নব নির্বাচিত সিনেটের মেজরিটি নেতা চার্লস শুমার ট্রাম্পের বিচার শুরু করেছে গত ৯ ফেব্রুয়ারি। ক্যাপিটল হিলের জঘন্য তাণ্ডবের মূল হোতা ট্রাম্পের দ্বিতীয় অভিশংসন পাস করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ গত ১৩ জানুয়ারি বিকালে। অভিশংসন পদ্ধতি এবং এর প্রয়োগ সম্পর্কে বর্ণনা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে। এই সংবিধানের আর্টিক্যাল দুই এবং সেকশন চারে নির্ধারিত রয়েছে কোন কোন অপরাধের জন্য প্রেসিডেন্ট অথবা অন্য উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের ইমপিচ অথবা অভিশংসন করা যেতে পারে।
ইমপিচের মূল উদ্দেশ্য হলো অভিযোগ আনয়ন করা। ইমপিচমেন্টের অনুরূপ হলো ফৌজদারি মামলার অভিযোগ গঠন অথবা ইনডাইটমেন্ট। এটা আদালতের বিচারের মতো নয়। রয়েছে পার্থক্য। সবচেয়ে বড় পার্থক্য হলো এটা আইনের পরিবর্তে অনেকটা রাজনৈতিক। আদালতের বিচারে জুরিদের নিরপেক্ষতা বাধ্যতামূলক। কিন্তু সিনেটের ইমপিচমেন্ট বিচারের জুরিরা নিরপেক্ষ নয়। ট্রাম্পের প্রথম সিনেট ইমপিচমেন্ট বিচারের আগে তৎকালীন মেজরিটি লিডার মিচ মেকনাল বলেছিল সে নিরপেক্ষ জুরি নয়। যাই হোক, অভিশংসন করা যেতে পারে নিমোক্ত অপরাধে।
দেশের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা, ঘুষ অথবা অন্যান্য উঁচু পর্যায়ের অপরাধ এবং অসদাচরণ। কংগ্রেসের নিয়ম অনুযায়ী প্রেসিডেন্টকে অপসারণ করা যেতে পারে যদি সে ক্ষমতার দুর্ব্যবহার করে, ব্যক্তিগত স্বার্থ ও লাভের জন্য তার অফিসকে ব্যবহার করে অথবা প্রেসিডেন্টের আচরণ যদি হয় তার দায়িত্বের উদ্দেশ্য ও কার্যপদ্ধতির সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ। প্রেসিডেন্টকে অপসারণের জন্য রয়েছে দু'টো পদক্ষেপ। প্রথমটি হলো কংগ্রেসের নিম্নকক্ষে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে পাস করতে হবে ইমপিচমেন্ট আর্টিক্যাল।দ্বিতীয় পদক্ষেপে সিনেটে হবে ইমপিচমেন্ট আর্টিক্যাল অথবা নির্দিষ্ট অপরাধের জন্য বিচার। এ বিচারে নিম্নকক্ষের পক্ষ থেকে বাছাই করা কংগ্রেস সদস্যরা ম্যানেজার (প্রসিকিউটর) হিসেবে সিনেটে অভিযোগ উত্থাপন করবে আর তার সমর্থনে সাক্ষী ও যুক্তি প্রয়োগ করবে। দুই তৃতীয়াংশ অর্থাৎ ৬৭ জন সিনেটর অভিযোগের পক্ষে ভোটদান করলেই প্রেসিডেন্টের অপরাধ প্রমাণিত হবে এবং অপসারণ ধার্য হয়ে যাবে। এরপর সিনেট ইচ্ছে করলে দোষী প্রেসিডেন্টকে শুধু অপসারণ নয়, তার চেয়ে অধিক শাস্তি প্রদান করতে পারে। এই পর্যায়ে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্থাৎ ৫১ ভোটে দোষী প্রেসিডেন্ট চিরতরে অযোগ্য হবে যে কোনো সরকারি পদ, সম্মান, ট্রাস্ট অথবা লাভজনক প্রতিষ্ঠানের পদে।
৯ ফেব্রুয়ারির সিনেটের বিচারে ট্রাম্পের অ্যাটর্নি হলো ব্রুস ক্যাস্টর এবং ডেভিড শোয়েন। তাদের মতে ট্রাম্পের পক্ষে রয়েছে দু'টি মোক্ষম যুক্তি। প্রথমটি হলো যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের প্রথম সংশোধনী। সংক্ষেপে সেটা হলো মত প্রকাশের স্বাধীনতা। ৬ জানুয়ারির ভাষণে তার সমর্থকদের একাধারে বারবার উত্তেজিত করেছে আবার অন্যদিকে শুধু একবার ওদের শান্ত থাকতে বলেছে। কিন্তু আসল ঘটনা হলো প্রায় দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে নির্বাচন কারচুপির বানোয়াট অপপ্রচার চালিয়ে সমর্থক কিউআনন ষড়যন্ত্র বিশ্বাসী এবং বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গ গুণ্ডাদের ক্ষেপিয়ে দিয়েছিল ট্রাম্প। ৬ জানুয়ারির ভাষণ ছিল গরম কেরোসিন তেলে একটি জ্বলন্ত দেশলাই নিক্ষেপ করা। ট্রাম্পের পক্ষের দ্বিতীয় যুক্তি হলো ইমপিচমেন্ট বিচারের মূল উদ্দেশ্য প্রেসিডেন্ট পদ থেকে অপসারণ। ২০ জানুয়ারির দুপুর থেকে ট্রাম্প আর প্রেসিডেন্ট নয়। সে এক সাধারণ নাগরিক। অতএব প্রেসিডেন্টকে অপসারণের জন্য বিচার এখন আর প্রযোজ্য নয়।
এর বিরুদ্ধে যুক্তি হলো অতীতের উদাহরণ। ১৭৯৮ সালে উইলিয়াম ব্ল্যাআউন্ট সিনেট থেকে বরখাস্ত হওয়ার পরও সিনেটে তার বিচার হয়েছিল। কিন্তু সে দোষী সাব্যস্ত হয়নি। তার দলের সিনেটররা নিরপেক্ষতা জলাঞ্জলী দিয়ে তার পক্ষে ভোট দিয়েছিল। তখন বিচার কক্ষে লম্বা লাঠি নিয়ে ভীষণ মারামারি করেছিল ম্যাথিউ লাইয়ন এবং রজার গ্রিসওয়াল্ড নামের দুই জন কংগ্রেসম্যান। পাঠক, হয়তো আপনারা স্মরণ করতে পারেন ১৯৫৬ সালে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগ এবং কৃষক শ্রমিক পার্টির মারামারিতে অতি নিরীহ মানুষ স্পিকার শাহেদ আলী ইন্তেকাল করেছিল। উইলিয়াম ব্ল্যাআউন্টের বিরুদ্ধে প্রমাণ ছিল অকাট্য। তার দলের সিনেটররা তা অগ্রাহ্য করে দলীয় ভিত্তিতে ভোট দিয়েছিল। অতীতে ঠিক এমনি আরেকবার ঘটেছিল ১৮৭৬ সালে যুদ্ধ মন্ত্রী উইলিয়াম বেলন্যাপ-এর ব্যাপারে। ইমপিচমেন্ট বিচারের আগেই সে পদত্যাগ করেছিল। তথাপি তার ইমপিচমেন্ট বিচার সম্পন্ন হয়েছিল। কিন্তু ব্ল্যাআউন্টের মতোই তার সাজা হয়নি পার্টি লাইন ভোটে। ট্রাম্পের ব্যাপারে তাই হতে যাচ্ছে বলে আমার ধারণা।
২০২০ সালের ৩ নভেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচন ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের অন্যতম স্বচ্ছ এবং কারচুপিহীন নির্বাচন। এই নির্বাচনে বাইডেন ৭ মিলিয়নের বেশি নাগরিকদের ভোটে এবং বিপুল ব্যবধানে ইলেক্টোরাল কলেজের ভোটে জয় লাভ করে। কংগ্রেসের দায়িত্ব ছিল ৬ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিক গণনা। ওই দিন দুপুরে ট্রাম্প উত্তেজনাপূর্ণ ভাষণ দিল। দু’মাস ধরে ট্রাম্প ভুয়া প্রচার এবং ৬ জানুয়ারির সন্ত্রাসী ভাষণে আমেরিকার বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গদের ট্রাম্প এমনভাবে উত্তেজিত করেছিল যে এরা উন্মাদের মতো গণতন্ত্রের তীর্থস্থান ক্যাপিটল হিল দখল করে সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যের তাণ্ডবে মেতে ওঠে। সংবিধান অনুযায়ী তখন চলছিল প্রেসিডেন্টশিয়াল নির্বাচনের ইলেক্টোরাল কলেজের ভোট গণনার কাজ। সন্ত্রাসীদের আক্রমণে গণনার কাজ পণ্ড হয়ে যায় কয়েক ঘণ্টার জন্য। কংগ্রেস সদস্যদের নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যায় নিরাপত্তা বাহিনী।
পরিকল্পনা ছিল ভাইস প্রেসিডেন্ট পেন্স, স্পিকার পেলোসি এবং ট্রাম্পের অন্যায় আবদারে অসমর্থনকারী কংগ্রেস সদস্য ও সিনেটরদের ফাঁসি দিয়ে ট্রাম্পকে পুনরায় প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করবে। টুইটার এবং চ্যাটরুমে ৬ জানুয়ারির নাম দেওয়া হয়েছিল ‘ডে অব দ্য রোপ’। ক্যাপিটল হিলে নির্মাণ করা হয়েছিল ফাঁসির কাষ্ঠ। কাঠের আড়া থেকে ঝুলানো হয়েছিল ফাঁসির দড়ি। অস্ত্রধারী বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গ দুর্বৃত্তরা উচ্চকণ্ঠে স্লোগান দিচ্ছিল ‘পেন্সের ফাঁসি চাই’। সৌভাগ্য, ক্যাপিটল হিলের আইন রক্ষাকারী পুলিশ বাহিনীর প্রাণপণ চেষ্টায় অভ্যুত্থানকারীদের চেষ্টা ব্যর্থ হয়। অল্পের জন্য বেঁচে যান ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স এবং স্পিকার ন্যান্সি পেলোসিসহ অন্যান্য কংগ্রেস সদস্য। নিরাপত্তা বাহিনী সন্ত্রাসীদের হঠিয়ে দেওয়ার পর কংগ্রেস পুনরায় গণনা কাজ সম্পন্ন করে। গভীর রাতে বাইডেনকে প্রেসিডেন্ট এবং হ্যারিসকে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সৌভাগ্য, মানুষরূপী জঘন্য কীটের দল আমেরিকার চিরায়ত গণতন্ত্র ও পবিত্র সংবিধানের ক্ষতি করতে ব্যর্থ হয়। এখন চলছে বিচারের পালা। প্রায় চার শতের কাছাকাছি দুষ্কৃতকারী বর্ণবাদী গুণ্ডাদের শনাক্ত করা হয়েছে। আমেরিকার দক্ষ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দ্বারা বাকিদের পাকড়াও করা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। ক্যাপিটল হিলের জঘন্য তাণ্ডবের মূল হোতা ট্রাম্পের দ্বিতীয় অভিশংসনের কাজ সম্পন্ন করেছে যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ। ১৩ জানুয়ারি বিকালে এই অভিশংসন পাস হয়েছে উভয় দলের ইতিবাচক ভোটে।
ট্রাম্পই হলেন আমেরিকার ইতিহাসে দু’বার অভিশংসন প্রাপ্ত একমাত্র প্রেসিডেন্ট। যুক্তরাষ্ট্রে সর্বমোট চার বার অভিশংসন হয়েছে। এটাই প্রথম যখন উভয় দলের সমর্থন পেল। এর আগে ১৮৬৮ সালে এন্ড্ররু জনসন এবং ১৯৯৯ সালে বিল ক্লিনটন উভয়েই এক একবারের জন্য অভিশংসিত হয়েছিল। কিন্তু দু’বারের জন্য অভিশংসিত হয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের স্থান হলো যুক্তরাষ্ট্রের সব প্রেসিডেন্টের নিচে। ট্রাম্প হোয়াইট হাউস ছেড়েছেন ২০ জানুয়ারি। কিন্তু সিনেট চাইলে তাকে রাজনীতি ও অন্যান্য নাগরিক অধিকার থেকেও চিরতরে অযোগ্য এবং বঞ্চিত করতে পারবে। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রধান বিচারপতি জন রবার্টসের বিচারক হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সে অপারগতা জানিয়েছে। সিনেটরের প্রেসিডেন্ট প্রো টেম্পোর সিনেটর প্যাট্রিক লেহি হচ্ছেন বিচারক এবং ১০০ জন সিনেটর হবেন জুরি। দুই তৃতীয়াংশ অর্থাৎ ৬৭ জন সিনেটর অভিযোগের পক্ষে ভোটদান করলেই প্রেসিডেন্টের অপরাধ প্রমাণিত হবে। এজন্য প্রয়োজন হবে ১৭ জন রিপাবলিকান সিনেটরদের ভোট। এরপর সিনেট ইচ্ছে করলে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্থাৎ ৫১ ভোটে দোষী প্রেসিডেন্টকে চিরতরে অযোগ্য করতে পারবে যে কোনো সরকারি পদ, সম্মান, ট্রাস্ট অথবা লাভজনক প্রতিষ্ঠানের পদ থেকে।
উপরোক্ত পটভূমিতে বিতর্ক হলো- প্রেসিডেন্ট পদ থেকে মেয়াদোত্তীর্ণ ট্রাম্পের ওপর অপসারণ কার্যকর নয়, অতএব বিচারের আর কী প্রয়োজন রয়েছে? তার চেয়ে বরং ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে বিচার কাজ খারিজ করে দিলে ট্রাম্পকে ভোট দানকারী ৭৪ মিলিয়ন লোক খুশি হয়ে যাবে। জাতীয় ঐক্য কায়েম হবে। এর বিপক্ষে যুক্তি হলো- ঘৃণ্য দেশদ্রোহীদের ক্যাপিটল হিল আক্রমণের বিচার হতেই হবে। যেখানে একজন পুলিশ অফিসারসহ পাঁচজনের মৃত্যু ঘটেছে। এই জঘন্য অপরাধের কলকাঠি যে নাড়িয়েছে সেই গডফাদার ট্রাম্পের বিচার না হলে, ভবিষ্যতের ফ্যাসিবাদী একনায়কদের উৎসাহিত করা হবে এবং তাদের হাত থেকে যুক্তরাষ্ট্র এবং এর গণতন্ত্রের বিধানকে রক্ষা করা যাবে না। তাই প্রথমে বিচার এবং পরে ঐক্য। ১০ ফেব্রুয়ারি ম্যানেজারদের প্রধান জেমি রাসকিন এবং অন্য ম্যানেজাররা ভিডিওসহ অকাট্য যুক্তি দিয়েছে ট্রাম্পের বিপক্ষে। জেমি রাসকিন এবং ম্যাডেলিন ডিনের বর্ণনায় উঠে এসেছে অভ্যুত্থানের ভয়ঙ্কর দিক। তারা ভাগ্যের জোরে মৃত্যুর ভয়াল গ্রাস থেকে অল্পের জন্য বেঁচে গেছেন। তাদের বর্ণনা শুনে অনেকেই চোখের জল থামাতে পারেননি। এবার প্রশ্ন হলো- কংগ্রেসের নিম্নকক্ষে অভিশংসনের পর সিনেটের বিচারে দোষী হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু? ১৭ জন রিপাবলিকান সিনেটরের সমর্থন পাওয়া যাবে কিনা? অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে বিচারে ট্রাম্প পার পেয়ে যাবে। ভোট হবে দলীয় ভিত্তিতে। খুবই স্বল্পসংখ্যক রিপাবলিকান সিনেটর ট্রাম্পের বিপক্ষে ভোট দিতে পারে। ১৭ জন রিপাবলিকান সিনেটর ট্রাম্পের বিপক্ষে যাওয়া অসম্ভব। যদি যায় সেটা হবে মিরাকল।
লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক এবং সাবেক উপ-উপাচার্য, ইউনিভার্সিটি অব নিউ অরলিয়েন্স।
বিডি-প্রতিদিন/শফিক