১৮ জানুয়ারি, ২০১৬ ১১:৪২

বিচারবিহীন নৈরাজ্য কাউকে রক্ষা করবে না

মইনুল হোসেন

বিচারবিহীন নৈরাজ্য কাউকে রক্ষা করবে না

দেশের প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা গণতন্ত্রের সর্বশেষ ও সবচেয়ে শক্তিশালী রক্ষাকবচকে উচ্ছেদ করার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে সাহসের সঙ্গে সোচ্চার হয়েছেন। গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের শক্তিশালী রক্ষক হিসেবে এর আগেই আইনজীবী ও সাংবাদিকদের কাছ থেকে এ ধরনের সতর্কবাণী উচ্চারিত হওয়া উচিত ছিল।  কিন্তু মনে হচ্ছে তারা যেন অগণতান্ত্রিক দলীয় রাজনীতির কর্মী হিসেবেই সুখে আছেন।

প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা বিচার বিভাগের এখতিয়ার নিয়ে প্রশাসনের নাক গলানো প্রতিহত করার এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও ক্ষমতা সমুন্নত রাখার জন্য আইনজীবী ও বিচারকদের সতর্ক থাকার আবেদন জানিয়েছেন। বিচারকদের অসহায় অবস্থা অত্যন্ত বেদনাদায়ক এবং তার এই আহ্বান যথাযথ বলেই আমরা মনে করি। বিচার বিভাগকে সরকারি কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপের দাসত্ব করতে হলে আইনের শাসন অস্তিত্বহীন এবং গণতন্ত্র অকার্যকর হয়ে পড়ে।

নির্বাচিত দলীয় সরকারকে ক্ষমতায় রেখে নির্বাচন অনুষ্ঠান সমর্থন করে আমাদের সুপ্রিমকোর্ট শুধু গণতন্ত্র নয়, বিচার বিভাগের জন্যও বিপদ ডেকে এনেছে। গণতন্ত্র রক্ষা না করে বিচার বিভাগের মর্যাদা ও স্বাধীনতা রক্ষার কথা বলা যে কতটা অবাস্তব তা এখন সবাই অনুধাবন করছেন। সুপ্রিমকোর্টের রায়ে গণতান্ত্রিক নির্বাচন খতম হয়েছে। পরে শুরু হয়েছে সুপ্রিমকোর্টের ক্ষমতা গ্রাসের প্রক্রিয়া।

প্রধান বিচারপতিকে এ কথাও বুঝতে হবে যে জামিন পাওয়া কঠিন করে এবং পুলিশ রিমান্ডে পাঠানো সহজ করে সুবিচারের নামে চলছে রাজনৈতিক ও পুলিশি নির্যাতন। বিচার ব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থা হ্রাস পাচ্ছে। বিচার বিভাগকে শক্তি অর্জন করতে হলে বিনা বিচারে বন্দী রাখা বা পুলিশের আওতায় নিয়ে নির্যাতন চালানো বন্ধ করতে ভূমিকা রাখতে হবে।

আওয়ামী লীগ অথবা বিএনপি যে দলেরই হোন না কেন, রাজনৈতিক নেতারা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার বিষয়টি ভয়ের চোখে দেখে এসেছেন। ব্যক্তি শাসনের পথে প্রধান বাধারূপে গণ্য করেছেন। একশ্রেণির গণতন্ত্রবিরোধী আমলার চক্রান্ত কাজ করছে। একটি সেনাসমর্থিত অরাজনৈতিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে পক্ষপাতহীন বিচারের জন্য অপরিহার্য স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আইন প্রণয়ন করতে হয়েছিল। এটা গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক নেতৃত্বের জন্য চরম অবমাননাকর ছাড়া আর কিছু নয়।

বিচারপতি সিনহা আমাদের সবার উদ্দেশে বলেছেন, ‘নির্বাহী বিভাগ সম্পর্কে সতর্ক থাকুন। এরা আমাদের সব ক্ষমতা কেড়ে নিতে চাইছে।’ তার এ সতর্ক বাণী অত্যন্ত স্পষ্ট এবং দ্ব্যর্থহীন।

কোথাও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ধ্বংস না করে স্বৈরাচার টিকে থাকতে পারেনি। কারণ স্বাধীন বিচার বিভাগ গণতান্ত্রিক সংবিধান রক্ষা এবং আইনের আওতায় সবার জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে অবস্থান নেয়।

আমরা অত্যন্ত আন্তরিকভাবে আশা করব, জনগণের উপকারার্থে আইনের শাসন বজায় রাখার স্বার্থে ক্ষমতালোলুপ স্বেচ্ছাচার প্রতিষ্ঠার আমলাতান্ত্রিক প্রাধান্যের কাছে বিচার ব্যবস্থাকে অবনমিত হওয়ার হাত থেকে রক্ষায় আইনজীবী সম্প্রদায় ঐক্যবদ্ধ হবেন। আইনের শাসনের অধীনে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার বাধ্যবাধকতা মেনে নিয়ে আইনজীবীরা যে পবিত্র পেশাগত দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন তা ভুলে গিয়ে তারা দলীয় কর্মীতে পরিণত হতে পারেন না। দলীয় কর্মীরূপে নয়, আইনজীবীদের মর্যাদা আইনজীবী হিসেবে ভূমিকা পালনের মধ্যেই নিহিত।

বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে নির্বাহী বিভাগের কাছে সমর্পণে বাধ্য করার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে তাতে নীরব দর্শক হয়ে না থাকার জন্য প্রধান বিচারপতি আইনজীবীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। শুধু আইনজীবী নন, ন্যায়বিচারকামী গোটা জাতির উচিত বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া। সরকার কর্তৃক সংসদের মাধ্যমে বিচারপতিদের বিচার করার শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তনের বিরুদ্ধে তেমন শক্তিশালী কোনো প্রতিবাদ ওঠেনি। আইনজীবীরা দলীয় কর্মী হওয়ায় দলীয় নেতার কর্তৃত্বই তাদের কাছে প্রাধান্য পেয়েছে।

যে জাতি ব্যক্তি স্বাধীনতা ও আইনের শাসনের মর্ম বোঝে না এবং গণতন্ত্রের অধীনে নিজেদের সুরক্ষার জন্য সংগ্রামে প্রস্তুত নয়, তারা স্বাধীন জাতি হিসেবে টিকে থাকার অযোগ্য। আমাদের ভাগ্যে হয়তো তাই ঘটতে যাচ্ছে। যখন ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ বই লিখে দাবি করেন শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেছে নিতে হয়েছে তখন এটাই বলা হচ্ছে যে, আমাদের প্রধানমন্ত্রী আমাদের দ্বারা নির্বাচিত হয়েছেন কিনা সেটা তাদের কাছে কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়। ভারতের স্বার্থে, ভারতের ইচ্ছায় আমাদের সরকার গঠিত হবে, এ দোষ ভারতের নয়— দোষ আমাদের এবং আমাদের দুর্বল নেতৃত্বের। প্রশ্ন হলো, স্বাধীনতা নিয়ে বড় বড় বীরত্বের কথা আমাদের শোনানো হচ্ছে কোন অবস্থানে দাঁড়িয়ে। ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রীর অবমাননাকর বক্তব্যের প্রতিবাদও করা হবে না!     

পদানত বিচার বিভাগ হচ্ছে জনগণের জন্য ন্যায়বিচারের অস্বীকৃতি এবং দাসত্বের স্মারক। গণতন্ত্রের জন্য হাজার হাজার জনগণ জীবন দিয়েছে, কিন্তু তাদের সহ্য করতে হচ্ছে গণবিরোধী আমলাতান্ত্রিক শাসন।

দলীয় রাজনীতির দলাদলির কারণে বেঞ্চ ও বারের সুসম্পর্কে ফাটল ধরায় বিচার বিভাগ অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েছে। এর ফলে প্রায় সব স্তরে ন্যায়বিচারের যথাযথ প্রয়োগ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ছে। চরম অসহনশীল রাজনৈতিক পরিবেশের কারণে নিম্ন আদালতগুলো এখন বিচার সম্পন্ন করার ব্যাপারে পুলিশ ও সরকারের চাপের মধ্যে রয়েছে। উচ্চ আদালতও বুঝতে পারছে না তাদের শক্তি কোথায়।

আওয়ামী লীগ সরকার অগণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর খপ্পরে পড়ে গেছে; এটা বাংলাদেশের জনগণের জন্য এবং এদেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক নিয়তি। যে দলের জন্ম হয়েছিল একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য, যে দল গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য এবং জনগণের স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য সুদীর্ঘ রক্তাক্ত সংগ্রাম করেছে, সেই দলই অগণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের অশুভ প্রভাবে আক্রান্ত হয়ে বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আজ আওয়ামী লীগ নিজেদের জনগণের পরিবর্তে বিদেশি অনুগ্রহের কাছে নতজানু।

বাঙালি হিসেবে দূরদর্শিতামূলক চিন্তাভাবনা করতে আমরা যে কত অপারগ সে সম্পর্কে সচেতন হওয়া প্রয়োজন। কোনোরূপ উপযুক্ত প্রস্তুতি না নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করতে গিয়ে আমরা নিজেদের নানাভাবে অসহায় করেছি। নিজেদের ভোটে নির্বাচিত সরকার পেতে আমাদের অসহায়ত্ব বেড়েই চলেছে। জীবনের নিরাপত্তার ব্যাপারেও আমরা অসহায়। জনগণের জন্য সুবিচার নিশ্চিত করতে জাতি নানা ধরনের বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। শক্তি বেড়ে চলেছে অসত্ ও অন্যায়কারীদের। নিজেদের জন্য সুন্দর ভবিষ্যত্ নির্মাণ করতে হলে আমাদের অন্তর্নিহিত দুর্বলতাগুলোকে জয় করার সাহস অর্জন করতে হবে।

আমাদের প্রমাণ করতে হবে স্বাধীন জাতির অধিকার ও মর্যাদা নিয়ে জীবনযাপনের সাহস ও সততা আমাদের আছে। জনগণের বৃহত্তর স্বার্থ রক্ষায় শিক্ষিত লোকদের ব্যর্থতাই আমাদের অসহায়ত্বের প্রধান কারণ। জাতি গঠনে সুশিক্ষার বলিষ্ঠ ভূমিকা থাকতেই হবে। সাংবাদিক ও আইনজীবীরা অগণতান্ত্রিক দলীয় রাজনীতির কর্মী হতে পারেন না। ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বার্থ রক্ষার জন্য স্বাধীনতার প্রয়োজন হয় না। চরিত্র ও আদর্শহীন হলেই হয়। স্বাধীনতার প্রয়োজন হয় অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকার আত্মমর্যাদার জন্য।

যারা দাবি করেন, বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের মর্যাদা বৃদ্ধি পাচ্ছে তারা তাদের নিজেদের মর্যাদাবোধ সম্পর্কে কতটা সচেতন সেটাই প্রশ্ন। যারা মিথ্যা বীরত্ব আর অসত্য গৌরবের প্রশংসা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে চান তারা জাতির জন্য উন্নত ভবিষ্যতের কোনো বার্তা বহন করছেন না।  ব্যর্থতার জয়গান গেয়ে তারা আমাদের ব্যর্থতার গ্লানি বহন করতে সাহায্য করছেন।

লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা।

সর্বশেষ খবর