৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ১১:১৭

শেখ হাসিনা, বড় বোনের মতো যিনি

ড. আবুল হাসনাৎ মিল্টন

শেখ হাসিনা, বড় বোনের মতো যিনি

ড. আবুল হাসনাৎ মিল্টন

পঁয়ত্রিশ বছর ধরে আমার রাজনৈতিক নেত্রী হিসেবে চিনি। ছাত্রলীগ করতে গিয়ে তার প্রত্যক্ষ স্নেহ-প্রশ্রয় পাবার সৌভাগ্য হয়েছিল। বড় বোনের মতো দুয়েকবার যে শাসন করেননি তাও নয়। আবার খুব ব্যক্তিগত বিষয়েও একান্ত আপনজনের মত পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। বাংলাদেশ ছেড়েছি প্রায় উনিশ বছর, কিন্তু তার নেতৃত্ব থেকে দূরে সরে যাইনি কখনও। আশির দশকে তাকে যেমন দেখেছি, আজও তিনি সেরকমই আছেন। কেবল সময়ের পরিক্রমায় বয়সটাই যা বেড়েছে। তবে একটুও বদলাননি তিনি, বরং আগের চাইতে অনেক শাণিত, পরিণত ও অধিক প্রজ্ঞাবতী হয়েছেন। 

আজ তার নেতৃত্বে বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ এক উজ্জ্বল বদ্বীপের নাম। সমগ্র বিশ্ব নেতৃত্ব তাকে সমীহ করে, যুগপৎ বিস্ময় ও শ্রদ্ধার চোখে দেখে। দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশসমূহ যখন পরস্পর বিরোধে মাতে, তখন তিনি মঙ্গল প্রদীপ হাতে শান্তির বার্তা ছড়ান। বাংলাদেশের বিভিন্ন ইস্যুতে আলোচনা-সমালোচনা হয়। দীর্ঘদিনের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে নিয়েও অনেকে অনেক কথা বলে। কিন্তু কিছু পাকিপন্থী কুলাঙ্গার ছাড়া প্রায় সবার কাছেই আজ তিনি সমাদৃত, আস্থার আরেক নাম। 

এ বছরের জুলাই মাসে সিডনির তরুণ রেমন্ড সালোমন আমাকে ফোন দিয়ে বললো, ‘আপনার নেত্রীকে নিয়ে একটা গান লিখেছি’। বললাম, গানের কথাগুলো পাঠাও। কথাগুলো পড়ে মনটা কষ্টে ভরে উঠলো। জিজ্ঞেস করলাম, ‘গানটা কে গাইবে?’ ঢাকা থেকে এ বছরের শুরুতে সিডনির ইউটিএস বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছে নাফিসা শামা প্রভা। ঢাকা থেকেই তার সাথে আমার পরিচয়। ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদে মেয়েটার হাত অসাধারণ। আমেরিকান লেখিকা লরা ইঙ্গেলস ওয়াইল্ডারের ‘দ্য ফার্স্ট ফোর ইয়ার্স’ বইটা ওর অনুবাদকৃত প্রকাশিত প্রথম গ্রন্থ। তবে ও যে এত সুন্দর গান গায়, এটা জানতাম না। ওর কণ্ঠে একটা গান শুনে অবস্কিওরের টিপু বলেছিল, ‘দোস্ত, এই মেয়ের কণ্ঠ তো অসাধারণ’। 

রেমন্ড বললো, বাসায় থাকা রেকর্ডিংয়ের যন্ত্রপাতি দিয়ে পুরো গানটা রেকর্ড করা যাবে। সুতরাং তেমন খরচও হবে না। কিন্তু গানের সুর করবে কে? রেমন্ড ইউটিউব থেকে অনেকগুলো বিখ্যাত গান ডাউনলোড করলো। কোনটার মত করে সুর করা যায়? রেমন্ডের পছন্দানুযায়ী শামা তিন-চারটে সুরে গানটি গেয়ে আমাকে পাঠালো। আমি ঢাকায় টিপুকে পাঠাতে বললাম। শুনে টিপু কিছু পরামর্শ সহকারে গানটা আবার গেয়ে ওকে ফের পাঠাতে বললো। গানটি পেয়ে ঢাকায় মিউজিক যোগ করে পাঠালো। টিপু অনেক যত্ন করে কাজটা করেছে। 

এর মধ্যে গানটির কথা রেমন্ড তার কিছু অস্ট্রেলিয়ান বন্ধুকে বলেছে। তাদের মাধ্যমে সে পৌঁছে গেছে সিডনির মূলধারার সঙ্গীত জগতে। টিপুর পাঠানো গানটা শুনে এবং রেমন্ডের সাথে আলাপ করে অস্ট্রেলিয়ার বিশিষ্ট সঙ্গীত পরিচালক জেমস নতুন করে গানটা রেকর্ড করলেন। ক্রাশ সিম্ফনি প্রোডাকশনের অত্যাধুনিক স্টুডিওতে প্রভা গানটি আবার গাইলেন। পরপর কয়েক রাত জেগে রেকর্ডিংয়ের কাজ চলতে লাগলো। এ সময়ে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে নতুন একটা সমস্যার মুখোমুখি হলাম। 

রেমন্ড ফোন করে জানালো, পনেরোই আগস্টের নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডসমূহ এবং শেখ হাসিনা-শেখ রেহানার উপর সেই হত্যাকাণ্ডের প্রভাবের কথা ভেবে আমার মেন্টাল ব্রেকডাউন হচ্ছে। কিভাবে শেখ হাসিনা এবং শেখ হাসিনা এই শোক সহ্য করেছেন? তাকে অনেক বোঝাতে হয়েছে যাতে সে কাজটা ভালভাবে করতে পারে। তিন-চারটি ভার্সন করে, ঢাকায় দুয়েকজনের কাছে নিয়মিত পাঠিয়ে যে রাতে চূড়ান্ত ভার্সন তৈরী করা হচ্ছিল, সে রাতে অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটল। হঠাৎ করেই স্টুডিওতে ইন্টারনেটের কানেকশন অফ হয়ে গেলো, মূল কম্পিউটারটা বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো। সেই মুহূর্তে মোবাইল ফোনের ইন্টারনেটের সাথে সংযোগ দেওয়া হল। 

নিউক্যাসেলে বসে আমি মনে মনে আল্লাহকে ডাকছি। ১৪ আগস্টের মধ্যে কাজটা শেষ করে যতদ্রুত সম্ভব, কাজটা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছে দিতে হব। কম্পিউটার বন্ধ হবার আগেই আমাদের গানটার চুড়ান্ত হয়ে গেলো। রেমন্ডের ইচ্ছে, এটার একটা গীতিচিত্রও বানাতে হবে। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির জন্য সবকিছু পরিকল্পনামাফিক যোগাড় করা কঠিন। পচাত্তরের আসবাবপত্র, লাল রংয়ের ল্যান্ড টেলিফোন সেটসহ একটা স্টুডিও খুঁজে বের করা হল। বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয়ের জন্য দ্রুত লোকজন চুড়ান্ত করে সিডনিতে নির্মান করা হল গীতিচিত্র ‘বাবা’। গীতিচিত্রটির কাভারের জন্য গ্রাফিক্স ডিজাইনের কাজটি করেছেন বুলগেরিয়ান শিল্পী ইদা স্টয়চেভা। সবশেষে দেখে মনে হল, সব মিলিয়ে আক্ষরিক অর্থেই বঙ্গবন্ধুর কন্যাদ্বয়ের ব্যক্তিগত শোকগাথা নিয়ে নির্মিত গীতিচিত্র ‘বাবা’ একটি আন্তর্জাতিক প্রযোজনা হয়েছে।

বছর তিনেক আগে একঝাঁক তুমুল তরুণের আমন্ত্রণে ঢাকায় একটি সেমিনারে গিয়েছিলাম। তাদের দলনেতা শরীফ আমাকে বলেছিল, বাংলাদেশের আগামী একশ বছরের ভবিষ্যত নির্ধারণের জন্য সামনের দশটি বছর খুব গুরুত্বপূর্ণ। এবং বাংলাদেশের স্বার্থেই এই দশ বছর শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রী থাকা প্রয়োজন। বাংলাদেশের ভবিষ্যতের প্রশ্নে শরীফের কথাটা অত্যন্ত তাৎপর্যময়। 

বাংলাদেশের স্বার্থেই আরও কয়েক বছর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রয়োজন। ব্যক্তিগত শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করে যেভাবে তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের প্রতিটি স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে যাচ্ছেন, তা আজ সারা দেশ জুড়ে দৃশ্যমান। তার এই সাফল্যকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়বার লক্ষ্যে তিনি সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি নির্ধারণ করে ধাপে ধাপে এগোচ্ছেন। তিনি প্রথমেই খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ গড়েছেন। এর জন্য তিনি কৃষিখাতকে প্রাধান্য দিয়েছেন। এর অংশ হিসেবে কৃষককে নানারকমের প্রণোদনা দিয়েছেন, কৃষি পণ্যে নজিরবিহীন পরিমানে ভর্তুকি দিয়েছেন। আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ছেন। সাথে বিদ্যুৎ উৎপাদন, সারাদেশ জুড়ে বিভিন্ন অবকাঠামো তৈরী এবং শিল্পোন্নয়নের জন্য সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে যাচ্ছেন। আধুনিক, উন্নত বাংলাদেশ গড়বার জন্য এমন আরও অসংখ্য কাজ তার সরকার করছেন। 

তার এই দীর্ঘ চলার পথটি কখনো মসৃন ছিল না, এমনকি এখনো নাই। তাকে ন্যূনতম একুশবার হত্যার অপচেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু প্রতিবারই তিনি সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমতে বেঁচে গেছেন। তার এই বেঁচে যাওয়া খুবই তাৎপর্য্যময়। বাংলাদেশের জন্য তিনি নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। তিনি কেবল বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকারীই নন, আদর্শেরও উত্তরাধিকারী। বাবার আদরের হাসু, বাবার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার লড়াইয়ের প্রধান সেনাপতি। সব মিলিয়ে কী অসাধারণ।

 

বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ

সর্বশেষ খবর