৪ মার্চ, ২০১৬ ১৯:০২

ইসলাম, নারী এবং অন্যান্য প্রসঙ্গ

গোলাম মাওলা রনি

ইসলাম, নারী এবং অন্যান্য প্রসঙ্গ

নারীর উত্থান, পতন এবং ক্ষমতায়নের ইতিহাসের জটিল রসায়ন পৃথিবীকে করেছে কলঙ্কিত আবার কখনো বা অতি উজ্জ্ব্বল আলোতে উদ্ভাসিত করেছে ধরিত্রীকে। মানব সভ্যতা শুরু হওয়ার বহু শত কিংবা বহু হাজার বছর পূর্বে আমাদের পূর্ব পুরুষরা যখন বাস করতেন পাহাড়ের গুহা, বন-জঙ্গল অথবা কোনো জলাভূমির কিনারে তখন তারা পরিবারবদ্ধ হয়ে থাকার উপায় হিসেবে নারীকে নেতা বানিয়ে জীবনের পথচলা আরম্ভ করলেন।  নারীর নেতৃত্বের সেই ধারা বজায় থাকল কয়েক হাজার বছর অবধি। পরবর্তীতে অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক বিবর্তনের কবলে পড়ে নারীরা তার কর্তৃত্ব এবং নেতৃত্ব হারিয়ে ফেলেন। আইয়ামে জাহেলিয়াতে এসে নারীরা ভয়ঙ্কর সব পরিস্থিতির মুুখে পড়েন। হুজুরে পাক (সা.)-এর জন্মের পূর্ববর্তী একশ বছরে জাজিরাতুল আরব বা আরবীয় উপদ্বীপ ছাড়াও সমকালীন পৃথিবীর অন্যান্য অংশে নারীদের অবস্থা ছিল খুবই করুণ। পৃথিবীর কোনো রাজা-বাদশাহ, সমাজ-সংসার কিংবা সংগঠন নারীর চিরায়ত মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য সেই যুগে এগিয়ে এসেছিল বলে কোনো দালিলিক প্রমাণ আজ অবধি আবিষ্কার হয়নি। মানব জাতির ইতিহাসে সর্বপ্রথম ইসলামই নারী মুক্তির সনদ বাস্তবায়ন করেছে।

পবিত্র আল কোরআনে যেভাবে নারীকে মহিমান্বিত করা হয়েছে তার নজির পৃথিবীর অন্য কোনো ধর্মে নেই। নারীর অধিকার, সুরক্ষা, লালন-পালন, বিয়েশাদি, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি বিষয়ে পবিত্র কোরআনে যে স্পষ্ট আয়াতসমূহ বর্ণিত হয়েছে তা পৃথিবীর মানুষ রচিত কোনো সংবিধান, অধিকারের দলিল বা রাজার রাজকীয় আদেশনামায় পাওয়া যাবে না। আর এ কারণেই আল কোরআনকে বলা হয় নারী মুক্তির প্রথম ম্যাগনাকার্টা। রসুলে আকরাম (সা.)-এর জীবন, তার শাসনামল এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের শাসনামলে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নারীর অধিকারসমূহ যেভাবে রক্ষিত হয়েছে তা গত চৌদ্দশত বছরে পৃথিবীর অন্য কোনো ভূ-খণ্ডে দেখা যায়নি। ইসলামের অনুসারী মুমিন মোত্তাকীগণ আল্লাহ এবং তাদের রসুল (সা.) নির্দেশে নারীর সম্মান রক্ষা, অধিকার প্রদান এবং লালন-পালনে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা অন্য কোনো ধর্ম-বর্ণ ও সম্প্রদায়ের মধ্যে আজ অবধি দেখা যায়নি। এ ব্যাপারে কোরআন এবং হাদিসের সুস্পষ্ট নির্দেশনা এবং আল্লাহর রসুল (সা.) ব্যক্তিগত জীবনের কিছু উপাখ্যান আলোচনা করলে বিষয়টি সবার কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে।

একটি নারীর তিনটি রূপ বা পরিচয়কে ধর্তব্যের মধ্যে এনে আলোচনাটি শুরু করলে সর্বাঙ্গীন সুন্দর হবে বলে মনে হচ্ছে। নারীকে আমরা পাই কন্যা হিসেবে। তারপর বধূ এবং এক সময়ে মা হিসেবে। নারীর এই ত্রিভূজ রূপের বাংলা প্রতিশব্দ কন্যা-জায়া-জননী নিয়ে রচিত হয়েছে বহু কাব্য, সাহিত্য এবং উপাখ্যান। আজকের আলোচনায় আমরা ওদিকে না গিয়ে বরং কোরআন-হাদিসে কন্যা-জায়া-জননী সম্পর্কে কী বলা হয়েছে তা নিয়ে আলোচনা করব। প্রথমে বলে নেই কন্যা সম্পর্কে। জাহেলিয়াতের যুগে কন্যা সন্তানের জন্ম দেওয়া রীতিমতো অবমাননাকর বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। ফলে নবজাতিকার জন্মের পর জীবন্ত কবর দেওয়ার ঘটনা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। এই কাজের জন্য রাষ্ট্র কোনো শাস্তি দিত না এবং সমাজও ঘৃণা জানাত না। কন্যা সন্তানদের পিতামাতাকে তৎকালীন সমাজ ঠাট্টা-মসকরা করত। শিশু অবস্থায় কন্যা সন্তানকে বিক্রি করে দেওয়া এবং যৌন নিপীড়ন ছিল প্রচলিত একটি প্রথা। গৃহপালিত পশুপাখি এবং হিংস্র জন্তু-জানোয়ারের প্রতি মানুষ যতটুকু দরদ ও ভালোবাসা দেখাত ঠিক ততটুকু স্নেহ ভালোবাসা কন্যা সন্তানদের ভাগ্যে জুটত না।

সমাজ সংসারের উপরোক্ত ভয়াবহ অবস্থায় ইসলামের আবির্ভাব হয়। যে সমাজে নারীর অধিকার তো দূরর কথা অস্তিত্বই সংকটের মুখে পড়েছিল সেই সমাজে কোরআন ঘোষণা করল যে, নারী-পুরুষ উভয়ের অধিকারই সমান। কোরআন নারী-পুরুষকে একে অপরের পরিপূরক এবং পরস্পরের পোশাক বলে অভিহিত করল। একটি পোশাক যেমন মানুষকে আবৃত করে রাখে তেমনি মানুষও তার পরিধেয় পোশাকের প্রতি অতীব সতর্ক দৃষ্টি রাখে। কারণ সে জানে যে, পোশাক সম্পর্কে সামান্য গাফেল হলে সে যেমন উলঙ্গ হয়ে পড়বে তেমনি পরিধেয় পোশাকের গুণাগুণ রং এবং পোশাকটি পরিধানের ধরন ও প্রকৃতির ওপর তার আভিজাত্য, রুচি এবং মননশীলতা নির্ভর করবে। নারীর মর্যাদা এবং মহিমা বোঝানোর জন্য পবিত্র কোরআনের সূরাসমূহের প্রতি দৃষ্টিনিবদ্ধ করা যেতে পারে। নারী জাতিকে উদ্দেশ করে নাজিলকৃত সূরাটির নাম নিসা যা কিনা আল কোরআনের বৃহত্তম সূরাগুলোর মধ্যে অন্যতম। অন্যদিকে মানব জাতিকে উদ্দেশ করে নাজিলকৃত সূরাটির নাম নাস যা কিনা আল কোরআনের ক্ষুদ্রতম সূরাগুলোর অন্যতম। ব্যক্তিগতভাবে স্বতন্ত্র একজন নারীর নামেও সূরা নাজিল হয়েছে। হজরত ঈসা (আ.)-এর মায়ের নামে নাজিলকৃত সূরাটির নাম মারিয়াম।

এবার কন্যা সন্তানের গুরুত্ব এবং তাত্পর্য সম্পর্কে হাদিস কী বলে সে সম্পর্কে আলোকপাত করা যাক। রসুল (সা.) বলেছেন— কোনো ব্যক্তির যদি তিনটি কন্যা সন্তান থাকে এবং লোকটি যদি কন্যাদেরকে আদর যত্ন করে লালন-পালনের সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর দ্বীন শিক্ষা দেয় এবং সৎ পাত্রে বিয়েশাদির আয়োজন করে তবে লোকটি জান্নাতে আমি নবী মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে বসবাসের সুযোগ লাভ করবে। সর্বকালের সমাজ-সংসার এবং রাষ্ট্রকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে নবী (সা.) বলেন, তোমরা কেউ কোনো দিন কন্যা সন্তানের পিতাকে গালি দেবে না কারণ আমি মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহও (সা.) যে কন্যাদের পিতা। তিনি কন্যা সন্তানের পিতাদের উদ্দেশ করে বলেন— দূর দেশে সফরে গেলে ফেরার সময় অবশ্যই কন্যাদের জন্য উপহার সামগ্রী নিয়ে আসবে। ঘর থেকে বের হওয়ার পূর্বে সবার শেষে কন্যাদের কাছ থেকে বিদায় নেবে এবং ঘরে ফিরে সবার আগে কন্যা সন্তানদের খোঁজ করবে।

রসুল (সা.) তার কন্যা সন্তানদেরকে অতীব আদর যত্ন এবং স্নেহ ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ রেখেছিলেন। খাতুনে জান্নাত মা ফাতেমা (রা.)-এর প্রতি তার অবারিত স্নেহ মানব জাতির ইতিহাসে পিতা-কন্যার সর্বজনীন সম্পর্কের কিংবদন্তি মাইলফলক হয়ে আছে। কন্যা সন্তানের পর এবার আমরা নারী হিসেবে স্ত্রীর মর্যাদা নিয়ে সংক্ষেপে কিছু আলোকপাত করার চেষ্টা করব। বিয়েশাদির ব্যাপারে ইসলামী আইন হলো— নারীর সম্মতি ব্যতিরেকে কোনো বিয়ে হবে না। সম্মতির ক্ষেত্রে নারী সর্বপ্রথম ইলা অর্থাৎ তার হবু স্বামীকে পছন্দ করার ক্ষেত্রে নিজের সম্মতি জ্ঞাপন করবেন। পরে পুরুষ কবুলিয়ত অর্থাৎ নারীর সম্মতি গ্রহণ করলাম বা আমি রাজি আছি বলে বিয়েতে নিজের মতামত প্রদান করবেন। জাহেলি যুগে বিয়েতে নারীপক্ষকে যৌতুক দিতে হতো। ইসলাম যৌতুক প্রথাকে হারাম করে দিয়েছে। যৌতুক গ্রহণকে এমন গুরুতর গুনাহ বলে আখ্যা দিয়েছে যেমনি সাধিত হয়ে থাকে শুয়োরের মাংস ভক্ষণের ফলে অথবা কুকুরের মতো হারাম প্রাণীদের মলমূত্র ভক্ষণের মাধ্যমে।

বিয়েতে যৌতুককে নিষিদ্ধ করা হলেও কন্যাপক্ষ কর্তৃক উপহার প্রদানকে উৎসাহিত করা হয়েছে— তবে তা অবশ্যই কন্যার পিতার শক্তি-সামর্থ্য, রুচি এবং পছন্দের ওপর নির্ভর করবে। আল্লাহর রসুল (সা.) তার প্রিয়তমা কন্যা মা ফাতেমা (রা.)-এর বিয়েতে তোহফা হিসেবে প্রদান করেছিলেন খেজুর পাতা দিয়ে তৈরি একটি তোষক, একটি চামড়ার তৈরি কুয়া থেকে পানি তোলার মশক এবং গম পিষে আটা বানানোর জন্য একটি জাঁতা। বিয়ের পর একটি নারীর বহুমুখী অধিকার এবং মর্যাদা ইসলাম ধার্য করে দিয়েছে। নারীকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী এবং স্বাধীন করার মানসে বিয়ের শর্ত হিসেবে মোহরানার বিধান রাখা হয়েছে। মোহরানার পরিমাণ নির্ধারণের ক্ষমতা কন্যাপক্ষকে দেওয়া হয়েছে। বাসর রাতের পূর্বেই মোহরানার অর্থ আদায় বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। মোহরানার অর্থগ্রহণ এবং সেই অর্থ দ্বারা স্বাধীনভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য করার অধিকার ইসলামী শরিয়ত নারীকে দিয়েছে। ইসলাম নারীকে তিনভাবে এবং একই সঙ্গে তিনটি স্থান বা সূত্র থেকে সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী মনোনীত করেছে। পিতা, স্বামী এবং সন্তানদের সম্পত্তিতে নারীর অংশীদার হওয়ার বিধান রয়েছে। মোহরানা, খোরপোশ, উপার্জিত ধনসম্পত্তি এবং উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ধন সম্পত্তি নারী স্বাধীনভাবে ভোগ, দখল, দান কিংবা বিক্রয় করতে পারবে। আর এসব কিছুই হয়েছিল আজ থেকে চৌদ্দশত বছর পূর্বে ইসলামী শরিয়ত এবং হুকুমাতের মাধ্যমে।

নারীর অধিকারকে যেন কেউ ক্ষুণ্ন করতে না পারে সে জন্য ইসলামী হুকুমত দুনিয়াতে যেমন ব্যবস্থা রেখেছে তেমনি আখেরাতেও শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। মোহরানার অর্থ দাবি করে মুসলিম নারী স্বামীর বিরুদ্ধে যেমন মামলা দায়ের করতে পারে তেমনি টাকা আদায় না হওয়া পর্যন্ত সে তার স্বামীর সঙ্গে ঘর-সংসার করতে অস্বীকার জানাতে পারে। মোহরানার অর্থ পরিশোধ না করে কোনো স্বামী যদি তার স্ত্রীর সঙ্গে ঘর-সংসার শুরু করে তবে সেই স্বামীকে রোজ কিয়ামতে জেনাকারের কাতারে শামিল করা হবে। একজন নারী অর্থনৈতিকভাবে সফলতার স্বর্ণ সিংহাসনে আসীন থাকলেও তার খোরপোশ এবং নিরাপত্তার দায়িত্ব স্বামীকেই বহন করতে হবে। একজন বিবাহিত পুরুষের জন্য তার স্ত্রীকে দুনিয়া এবং আখেরাতের জন্য উত্তম অসিলা এবং সাক্ষী বানানো হয়েছে। স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক মহব্বত এবং সম্মান সম্পর্কে বলা হয়েছে— স্বামী-স্ত্রী উভয়ে যদি একে অপরের দিকে মহব্বতের দৃষ্টি নিয়ে তাকায় তবে উভয়ের আমলনামা থেকে সগিরা গুণাসমূহ মুছে ফেলা হবে। আল্লাহর রসুল (সা.) বলেন— তোমরা যদি একজন বিবাহিত মানুষের চরিত্র সম্পর্কে জানতে চাও তবে তার স্ত্রীর সাক্ষ্যগ্রহণ কর। অন্য একটি রেওয়াতে বলা হয়েছে— স্ত্রীদের সুপারিশ, সাক্ষ্য কিংবা প্রত্যয়ন ব্যতিরেকে কেউ জান্নাতে যেতে পারবে না। জান্নাতের দরজায় লেখা রয়েছে, দাউসের জন্য জান্নাতে প্রবেশ নিষেধ। দাউস বলা হয় সেই ব্যক্তিকে যে কিনা শরিয়তের বিধান মোতাবেক স্ত্রীর হক আদায় করেনি এবং ব্যক্তিত্বের অক্ষমতা বা দুর্বলতার কারণে স্ত্রীকে স্বেচ্ছাচারী বা গাফেল হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে।

আমাদের সমাজের বেশির ভাগ পুরুষই হয়তো তাদের স্ত্রীদের দিকে মহব্বতের দৃষ্টি নিয়ে তাকান না। তারা সংসার জীবনের নিত্য ব্যবহার্য অন্যান্য বস্তু এবং বস্তুগত সামগ্রীর মতো টেনেটুনে দাম্পত্য সম্পর্ক টিকিয়ে রাখেন। তারা সুখময় দাম্পত্য গড়ে তোলার জন্য চেষ্টা-তদ্বির করেন না কিংবা হয়তো জানেনও না। তারা দাম্পত্য সুখের জন্য আল্লাহর সাহায্য চান না বললেই চলে। অন্যদিকে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের তাগিদও খুব কম লোকেই অনুভব করেন। ইসলাম মানুষকে শিক্ষা দেয় দাম্পত্য সম্পর্ক সুন্দর এবং সুখময় করার মহত্তম উপায়সমূহ। স্বয়ং আল্লাহর রসুল (সা.) তার স্ত্রীদের প্রতি যে ইনসাফ এবং এহসান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তার কিয়দংশও যদি আমরা নিজেদের বাস্তব জীবনে প্রতিষ্ঠা করি তবে ধরাধামে আমাদের একেকটি পরিবার একেকটি জান্নাতের টুকরায় পরিণত হবে। হুজুর (সা.) তার স্ত্রীদের প্রতি কতটা মহব্বত প্রদর্শন করতেন তা হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বর্ণিত নিম্নের হাদিস থেকেই বোঝা যাবে।

হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, ‘জোত্স্না প্লাবিত এক রাতে আল্লাহ রসুল (সা.) আমাকে বললেন, চল আয়েশা! আমরা বাইরে থেকে একটু বেড়িয়ে আসি। কিছু দূর এগোনোর পর রসুল (সা.) বললেন— চল আয়েশা আমরা দৌড় প্রতিযোগিতা করি— ওই যে দূরে পাথর খণ্ড দেখা যাচ্ছে আমরা দৌড় দিয়ে সবার আগে যে পাথরটিকে ছুঁতে সক্ষম হব সেই হবে আজকের রাতের বিজয়ী। আমরা উভয়ে দৌড় দিলাম এবং আমি বিজয়ী হলাম। এ ঘটনার অনেক দিন পর আল্লাহর রসুলের কথামতো আমরা আরও একটি চাঁদনী রাতে পুনরায় দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিলাম। সেবার আমি বেশ মোটা হয়ে গিয়েছিলাম। ফলে দৌড়ে আমি পরাজিত হলাম। আল্লাহর রসুল (সা.) বিজয়ী হয়ে উত্ফুল্ল হয়ে উঠলেন এবং বললেন— আয়েশা! মনে আছে! এই স্থানে বহুদিন পূর্বে তুমি আমায় পরাজিত করেছিলে! আজ বিজয়ী হয়ে সেদিনের পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণ করলাম!

নারীর তৃতীয় বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ মাতৃরূপ নিয়ে আলোচনা শেষে আজকের প্রসঙ্গের ইতি টানব। মা হিসেবে ইসলাম নারীকে সবার ওপর মর্যাদা দান করেছেন। নারীর মাতৃরূপের মর্যাদার সঙ্গে পৃথিবীর কোনো পদ-পদবি, সিংহাসন, রাজা-বাদশাহর ফরমান এমনকি পিতার আসনও তুলনীয় নয়। একজন সন্তানের নিকট তার মা হলেন সর্বোচ্চ সম্মান এবং মর্যাদার প্রতীক। জনৈক সাহাবা আল্লাহর রসুল (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করলেন— ইয়া রসুলুল্লাহ। এই দুনিয়ায় আমি সবচেয়ে কাকে বেশি মর্যাদা দেব! রসুল (সা.) বললেন— তোমার মাকে। প্রশ্ন করা হলো— এরপর কাকে? উত্তর এলো— তোমার মাকে। আবার প্রশ্ন করা হলো— এরপর কাকে? বলা হলো— মাকে। প্রশ্নটি চতুর্থবার করা হলো এবং চতুর্থ স্তরে মর্যাদাবান ব্যক্তি হিসেবে বলা হলো— তোমার পিতাকে।

জনৈক সাহাবি আল্লাহর রসুল (সা.)-এর দরবারে হাজির হয়ে বললেন— ইয়া রসুলুল্লাহ! এই দেখুন! আমার বুড়ি মা। আমি তাকে সুদূর ইয়ামেন থেকে কাঁধে করে মক্কা নিয়ে এসেছি হজ করার জন্য। তাকে কাঁধে নিয়ে তওয়াফ করেছি— সায়ী করেছি— মুজদালেফা-আরাফার ময়দানে হজের আনুষ্ঠানিকতা করে মদিনা নিয়ে এসেছি। হে রসুল! আমি কি মায়ের হক আদায় করতে পেরেছি?  হুজুর (সা.) জবাব দিলেন— না! পারনি। আল্লাহর রসুল (সা.)-এর জমানায় কতিপয় প্রসিদ্ধ সাহাবায়ে কেরামের সঙ্গে তাদের মায়ের সম্পর্ক এবং শ্রদ্ধাবোধের কাহিনী আজও কিংবদন্তি হয়ে রয়েছে। হজরত আবু হোরায়রা (রা.) হজরত মুসা (আ.)-এর জমানার জনৈক মাংস বিক্রেতার কাহিনীসহ যুগ যুগান্তরের অসংখ্য অলি আল্লাহ, গাউস-কুতুব, আবেদ-আবদালের মাতৃভক্তির কাহিনী পৃথিবীর তামাম নারী জাতিকে সম্মান ও মর্যাদার সুউচ্চ শিখরে আসীন করেছে।

রসুল (সা.) বলেছেন— মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশ্ত। এই একটি বাক্য দ্বারাই ইসলামে নারীর মর্যাদার স্বরূপ সহজেই অনুমান করা সম্ভব। এই বাক্যটির দ্বারাই ইসলামে নারী-পুরুষের অবস্থান নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। একজন পুরুষের পায়ের তলার জিনিসের কথা যদি আসে তবে যে কোনো সাধারণ মানুষ বলবেন— লোকটির পায়ের নিচে রয়েছে জুতা। আর লোকটির পায়ে যদি জুতা না থাকে— তবে তার পায়ের নিচে থাকবে ধুলা, ধুসরিত পঙ্কিল অথবা মরুময় জমিন। অন্যদিকে মাতৃরূপী নারীর পায়ের তলায় থাকে তার সন্তানদের জন্য জান্নাত। ঊর্ধালোকের জান্নাত কেবলমাত্র মায়ের মর্যাদায় ধরাধামে এসে ধরা দেয় তার পায়ের নিচে। পৃথিবীর সব নারী যদি জানতেন যে ইসলাম তাদেরকে এতসব মর্যাদা এবং অধিকার দান করেছে তবে সবাই মিছিল করে রাষ্ট্রশক্তি সমূহের নিকট দাবি তুলতেন— আর কিছু চাই না!  আল্লাহ আমাদেরকে যেসব অধিকার দিয়েছেন, শুধু সেগুলোই আমাদেরকে ফেরত দিন।

লেখক : কলামিস্ট।

সর্বশেষ খবর