২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০৭:০৮

বারে বারে ট্রাম্প তুমি খেয়ে যাও ধান

ড. মোস্তফা সারওয়ার

বারে বারে ট্রাম্প তুমি খেয়ে যাও ধান

ড. মোস্তফা সারওয়ার

১৩ ফেব্রুয়ারি সিনেটের ইমপিচমেন্ট বিচার সমাপ্ত হল। যথেষ্ট প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও ট্রাম্পকে দোষী সাব্যস্ত করা গেল না। সংবিধান অনুযায়ী ইমপিচমেন্টের জন্য প্রয়োজন ছিল কমপক্ষে ৬৭টি ভোট। পার্টি লাইনের ভোটে সব ডেমোক্র্যাটদের পঞ্চাশ এবং রিপাবলিকানদের সাতটি মিলে সর্বমোট সাতান্ন ভোট ছিল ইমপিচমেন্টের পক্ষে আর বাকী রিপাবলিকান তেতাল্লিশ ভোট বিপক্ষে। দলীয় ভিত্তিতে বর্তমানে তীব্রভাবে বিভক্ত যুক্তরাষ্ট্রে এমনি ঘটবে এটা আগেই আঁচ করা যাচ্ছিল। অতীতে এর নিদর্শন রয়েছে। 

১৭৯৮ সালে সিনেটর উইলিয়াম ব্লাআউন্ট (William Blount) সিনেট থেকে বরখাস্ত হওয়ার পরও সিনেটে তার বিচার হয়েছিল। কিন্তু সে দোষী সাব্যস্ত হয়নি। তার দলের সিনেটররা নিরপেক্ষতা জলাঞ্জলি দিয়ে তার পক্ষে ভোট দিয়েছিল। অতীতে ঠিক এমনি আরেকবার ঘটেছিল ১৮৭৬ সালে যুদ্ধ মন্ত্রী উইলিয়াম বেলন্যাপ (William Belknap) এর ব্যাপারে।  ইমপিচমেন্ট বিচারের আগেই সে পদত্যাগ করেছিল। তথাপি তার ইমপিচমেন্ট বিচার সম্পন্ন হয়েছিল। কিন্তু ব্লাআউন্টের মতই তার সাজা হয়নি পার্টি লাইন ভোটে।

প্রেসিডেন্ট এ্যানড্রু জনসন (Andrew Johnson)  হল যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট যাকে ইমপিচ করা হয়েছিল ১৮৬৮ সালে। কিন্তু সিনেটের বিচারে তার শাস্তি হয়নি। সাম্প্রতিক ১৯৯৯ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারি সিনেটে ইমপিচমেন্টের বিচার হয়েছিল প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের। তখনও সাজা হয়নি। ট্রাম্পের ব্যাপারে দুই বার একই ঘটনা ঘটল। ইমপিচমেন্ট জন্য রয়েছে দুটো পদক্ষেপ। 

প্রথমটি হল কংগ্রেসের নিম্ন কক্ষে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে পাশ করতে হবে ইমপিচমেন্ট আর্টিক্যাল। দ্বিতীয় পদক্ষেপে সিনেটে হবে ইমপিচমেন্ট আর্টিক্যাল অথবা নির্দিষ্ট অপরাধের জন্য বিচার। এ বিচারে নিম্ন কক্ষের পক্ষ থেকে বাছাই করা কংগ্রেস সদস্যরা প্রসিকিউটর হিসেবে সিনেটে অভিযোগ উত্থাপন করবে আর তার সমর্থনে সাক্ষী ও যুক্তি প্রয়োগ করবে। দুই তৃতীয়াংশ অর্থাৎ ৬৭ জন সিনেটর অভিযোগের পক্ষে ভোটদান করলেই প্রেসিডেন্টের অথবা উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের অপরাধ প্রমাণিত হবে এবং অপসারণ ধার্য হয়ে যাবে। এর পর সিনেট ইচ্ছে করলে দোষী (convicted) প্রেসিডেন্ট অথবা উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদেরকে শুধু অপসারণ নয়, তার চেয়ে অধিক শাস্তি প্রদান করতে পারে। এই পর্যায়ে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্থাৎ ৫১ ভোটে দোষীকে চিরতরে অযোগ্য করা যাবে যে কোন সরকারি পদ, সম্মান, ট্রাস্ট অথবা লাভজনক প্রতিষ্ঠানের পদ থেকে। ৫১ ভোটের দ্বিতীয় ধাপ প্রয়োগের জন্য বাধ্যতামূলক পূর্বশর্ত হল ৬৭ ভোট অর্জনের মাধ্যমে অভিযুক্তকে প্রথমে দোষী সাব্যস্ত করা। ১৩ ফেব্রুয়ারি সিনেটের ইমপিচমেন্ট বিচারে ট্রাম্পের অপরাধ প্রমাণিত হয়নি অতএব তাকে নির্বাচন থেকে বিরত রাখার সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট গ্রহন করা গেল না।

যুক্তরাষ্টের ইমপিচমেন্টের ইতিহাসে আমরা একটা প্যাটার্ন অতি সহজেই লক্ষ্য করতে পারি। দলীয় আনুগত্যের কারণে কংগ্রেসের নিম্ন কক্ষে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সহজেই ইমপিচ করা যাবে। দুই তৃতীয়াংশ অর্থাৎ ৬৭ জন সিনেটর পদে কোন দলের বিজয় প্রায় অসম্ভব। তাই অপরাধের সরাসরি প্রমাণ থাকলেও সিনেটে শাস্তি দেওয়া মোটামুটি অসম্ভব। অতএব মোদ্দা কথায় এটা বিচারের নামে প্রহসন ছাড়া অন্য কিছু নয়। যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর লক্ষ কোটি মানুষ টেলিভিশনের পর্দায় ৬ জানুয়ারির ঘটনা দেখেছে ঠিক যখন এই ভয়ংকর ব্যর্থ অভ্যুত্থান ঘটছিল। এই ঘটনার আগের দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে অনেকেই পর্যবেক্ষণ করছিল ট্রাম্পের উদ্দেশ্য প্রণোদিত এবং সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ। নির্বাচনে জয়ী না হলেও সে যেন জোরপূর্বক ক্ষমতা দখল করে একনায়কত্ত্ব কায়েম করতে পারে সেজন্য অনবরত মিথ্যাচার করে যাচ্ছিল। নির্বাচনী বোর্ড, স্টেট পর্যায়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, সুপ্রিম কোর্ট সহ বিভিন্ন স্তরের আদালত, বিচার বিভাগ এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গুলর উপর অন্যায় দাবি ও জোড় পূর্বক বাইডেনের লক্ষ লক্ষ ভোট বাতিল করার চেষ্টা চালিয়েছিল। মিথ্যা প্রচার ও সরাসরি প্ররোচনার মাধ্যমে বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গ দুর্বৃত্তদের ট্রাম্প লেলিয়ে দিয়েছিল সন্ত্রাসী আক্রমণে।

সিনেটের পার্টি লাইন ভোটে ট্রাম্প পার পেয়ে গেল। তার অর্থ হল প্রেসিডেন্ট হিসেবে গুরুতর অপরাধ করলে তার দায় দায়িত্ব থাকছে না। ভবিষ্যতে কোন প্রেসিডেন্ট যদি জোর পূর্বক ক্ষমতা দীর্ঘ স্থায়ী করতে চায়, তবে তার পথ উন্মুক্ত হয়ে গেল। যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যতের জন্য এটা একটি অশনি সংকেত। এখন প্রশ্ন হল ট্রাম্পের এই অপরাধের দায় দায়িত্বের শাস্তি স্বরূপ অন্য কোন বিধান অথবা উপায় রয়েছে কিনা। মনে হয় তিনটি পথ খোলা রয়েছে। (১) কংগ্রেসে বস্তুগত ফলাফল বিহীন সেন্সর (censure), অন্য কথায় নিন্দা প্রস্তাব। সাধারণ সংখ্যা গরিষ্ঠতায় কংগ্রেসের দুই কক্ষে অথবা আলাদাভাবে যে কোন কক্ষে এটা পাশ করা যেতে পারে। এর কোন বস্তুগত দন্ড অথবা ফলাফল (material consequences) নেই। রয়েছে শুধু জন সমক্ষে প্রকাশ্য অপমান। ইংরেজিতে বলা হয় পাবলিক শেইমিং (public shaming)। তাই এ ধরণের সাজা ট্রাম্পের জন্য হবে নামকা ওয়াস্তের সাজা যার কোন দাঁত নেই। 

অতীতে ভারত উপমহাদেশে সামাজিক ভাবে প্রচলিত ছিল পাবলিক শেইমিং। বর্তমানে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে শালিস বিচারে পাবলিক শেইমিং আছে বলে শোনা যায়। যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির একজন প্রতিনিধি হিসেবে ১৯৮৬ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনে গিয়েছিলাম। সাংহাই শহরে আমাদের হোটেলের সামনে একটি বিলবোর্ডের প্রতি আমার দৃষ্টি পড়েছিল। পোস্টারে মনে হল একই পরিবারের ছবি। একটু অদ্ভুত ধরণের। চীনা ভাষা বুঝতে পারিনি। গাইডের কাছে জানতে চেয়েছি। সে গম্ভীর কণ্ঠে বলল মাঝখানের করুণ ছবিটি একটি চোরের। চারপাশে আত্মীয় স্বজনদের ছবি। ওটা ছিল নিদারুণ নির্দয় পাবলিক শেইমিং। এটা যুক্তরাষ্ট্রে প্রযোজ্য নয়। যদি হত। পাঠক ভেবে দেখুন, মাঝখানে পরচুলা এবং কমলা রঙের ট্যান বিহীন ট্রাম্প আর চারিদিকে ট্রাম্প জুনিয়র, এরিক, ইভাংকা, মেলানিয়া, জ্যারেড, রুডি জুলিয়ানী এবং স্টর্মি ড্যানিয়েল। 

অনর্গল মিথ্যায় অভ্যস্ত ট্রাম্পের লজ্জা শরম আছে বলে মনে হয় না। চৈনিক ওষধিও নির্ঘাত ফেল মারত বলে মনে হয়। (২) অতএব চলুন দেখা যাক দ্বিতীয় বিকল্প। সংবিধানের চতু্র্দশ সংশোধনীর ৩য় বিভাগ অনুযায়ী সেন্সর। যুক্তরাষ্ট্রের গৃহযুদ্ধের পর রাষ্ট্র্রদ্রোহী এবং পরাজিত কনফেডারেট নেতৃবৃন্দ যাতে কোন গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পদে বহাল হতে না পারে তার নিশ্চয়তা দিয়েছিল উপরোক্ত ধারা। ঐ যুগের পর এই ধারাটি কদাচিৎ আলোচিত হয়েছে। এই ধারা অনুযায়ী কংগ্রেসের উভয় কক্ষে আলাদাভাবে সাধারণ সংখ্যা গরিষ্ঠতায় সেন্সর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যাবে। এর ফলে ট্রাম্পকে ভবিষ্যতে নির্বাচনে অংশগ্রহণে অথবা সরকারি পদে যোগদানে অযোগ্য করা যাবে। ডেমোক্র্যাটিক সিনেটর টিম কেইন (Tim Kaine) এবং রিপাবলিকান সুজান কলিন্স (Susan Collins) এবিষয়ে উদ্যোগ নিচ্ছে। (৩) তৃতীয় বিকল্প হল ক্রিমিনাল ইনডাইটমেন্ট। ইমিউনিটি অথবা রেহাই থাকার জন্য প্রেসিডেন্ট পদে থাকাকালীন সময়ে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে কোন ক্রিমিনাল অভিযোগ দেওয়া যায়নি। যে মুহূর্তে সে প্রেসিডেন্ট পদে বহাল নেই, তারপর থেকেই অতীতের কৃত অপরাধের বিচারের অভিযোগ গঠন করা যায়। ঘটনা ঘটার পাঁচ বছরের মধ্যে বিচার শুরু করতে হবে। এটাকে বলা হয় স্ট্যাটিউট অব লিমিটেশন (Statute of Limitation)। 

৯ ফেব্রুয়ারির এক প্রবন্ধে কংগ্রেসের নিম্নকক্ষের জুডিসিয়ারী কমিটির প্রাক্তন কৌঁসুলি (Counsel) মাইকেল কনওয়ে (Michael Conway) মতামত দিয়েছে, সিনেটের বিচারে ট্রাম্পের সাজা হয়নি অতএব তার বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল বিচারের ব্যবস্থা করা যাবে। সিনেটের রিপাবলিকান নেতা মিচ মেকনাল ১৩ ফেব্রুয়ারি সিনেটের বক্তৃতায় ক্রিমিনাল বিচারের ইঙ্গিত দিয়েছে। ট্রাম্প বিরোধী কৌঁসুলিরা এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিচ্ছে।এছাড়াও নিউ ইয়র্ক, জর্জিয়াসহ অন্যান্য স্টেটে মামলা টুকে দেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।

১৭ ফেব্রুয়ারি এনবিসি (NBC) নিউজের চার এ্যাডামস (Char Adams) প্রতিবেদনে জানিয়েছে, মিসিসিপি থেকে নির্বাচিত কংগ্রেস সদস্য বেনি টমসন (Benni Thompson) এবং এনএএসিপি (NAACP) যৌথভাবে একটি দেওয়ানী মকদ্দমা দিচ্ছে ১৮৭১ সালে গৃহীত কু ক্লাক্স ক্ল্যান এ্যাক্ট অনুযায়ী। এই মকদ্দমায় আসামি হচ্ছে ডোনাল্ড ট্রাম্প, রুডি জুলিয়ানী, বর্ণবিদ্বেষী শ্বেতাঙ্গ সংগঠন প্রাউড বয়েজ (Proud Boys) এবং ওথ কিপারস্ (Oath Keepers)। যুক্তরাষ্ট্রে গৃহযুদ্ধের পর পুনর্গঠনের সময়কালে ঘৃণা কারবারি বর্ণবাদী সংগঠনগুলকে শক্তি প্রয়োগ, ভীতি প্রদর্শন ও হুমকি দ্বারা নেতৃস্থানীয় কর্মকর্তাদের সরকারি কাজ সম্পাদনে বাধা সৃষ্টির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার আইন। এই আইন এখনও বহাল রয়েছে। কংগ্রেস সদস্য বেনি টমসনের মকদ্দমাটি খুবই জোড়াল। ভীতি প্রদর্শন, হুমকি ও হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে টমসনের ৬ জানুয়ারির ভোট গণনা কাজে অভ্যুত্থানকারীরা জোরপূর্বক বাধার সৃষ্টি করেছিল। ট্রাম্প ও জুলিয়ানী ইন্ধন, উসকানি এবং নেতৃত্ব দিয়েছিল। দুষ্কৃতিকারীদের মধ্যে যারা ধড়া পড়েছে তাদের অনেকেই রাজসাক্ষী হতে চাচ্ছে। আরও অনেক মামলা দায়ের করা হবে।  মনে হচ্ছে এবার ট্রাম্প ধরা খেয়ে যাচ্ছে। টেফলন ট্রাম্প সব সময় পিছলে যায়। এবার মনে হয় ডেমোক্র্যাট এবং এস্টাবলিস্টমেন্ট রিপাবলিকানরা মনের আনন্দে বাংলা ভাষায় কবিতা আবৃত্তি করবে বিশ্ব মাতৃভাষার মাসে! 'বারে বারে ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান, এবার ঘুঘু তোমার কাটব দুই কান'।

লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক এবং সাবেক উপ-উপাচার্য, ইউনিভার্সিটি অব নিউ অরলিয়েন্স।

বিডি-প্রতিদিন/বাজিত হোসেন

সর্বশেষ খবর