে ভাবগাম্ভীর্য থাকে না। বরং সব আয়োজেনেই কেমন একটা উত্সবমুখর পরিবেশ চলে আসে, শোকটা আড়ালে চলে যায়।
আওয়ামী লীগের এক সাংগঠনিক সভায় কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল— শোক দিবস উপলক্ষে যেন কোনোরকম চাঁদাবাজি করা না হয়। কিন্তু সেই নির্দেশ কেউ মেনেছেন বলে মনে হয় না। সারাদেশে শাখা আছে, এমন এক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পদস্থ কর্মকর্তা আমাকে বললেন, শুধু তাদের ঢাকার চারটি শাখাকে ৫৫ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়েছে। সারাদেশের হিসাব এলে অঙ্কটা স্বাভাবিক ভদ্রতার সীমা ছাড়িয়ে যাবে বলেই তার ধারণা। তবে তিনি অসন্তুষ্ট নন। বরং কোনো ঝামেলা ছাড়াই যে ‘খাই খাই স্বভাব’এর নেতাকর্মীদের সন্তুষ্ট করা গেছে তাতেই তিনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন।
বাংলাদেশ প্রতিদিনে আমার লেখা ছাপা হলেই দাউদকান্দি থেকে হাবিব স্যার ফোন করেন। হাবিবুর রহমান গৌরিপুর সুবল আফতাব উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক। শিক্ষকতার পাশাপাশি সাংবাদিকতা করতেন। তিনি তখন দৈনিক ইত্তেফাকের থানা প্রতিনিধি ছিলেন। তখন আমরা ক্লাসরুমে বিস্ময়ের সঙ্গে তাকে দেখতাম। সরাসরি সাংবাদিক সেই প্রথম দেখা। পাশাপাশি তিনি রাজনীতিও করেন। বর্তমানে উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। তিনি ফোন করে লেখার প্রশংসার পাশাপাশি বললেন, হাইব্রিড আওয়ামী লীগারদের কথা একটু বেশি করে লেখ। ৪০ বছর ধরে আওয়ামী লীগ করি। কিন্তু শোক দিবসের অনুষ্ঠানে গেলে বসার জায়গা পাই না। ছেলের বয়সী ছাত্রলীগাররা সব আসন দখল করে বসে থাকে।
ইকবাল সিদ্দিকী আমার ফেসবুক বন্ধু। তিনি গাজীপুরে একটি স্কুল চালান। কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে রাজনীতি করেন। সম্ভবত কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের কোনো পদেও আছেন। তিনি ফেসবুকে আমার লেখার নিচে মন্তব্য করলেন, ‘বিশ্বজিত্ নন্দীকে আমরা বাংলার ক্ষুদিরাম বলি। তার অবদান অনস্বীকার্য। তবে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর যেমন তার নাম উহ্য রেখে স্বাধীনতার ঘোষণা, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস শোনানো হতো; একইভাবে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর নাম উহ্য রেখে এই বয়ান সেই দিনগুলোর কথা মনে করিয়ে দিল। কয়েক বছর আগে প্রথম আলো পত্রিকায় নন্দীদাকে নিয়ে রচিত প্রতিবেদনেও এ প্রবণতা লক্ষ করেছি। ‘কোনো কোনো সাংবাদিক তাকে কাদের সিদ্দিকীর নাম উল্লেখ না করতে অনুরোধ করেছেন।’ এ মন্তব্য নন্দীদার নিজের। বঙ্গবন্ধুর নাম অনুচ্চারিত রেখে জিয়াউর রহমানের মুক্তিযুদ্ধ যেমন জিয়ার মর্যাদা বাড়ায়নি, তেমনি নানান কৌশলে কাদের সিদ্দিকীর নাম বাদ রাখলে নন্দীদার মর্যাদাও বাড়বে না। আমি তার জবাবে বলেছি, ‘কোনো কোনো সাংবাদিক কাদের সিদ্দিকীর নাম বলতে নিষেধ করেছে কিনা জানি না, তবে আমি করিনি। ১৫ আগস্ট এটিএন নিউজের টক শোতে বিশ্বজিত্ নন্দী গর্বের সঙ্গে একাধিকবার কাদের সিদ্দিকীর নাম বলেছেন। আপনি তাকে ফোন করে চেক করতে পারেন। আমি তাকে (বিশ্বজিত্ নন্দী) বলেছি, তার মনের কথা বলতে। লাইভ অনুষ্ঠানে তিনি কথা বলেছেন তার ইচ্ছামতোই। তবে এ লেখায় আমি ব্যক্তি নয়, গল্প বলতে চেয়েছি। তাই বিশ্বজিত্ নন্দীর নামও এসেছে অনেক পরে। তাই এখানে কাদের সিদ্দিকীর নাম আনার সুযোগ ছিল না। এটা সবাই জানেন, ৭৫ পরবর্তী প্রতিরোধ যুদ্ধের মূল নেতা ছিলেন কাদের সিদ্দিকীই।’
তবে সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক প্রতিক্রিয়া পেয়েছি এক আওয়ামী লীগ নেতার কাছ থেকে। ছাত্রলীগের এ সাবেক নেতা বললেন, একসময় ছাত্রলীগের স্লোগান শুরু হতো বিশ্বজিত্ নন্দীর মুক্তির দাবি দিয়ে। সারা দেশে দেয়ালে দেয়ালে উত্কীর্ণ ছিল বিশ্বজিত্ নন্দীর মুক্তির দাবি। তিনি আমাকে প্রশ্ন করলেন, বিশ্বজিত্ নন্দীরা আওয়ামী লীগে নেই কেন? আমি জবাব দিতে পারলাম না। তিনি বললেন, সেটা খুঁজে বের করেন। এ প্রশ্নের জবাব পেলেই ইতিহাসের অনেক বেদনাদায়ক অধ্যায় বিলুপ্ত হবে। তিনি বললেন, শুধু স্লোগান দেওা নয়, মুক্তির পর তো বিশ্বজিত্ নন্দী ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতেই ছিলেন। তারপর চলে গেলেন কেন? তিনি বলেন, বিশ্বজিত্ নন্দীরা আওয়ামী লীগে শেখ হাসিনার সঙ্গে নয়, কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে থাকতে চেয়েছেন। একসময় তারা স্বেচ্ছায় আওয়ামী লীগ ছেড়ে কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে চলে গিয়েছিলেন, দল তো তাদের বহিষ্কার করেনি। আমি বললাম, বিশ্বজিত্ নন্দীরা তো এখন কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গেও নেই। তখন সেই নেতা বললেন, ট্র্যাজেডিটা তো এখানেই। আশির দশকে রাজ্জাক ভাই (প্রয়াত আব্দুর রাজ্জাক) আওয়ামী লীগ ছেড়ে বাকশাল গঠন করেন। তার সঙ্গে আওয়ামী লীগ, বিশেষ করে ছাত্রলীগের একটা মেধাবী অংশ চলে যান। একসময় রাজ্জাক ভাই ফিরে এলেও, তার সঙ্গে যারা গিয়েছিলেন তারা সবাই ফিরে আসেননি বা ফিরে এলেও দলে প্রাপ্য জায়গা পাননি। আর এটা তো স্বাভাবিক, দল তো কারও জন্য জায়গা খালি রেখে অপেক্ষা করবে না। ফলে অভিমানে ছাত্রলীগের একটা মেধাবী প্রজন্ম হারিয়ে যায় রাজনীতির ইতিহাস থেকে। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছে কাদের সিদ্দিকীর ক্ষেত্রেও। এখনকার ভূমিকা যাই হোক, একাত্তর এবং পঁচাত্তরে কাদের সিদ্দিকীর ভূমিকা বীরত্বের। তাই তিনি যখন আওয়ামী লীগ ছেড়ে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ গঠন করেন, তখন বিশ্বজিত্ নন্দীসহ অনেকেই তার সঙ্গে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাদের হতাশ হতে সময় লাগেনি। তারা কাদের সিদ্দিকীর দল ছাড়লেও আর আওয়ামী লীগেও ফিরে আসেননি বা আসতে পারেননি। তাই আওয়ামী লীগের একটি বীর প্রজন্ম না ঘরকা না ঘাটকা হয়ে দিন কাটাচ্ছেন। এটা অবশ্যই বেদনাদায়ক। কিন্তু সেই বেদনার শিকড় সন্ধানটাও জরুরি। সেই শিকড়টা উপড়ে ফেলতে পারলেই ইতিহাসের এ বেদনার অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটবে। বঙ্গবন্ধুপ্রেমীরা যাপন করতে পারবে গৌরবের জীবন, পাবেন তাদের প্রাপ্য মর্যাদা।