১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০৮:২৮

তুরস্কের আদলে চীনেও জিন্নার মূর্তি বসাবে পাকিস্তান

অনলাইন ডেস্ক

তুরস্কের আদলে চীনেও জিন্নার মূর্তি বসাবে পাকিস্তান

চীনে মহম্মদ আলি জিন্নার মূর্তি স্থাপন করবে পাকিস্তান। দু-দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৭০ বছর উদযাপনের অঙ্গ হিসেবেই এই উদ্যোগ। ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে জিন্নার মূর্তি স্থাপনের তৎপরতা। ভালো কথা। জাতির পিতার মূর্তি বসানো নিয়ে আপত্তি থাকার কথা নয়। পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই চীন তাদের বন্ধু। এমনকি, বাঙালিদের ওপর পাক-সেনারা গণহত্যা চালানোর সময়ও মদত চিয়েছে কমিউনিস্ট চীন। তাই চীনে উইঘুর মুসলিমদের ওপর কমিউনিস্ট সরকার গণহত্যা চালালেও মুসলিম দেশ হয়েও নীরব পাকিস্তান। পাকিস্তানের দ্বিচারিতা এবং বাংলাদেশের প্রতি তাদের বিদ্বেষ এখনও অব্যহত। একই অবস্থান তাদের বাংলাদেশি দোসরদের। নব্য রাজাকাররাও পাকিস্তানের মতোই আজও স্বাধীনতাবিরোধী কাজ করে চলেছে।

পাকিস্তানপন্থী নব্য রাজাকাররা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্যের ওপর আঘাত হেনে দেশের স্বাধীনতার প্রতি অসম্মান করেছেন। কারণ জাতির পিতার ভাস্কর্যের সঙ্গে ধর্মীয় অনুশাসনের কোনও সম্পর্ক নেই। বিভিন্ন মুসলিম দেশেই রাষ্ট্রনায়কদের ভাস্কর্য রয়েছে। ঐতিহাসিক কারণেই তাদের অবদান দেশের নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে বানানো হয় ভাস্কর্য। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্মই হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের নেতৃত্বে। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি তিনি। কোটি কোটি বাঙালি তাকে মুক্তিদাতা হিসেবে মনে করেন। বাঙালির আবেগের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে তার নাম। গোটা বাংলাদেশের মানুষ তার কাছে ঋণী। তাই বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে প্রতিটি প্রান্তরে সাধারণ মানুষই এগিয়ে আসছেন নিজেদের ঋণ পরিশোধে। বঙ্গবন্ধুর আত্মত্যাগ ভুলবার নয়। পাকিস্তানি বর্বরতার হাত থেকে জাতিকে রক্ষা করেছেন তিনি। তাই তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে অনেকেই মেতে উঠেছিলেন ভাস্কর্য স্থাপনে।

কিন্তু ধর্মের জিগির তুলে পাকিস্তানপন্থী নব্য জামাতিরা জাতির পিতাকে অসম্মান করে দেশের স্বাধীনতাকেই কালিমালিপ্ত করতে চেয়েছে। ধর্মের সঙ্গে ভাস্কর্যের কোনও দ্বন্দ্ব নেই। পাকিস্তান-সহ বহু ইসলামিক দেশেই রয়েছে রাষ্ট্রনায়কদের মূর্তি। মহম্মদ আলি জিন্নার মূর্তি বহুকাল ধরেই পাকিস্তানে রয়েছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে পাকিস্তানপন্থীরা ফের মাথাচাড়া দিতে চাইছে। এর পিছনে মদত রয়েছে পাকিস্তানের। বিএনপিও ভাস্কর্য নিয়ে ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমে পড়েছে। অথচ, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের প্রথম হত্যাকারী, সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমানেরও ভাস্কর্য রয়েছে চট্টগ্রামে। কাঁচের ঘরে বাস করে ঢিল মারতে নেই। এই কথা মাথায় না রেখে বঙ্গবন্ধুর মূর্তিতে আঘাত হেনে কূচক্রীরা বাংলাদেশের স্বাধনীতার ভীতকেই দুর্বল করতে চেয়েছিল। কিন্তু মুজিব কন্যা, দেশনেত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্বে বাংলাদেশ সফলভাবেই সেই চক্রান্ত ভেস্তে দিতে সক্ষম হয়েছে।

সূত্রের খবর, পাকিস্তান সরকার ইতিমধ্যেই তুরস্কের আঙ্কারায় নিজেদের দূতাবাসের কাছে জিন্নার সুদৃশ্য মূর্তি বানানোর জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য চেয়েছে। কারণ আঙ্কারায় রয়েছে জিন্নার সুদৃশ্য বিশাল একটি মূর্তি। চীনের মাটিতে সেই ধরনেরই একটি মূর্তি স্থাপন করতে চায় ইসলামাবাদ। আঙ্কারার দূতাবাসের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে সেখানকার মূর্তির আয়তন থেকে শুরু করে কী ধরনের সামগ্রী ব্যবহৃত হয়েছে তার বিশদ বিবরণ। সঙ্গে মূর্তিটির বিভিন্ন ধরনের ছবিও চেয়ে পাঠানো হয়েছে। 

উল্লেখ্য, তুরস্কও মুসলিম দেশ। আর সেখানেও রয়েছে একাধিক মানুষের মূর্তি। খোদ জিন্নার মূর্তি তো রয়েছেই। এই নিয়ে মুসলিম দুনিয়ার কোনও আপত্তি নেই। আপত্তি থাকার কথাও নয়। কারণ ইসলাম ধর্মে হজরত মহম্মদের ছবি বা মূর্তি নিয়ে আপত্তির কথা বলা হলেও মানুষের ভাস্কর্য নিয়ে কোথাও কোনও  আপত্তি নেই। এমনকি, আরব আমিরাতেও একাধিক ভাস্কর্যের দেখা মেলে। ধর্মের নামে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের আপত্তি তোলা আসলে বাংলাদেশকে ফের অশান্তির দিকে ঠেলে দেওয়ারই চক্রান্ত। পাকিস্তানপন্থীরা মুক্তিযুদ্ধের পরাজয় আজও মেনে নিতে পারেনি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হলেও তাদের শিক্ষা হয়নি। আজও পাকিস্তানের মন জয় করতে গিয়ে জাতির পিতাকে অসম্মান করার মতো অপরাধ তারা করার সাহস পাচ্ছে। অথচ, খোদ পাকিস্তানই তাদের জাতির পিতার নতুন করে মূর্তি বানাচ্ছে। পাকিস্তানের দ্বিচারিতা অবশ্য নতুন কিছু নয়।

পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয় ১৯৫১ সালের মে মাসে। তারপর থেকেই উভয় দেশের মধ্যে বন্ধুত্ব বাড়তে থাকে। ১৯৭১ সালে সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে পাক-সেনারা গণহত্যা চালায় চীনের অস্ত্র ব্যবহার করে। বাঙালি নিধন যজ্ঞে চীন পাকিস্তানকে সর্বতোভাবে সাহায্য করে। ভারত বারবার পাক-বর্বরতার বিরুদ্ধে গর্জে উঠলেও চীন নিজেদের অবস্থান বদল করেনি। বরং ভারতকে চোখ রাঙাতেও শুরু করে। কিন্তু ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি চীনের সেই চোখ রাঙানিকে বিন্দুমাত্র গুরুত্ব দেননি। অগণিত মুক্তিযোদ্ধার আত্মত্যাগে স্বাধীনতা লাভ করে বাংলাদেশ। জাতির পিতা শেখ মুজিবুরকে সামনে রেখে বাঙালি সেদিন নিজেদের জাতিকে রক্ষার জন্য রণাঙ্গনে নিজেদের বীরত্ব দেখান। পাকিস্তানি সেনারা মহান মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর যৌথ প্রতিরোধের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। ৩০ লাখ শহীদের বিনিময়ে জন্ম নেয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। বাঙালিকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র উপহার দেন বঙ্গবন্ধু।

পাকিস্তানের বর্বরতার হাত থেকে বাঙালিকে মুক্তি দাতার নাম শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও চীন স্বীকৃতি দিতে চায়নি। বঙ্গবন্ধুর প্রতি চিরকাল অশ্রদ্ধা প্রকাশ করে এসেছে চীনা রাষ্ট্রনায়কেরা। বিশ্বের বহু দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলেও কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনেও আগ্রহ দেখায়নি চীন। বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের ওপর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পরই পাকিস্তানের বন্ধু চীন বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। নিজেদের দেশের লাভের কথা চিন্তা করে চীন এখন বন্ধু সাজার চেষ্টা করলেও বাংলাদেশের মানুষ জানেন মুক্তিযুদ্ধে তাদের অবস্থানের কথা। চীন যে বঙ্গবন্ধুর প্রতি কখনওই শ্রদ্ধাশীল নয়, সেটাও বাঙালি মাত্রই জানেন। সেই চীনেই পাকিস্তান কূটনৈতিক সম্পর্কের ৭০ বছর পূর্তি পালন করতে চলেছে।

কমিউনিস্টশাসিত দেশটিতে চলছে উইঘুর মুসলিমদের ওপর বর্বরোচিত অত্যাচার। আমেরিকা-সহ বিশ্বের বহু অমুসলিম দেশ সেই বর্বরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সরব। কিন্তু মুসলিম দেশ হয়েও নীরব পাকিস্তান। আসলে চীন টাকা দিয়ে কিনে রেখেছে পাকিস্তানের বিবেককে।

পাকিস্তান চীনের মাটিতে তাদের জাতির পিতা জিন্নার মূর্তি বসাবে। এতে আপত্তির কিছুই নেই। যেকোনও দেশই তাদের রাষ্ট্রনায়কদের মূর্তি বসাতেই পারে। ধর্মের সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক নেই। এমনকি, অ-ধর্মের সঙ্গেও মূর্তির কোনও যোগ নেই। চীন বা অন্যান্য কমিউনিস্ট রাষ্ট্রেও রয়েছে মূর্তির প্রচলন। জাতির পিতা সবদেশেই বিশেষ ভূমিকা রাখেন। সব দেশের মানুষই সম্মান করেন তাদের রাষ্ট্রনায়কের মূর্তিকে। কিন্তু বাংলাদেশের জাতির পিতার মূর্তি নিয়ে জামাত বা হেফাজতের আপত্তি নিয়ে কোনও যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। পাকিস্তানের মূর্তি নিয়ে এদের কোনও আপত্তি নেই। তাদের দ্বিচারিতা স্পষ্ট। আসলে পাকিস্তানপন্থীরা বাংলাদেশে ভালো নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ যেভাবে এগিয়ে চলেছে তাতে তাদের পাক-প্রেম বিঘ্নিত হচ্ছে। বাংলাদেশের মাটিতে বসবাস করলেও তাদের হৃদয় বন্দক রয়েছে পাকিস্তানের কাছে। তাই এখনও অখণ্ড পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখে বাংলাদেশের অগ্রগতিতে সুখী নয় তারা। তাই বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যকে কালিমালিপ্ত করতেও কার্পণ্য করেনি নব্য রাজাকারের দল। পাকিস্তান জিন্নার মূর্তি বানালেও এদের ধর্মীয় ভাবাবেগকে আঘাত করে না। কিন্তু শেখ মুজিবুর হলেই তাদের আপত্তি! হাস্যকর ধর্মীয় ব্যাখ্যা।

আসলে নব্য রাজাকাররা আজও বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধী। বঙ্গবন্ধুর মূর্তিতে আঘাত আসলে কোনও ধর্মীয় আবেগের বহিঃপ্রকাশ নয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ওপরই আঘাত আনার কল্পবিলাস মাত্র। তাই কড়া হাতে দেশদ্রোহীদের দমন করাটাই রাষ্ট্রের মহান কাজ। ধর্মের মোড়কে মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি আজও সক্রিয়। পাকিস্তানের দালালদের স্বাধনীতার সুবর্ণ জয়ন্তী ও পবিত্র মুজিববর্ষে খুঁজে বের করে কঠোর শাস্তি দেওয়াই বাঙালির কর্তব্য। মনে রাখতে হবে, মহান রাষ্ট্রনায়কদের ভাস্কর্যের সঙ্গে অন্য কোনও ধর্মের মিল বা অমিল খুঁজতে চাওয়াটাই মুর্খামি। কারণ প্রায় সব মুসলিম দেশেই রয়েছে দেশনায়কদের মূর্তি। অমুসলিম দেশও এর ব্যতিক্রম নয়।

বিডি প্রতিদিন/কালাম

সর্বশেষ খবর