শিরোনাম
৮ মার্চ, ২০২১ ১৪:৪৫

আমেরিকায় ট্রাম্পের ষড়যন্ত্র তত্ত্বের কবর রচনা?

ড. মোস্তফা সারওয়ার

আমেরিকায় ট্রাম্পের ষড়যন্ত্র তত্ত্বের কবর রচনা?

ড. মোস্তফা সারওয়ার

ডোনাল্ড ট্রাম্পের উপাসনাকারী কিউআননদের ধারণা ছিল ট্রাম্প ৪ মার্চ যুক্তরাষ্টের ১৯তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে অভিষিক্ত হবে। ‘থ্রী পারসেন্টারস’ নামে এক বর্ণবিদ্বেষী শ্বেতাঙ্গ দল ৫০ হাজার সশস্ত্র সদস্য এবং ষড়যন্ত্র তত্ত্বে বিশ্বাসী অন্যদের নিয়ে ক্যাপিটল হিল আক্রমণ এবং দখল করে ট্রাম্পকে ক্ষমতায় বসাবে। ক্যাপিটল পুলিশ প্রধান পিটম্যান জানিয়েছিলেন পুলিশ বাহিনীর সাথে ৫০০০ সৈন্য প্রস্তুত রয়েছে আক্রমণকারীদের প্রতিহত করার জন্য। সাবধানতা হিসেবে কংগ্রেসের নিম্ন কক্ষ অধিবেশন ৪ মার্চ স্থগিত করেছিল। যদিও সিনেট তার অধিবেশন অব্যাহত রাখে টানটান উত্তেজনার মধ্যেই। পরিশেষে ষড়যন্ত্র তত্ত্বে বিশ্বাসীদের স্বপ্ন-বিলাসের কবর রচনা হল। ৪ মার্চ ট্রাম্পের আর প্রেসিডেন্ট হওয়া হল না। সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটলো দু’বার ইমপিচ হওয়া ট্রাম্পের সর্বশেষ ষড়যন্ত্র। ৬ জানুয়ারির মত জঙ্গি হামলা চালানোর ষড়যন্ত্র করা হচ্ছিল বলে এফবিআই ও হোমল্যান্ড সিকিউরিটি ডিপার্টমেন্টের বুলেটিনে সকলকে সতর্ক করা হয়েছিল। এ নিয়ে সর্বত্র এক ধরনের আতংক বিরাজ করছিল। তবে কর্তৃপক্ষ সজাগ দৃষ্টি রাখায় ষড়যন্ত্রকারিরা আবির্ভূত হয়নি ক্যাপিটল হিলে দূরের কথা, যুক্তরাষ্ট্রের কোথাও।

উল্লেখ্য, ১৭৯৩ থেকে ১৯৩৩ সালের মধ্যে বেশ কবার প্রেসিডেন্টরা শপথ নেন ৪ মার্চ। সে আলোকে এবার গণধিকৃত ট্রাম্পের উগ্রপন্থিরা ফন্দি এঁটেছিল পুনরায় ক্যাপিটল হিলে হামলা চালিয়ে ট্রাম্পকে দ্বিতীয় মেয়াদের প্রেসিডেন্ট হিসেবে অভিষিক্ত করবেন। এনিয়ে কিউআনন গ্রুপের পক্ষ থেকে সাংগঠনিক তৎপরতাও চালানো হয় বিভিন্ন পর্যায়ে। 

গণতন্ত্রের বিজয় ঝান্ডা উড্ডীন থাকলো ক্যাপিটল হিল এবং হোয়াইট হাউজে। ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হলো গণতন্ত্র এবং শান্তির শত্রুরা। তাদের বিশ্বাস ৩ নভেম্বরের নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী বাইডেনের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে ২০ জানুয়ারির অভিষেক ভুয়া এবং বেআইনি।  ক্যাপিটল হিলে ৬ জানুয়ারির ব্যর্থ অভ্যুত্থানে কিউআনন 'স্টপ দ্যা স্টিল' ব্যানারে অন্যান্য বর্ণবিদ্বেষী শ্বেতাঙ্গ অস্ত্রধারীদের সাথে নেতৃত্ব দিয়েছিল। ওদের বিশ্বাস ছিল সামরিক বাহিনী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ট্রাম্পকে ক্ষমতা দখলে সাহায্য করবে। হিলারি ক্লিনটন, বারাক ওবামা, ন্যান্সি পলোসি, জর্জ সোরস, বিল গেইটস, অপরা উইনফ্রি, টম হ্যাঙ্কস এবং অন্যান্য বুদ্ধিজীবী এবং ডেমোক্র্যাটিক নেতাদের ফাঁসি দেওয়া হবে। বাকী শত্রুদের গ্রেফতার করে পাঠানো হবে গুয়ান্তানামো বের কারাগারে। ৬ জানুয়ারির  অভ্যুত্থানের ব্যর্থতার পরও আশা ছাড়েনি কিউআননের থিওরেটিশিয়ানরা। 

রয়টার্সের খবর অনুযায়ী মিশেল অ্যান টিটলার নামে এদের একজন জানিয়েছিলেন, ৪ মার্চ দ্বিতীয় অভ্যুত্থানে সব শত্রুদের হত্যা এবং গ্রেফতারের পর ট্রাম্পকে যুক্তরাষ্টের ১৯তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে অভিষিক্ত করা হবে। কিউআননের থিওরেটিশিয়ানদের মত অনুযায়ী ১৮তম প্রেসিডেন্ট ইউলিসিস গ্রান্ট হল যুক্তরাষ্টের শেষ বৈধ প্রেসিডেন্ট। ১৮৭১ সালের ১৮তম সংশোধনী যুক্তরাষ্টকে একটি কর্পোরেশনে পরিণত করেছে। আগামী ৪ মার্চের দ্বিতীয় অভ্যুত্থান এবং  ট্রাম্পের অভিষেকের মাধ্যমে অতীত অনাচারের বিহিত করা হবে। উপরোক্ত গাঁজাখোরী ধারণা কিউআননের থিওরেটিশিয়ানরা ধার করেছিল ‘সার্বভৌম নাগরিক’ নামের আরেক দল বর্ণ বিদ্বেষীদের কাছ থেকে।

প্রসঙ্গত: উলে­খযোগ্য একটি খবর জানিয়েছিল ফোরবস ম্যাগাজিন। ৪ মার্চের অনুমিত ট্রাম্পের অভিষেক অনুষ্ঠানে প্রচুর জন সমাবেশ হবে এবং  ট্রাম্প ওয়াশিংটন ইন্টারন্যাশনাল হোটেলের চাহিদা বেড়ে যাবে এই ভুয়া প্রত্যাশায় ৩ ও ৪ মার্চের ভাড়া তিনগুণ বাড়িয়েছিল। ৬ জানুয়ারির কিউআনন ও অন্যান্য বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গদের অভ্যুত্থানের সময়ও ভাড়া অনেকগুণ বাড়িয়েছিল।

ট্রাম্পের শাসনকালে কিউআনন নামে এক হাস্যকর ষড়যন্ত্র তত্ত্ব যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। এটা এমন ধরনের পাগলামি যে মনে হবে এর অনুসারীরা শক্তিশালী নেশায় বুদ হয়ে আছে। অন্যদিকে, এই তারা ভয়ঙ্কর বিধ্বংসী রূপও ধারণ করতে পারে। এর নিদর্শন আমরা দেখলাম ক্যাপিটল হিলে ৬ জানুয়ারির ব্যর্থ অভ্যুত্থানে।

কিউআনন হল ইন্টারনেটে বহুল প্রচারিত কতিপয় ষড়যন্ত্র তত্ত্বের সমাহার। অনুসারীদের বিশ্বাসের কেন্দ্রে রয়েছে এক অলীক চিন্তাধারা। এইসব ভুয়া তত্ত্ব অনুযায়ী এক ক্ষুদ্র এবং গুপ্ত কুচক্রীদের দ্বারা পৃথিবী পরিচালিত হচ্ছে; বিশেষ করে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী এবং ধনী দেশ যুক্তরাষ্ট্র। এরা শুধু শিশুদের ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হয় না। এরা শিশুদের জবাই করে তাদের মাংস ভক্ষণ করে এবং রক্ত পান করে। রক্তপানের মূল কারণ হল শিশুদের রক্ত হোতে এড্রেনোক্রোম নামে এক ধরনের ক্যামিকেল নিষ্কাসন করে তা গলাধঃকরণ করে। এই অলীক আচার পদ্ধতির মাধ্যমে কুচক্রী দল তাদের আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি করে। 

পাঠক! আপনারা এই মুহূর্তে বুঝতে পারছেন এই ষড়যন্ত্র তত্ত্ব যদি সত্যি হয় তাহলে তা কতখানি ভয়ঙ্কর। ভাবতে ও গা শিউরে উঠে। ১৯৬০ এর শেষ দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের হাসপাতালে মৃত ব্যক্তিদের কলিজা ও মাংস ভক্ষণ করত খলিলুলাহ নামের এক ডোম। আমার খেয়াল আছে তখন আতঙ্কে অনেকের ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছিল। পাঠক আরও নিদারুনভাবে বিস্মিত হবেন যখন জানাবো এই শিশু খেকো মনুষ্য রুপী কারা। 

ভুয়া ষড়যন্ত্র তত্ত্ব অনুযায়ী এরা হল হিলারি ক্লিনটন, বারাক ওবামা, জর্জ সোরস, বিল গেইটস, অপরা উইনফ্রি, টম হ্যাঙ্কস, পোপ ফ্রান্সিস, দালাইলামা, এবং যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ঊর্ধ্বতম নেতৃবৃন্দ। এরা শিশুদের ধর্ষণ করে, হত্যা করে, এবং পরে তাদের মাংস ভক্ষণ করে এবং রক্ত পান করে। এই ভুয়া তত্ত্বের এখানেই শেষ নয়। কিউআনন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব অনুযায়ী প্লেন দুর্ঘটনায় মৃত জন এফ কেনেডি জুনিয়র এখন ও বেঁচে আছে; আত্মগোপনে রয়েছে। কাবাল বিধ্বংসী মহানায়কের সাথে ঠিক মোক্ষম সন্ধিক্ষণে যোগদান করার জন্য। পাঠক, আপনারা শুনে অবাক হবেন কে এই মহানায়ক। ধৈর্য ধারণ করুন, অচিরেই আপনাদের কাছে প্রকাশ করব।

ষড়যন্ত্র তত্ত্বের অনুরাগীরা আরও বিশ্বাস করে ইউ.ইফ.ও অথবা শনাক্ত-হীন উড়ন্ত বস্তু যারা অন্য নীহারিকার গ্রহ নিবাসী এবং মাঝেমাঝে মহাকাশ বিচরণের সময় পৃথিবীতে আসে সরাইখানায় বিশ্রামের নিমিত্ত। কিউআনন আগ্রহীরা আরও বিশ্বাস করে যে নাইন ইলিভেনে যে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ও পেন্টাগন ধ্বংস হয়েছিল, তাতে হাত ছিল “ডীপ স্টেট” নামে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ভিতর লুক্কায়িত কাবাল অথবা কুচক্রীদের। কিউআনন ষড়যন্ত্র ধীরে ধীরে এক নতুন ধর্মবিশ্বাসে পরিণত হয়। এই ধর্মবিশ্বাসীদের কাছে একটি সর্বজনীন কল্যাণকর আদর্শ হয়ে দাঁড়ায় শিশুদের ধর্ষণ ও হত্যা থেকে রক্ষা করা। সবচেয়ে হাস্যকর ব্যাপার হল- কিউআনন ধর্মবিশ্বাসীদের কাছে মহানায়ক হলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। 

কিউআনন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ভীষণ হাস্যকর। নেকড়ে বাঘকে শিশুদের খাঁচায় ঢুকিয়ে দিলে কি হয় তা সকলেরই জানা। আরও হাস্যকর হল ট্রাম্পকে নাকি ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী ক্ষমতায় বসিয়েছে এবং এই বাহিনীর সেনাপতির ছদ্ম নাম হোল কিউ। কিউআনন ম্যাসেজ বোর্ডে এই অসাধারণ মানব ও শিশু হিতৈষী সেনাপতি কিউ ড্রপ নামে এক ধরনের ‘ক্রিপটিক’ অথবা গোপন বার্তা প্রকাশ করে। তার উর্বর মস্তিষ্ক উদ্ভূত গুপ্ত অসম্পূর্ণ বাক্যগুলো সে প্রকাশ করে প্রথম ফোরচ্যান, তারপর এইটচ্যান, এবং সর্বশেষ এইটকুন নামক ম্যাসেজ-বোর্ডে। ম্যাসেজ বোর্ড হল ইন্টারনেটে উপলব্ধ এক ধরনের ওয়েবসাইট যেখানে সদস্যরা প্রবেশাধিকার পায়। তখন তারা পড়তে পারে বিবিধ টাঙ্গানো লেখা অথবা পোস্টিং এবং নিজেদের লেখা টাঙ্গাতে অথবা পোস্ট করতে পারে। কিউআনন ধর্মবিশ্বাসীদের কাছে কিউর গুপ্ত অসম্পূর্ণ বাক্যগুলো বাইবেল তুল্য। এরা এতই অন্ধ ভক্ত হয়ে যায় যে এরা কাজ কর্ম, লেখাপড়া, পারিবারিক ও সামাজিক দায়িত্ব ভুলে কিউ’র গুপ্ত তথ্য আবিষ্কারে মগ্ন হয়ে যায়। এক সময় এটা হয়ে যায় নেশাগ্রস্থ ভিডিও গেইমের মতো। গুপ্ত বাক্যগুলোর অর্থ খোজা হয়ে যায় ধাঁধাঁর রহস্য সমাধান করার মত রোমাঞ্চকর। তাহলে দেখা যাচ্ছে কিউআনন ষড়যন্ত্র তত্ত্বে রয়েছে দুটো উপাদান (১) অন্ধ ধর্ম বিশ্বাস যার গভীরে রয়েছে শিশুদের রক্ষা করার মহান আদর্শ এবং (২) ধাঁধাঁর রহস্য সমাধান করার মতো রোমাঞ্চকর উত্তেজনা। আর যায় কোথায়? যুক্তরাষ্ট্র সহ গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে কিউআনন ধর্মবিশ্বাসীরা। সবচেয়ে কৌতুকপ্রদ যে এই নব্য ধর্মের পয়গম্বর হলে ডোনাল্ড ট্রাম্প।

এখন দেখা যাক কখন শুরু হয়েছিল এই আজগুবি ভুয়া ষড়যন্ত্র তত্ত্ব কিউআনন। ১৯১৭ সালের অক্টোবরে ইন্টারনেটের ফোরচ্যান ম্যাসেজ-বোর্ডে বেনামীতে একটি প্রজ্ঞাপন প্রকাশিত হয় যার নাম ছিল। এই প্রজ্ঞাপনকারীই নিজেকে উঁচু পর্যায়ের গোয়েন্দা হিসেবে দাবী করেছিল। ‘ডীপ স্টেট’ এবং বিশ্ব কাবালের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের যুদ্ধের গোপন দলিল দস্তাবেজ অনুশীলন করার অধিকার তার রয়েছে এটাই ছিল তার দাবী। এই গুপ্ত প্রজ্ঞাপনকারীই কিউ নামে পরিচিত।

এবার গুপ্ত কিউ’র পরিচয় উদঘাটন করার চেষ্টা করা যাক। জেমস ওয়াটকিন্স যুক্তরাষ্ট্র সেনাবাহিনীর প্রাক্তন সিনিয়র নন-কমিশন্ড অফিসার। ১৯৯৮ সালে সেনাবাহিনীতে কর্মরত অবস্থায় ইন্টারনেটে এশিয়ান বিকিনি বার নামে একটি জাপানী পর্নোগ্রাফিক ওয়েবসাইট যুক্তরাষ্ট্রে খুলেছিল। জাপানে পর্নোগ্রাফির বিরুদ্ধে কড়াকড়ি আইন। এই আইনি বাঁধাকে পাশ কাটানোর জন্যই যুক্তরাষ্ট্রের শিথিল আইনে এটা করেছিল জেমস ওয়াটকিন্স। এই লোক একসময় খুলেছে শিশু পর্নোগ্রাফির আরও ওয়েবসাইট। বিভিন্ন নামজাদা সংবাদ মাধ্যমে ইঙ্গিত রয়েছে শিশুদের নিয়ে অশ্লীল ছবি ও ভিডিওর উপলভ্য-কারী এই লোকই হল কিউ অথবা সে জানে সত্যিকার কিউ'র পরিচয়। কেননা জেমস ওয়াটকিন্স ও তার ছেলে রন ওয়াটকিন্স (এশিয়ান আমেরিকার জাতিভুক্ত) কিউআননের গুপ্ত অথবা ক্রিপটিক ওয়েবসাইটগুলো ফোরচ্যান, এইটচ্যান, এবং এইটকুনের মালিক ও ম্যানেজার। পাঠকবৃন্দ লক্ষ্য করুন যৌন কাজে শিশু পাচারের বিরুদ্ধে ক্রুসেড ঘোষণাকারী কিউআননের কিউ সম্ভবত: একজন শিশু পর্নোগ্রাফির উপলভ্য-কারী। আর এই ক্রুসেডের মহান নায়ক ডোনাল্ড ট্রাম্প হল নব-ধর্ম কিউআননের পয়গম্বর।

কিউআনন ষড়যন্ত্রের মধ্যে রয়েছে বিচিত্র ধরনের লোকজন বিভিন্ন দেশে। এদের সংখ্যা হবে লক্ষ লক্ষ। সঠিক সংখ্যা এখনও জানা যায়নি। তবে ফেইসবুক গত বছর আগস্টে পেয়েছে কয়েক মিলিয়ন অনুসারী। গার্ডিয়ান, ফেইসবুক ও ইন্সটাগ্রাম অনুসরণ করেছে সাড়ে চার মিলিয়ন। পাঠক, এদের পরিচয় সম্পর্কে কিছুটা আচ করতে আমি আপনাদের কাছে তুলে ধরব চারজন অনুসারীর কাহিনী।

একজন অস্ট্রেলিয়ার অধিবাসী জিতার্থ জাদিজা। তার মা হল দিল্লীর আর বাবা গুজরাটের। তিরিশ বছর আগে অস্ট্রেলিয়ায় অভিসংশিত হয়েছে। হিন্দুধর্মে বিশ্বাসী জিতার্থ ২০১২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিল এক্সচেঞ্জ ছাত্র ভিসায়। একটু সময়ের মধ্যেই সে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির প্রতি আসক্ত হোয়ে পড়ে। বাংলা সাহিত্যের ‘আদু ভাই’ হল জিতার্থ। স্নাতক ডিগ্রী লাভে তার লেগেছে ১৫ বছর। তার উপর রয়েছে তার মৃগীরোগ, এডিএইচডি, এবং বাইপোলার রোগ। প্রথম দিকে সে ট্রাম্পকে পছন্দ করত না। নৈরাজ্যবাদী, নিঃসঙ্গ, বিচ্ছিন্ন জিতার্থ ক্রমশ ভক্ত হয়ে পড়ে টেক্সাসের ষড়যন্ত্র তত্ত্বের প্রচারক রেডিও টক শো হোস্ট ইনফোওয়ারস এর অ্যালেক্স জোন্সের প্রচারণায়। এই পথ ধরে সে কিউআনন ষড়যন্ত্র তত্ত্বের অন্ধ অনুসারীতে পরিণত হয়, ভক্ত হয়ে পড়ে ট্রাম্পের এবং এদের সকল প্রচারণা, ফেইসবুক পোস্টিং ও অন্যান্য মাধ্যমের প্রচারণা শুনে আর দেখে দিনের প্রায় সব সময়টাই কাটাতে থাকে। হারিয়ে ফেলে বন্ধুদের। আত্মীয়রা দূরে সরে যায়। সে ভাবত প্রলয় অথবা কেয়ামত এসে গেছে।

অন্য এক চরিত্র যার জন্মগত নাম আলি আব্দুল রাজাক আকবর। আফ্রোআমেরিকান মায়ের নাম লাইডিয়া লাইনেট ডিউ এবং পিতার নাম আব্দুল রাজাক মাহদ আকবর। পিতা মুসলিম। জাতিগত ভাবে সম্ভবতঃ মধ্যপ্রাচ্যের। আলি আকবর নাম পরিবর্তন করে বর্তমানে আলি আলেকজান্ডার নামে পরিচিত। আলি খৃষ্ট ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছে। তার খৃষ্ট ধর্মে তরিকা হল সাদার্ন ব্যাপ্টিস্ট। ২০০৬ সালের নভেম্বরে টেক্সাসের ফোর্ট ওয়ার্থের এক মহিলার বাড়ীতে কয়েকবার চুরি করে। ঐ বছর ডিসেম্বরে আলি একজন পুরুষ লোকের গাড়ী ভেঙ্গে তার ক্রেডিট কার্ড চুরি করে এবং ঐ কার্ড ব্যবহার করে চারশত ডলার উঠাতে চেষ্টা করে। ফোর্ট ওয়ার্থে ২০০৭  সালের ১৮ আগস্ট তাকে গ্রেফতার করা হয় দুটি গুরুতর অপরাধে; গাড়ী ভাঙ্গা এবং ক্রেডিট কার্ড চুরি করা। এরপর তিনি রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করল। সে বাছাই করল রিপাবলিকান পার্টি। রাতারাতি তার কপাল খুলে গেল। আমি বিস্মিত হয়েছি- তিনি যে তিনটি শহরে বাস করেছে তার মধ্যে অন্যতম ব্যাটন রুজ, অনেক প্রবাসীর বাসস্থান লুইজিয়ানা স্টেটের রাজধানী। ইন্টারনেটে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আলির অনেক ছবি, কোনটায় সাথে রয়েছে লুইজিয়ানার প্রাক্তন গভর্নর ববি জিন্দাল অথবা সিনেটর ক্যাসিডি অথবা প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট প্রার্থী এবং বর্তমান সিনেটর মিট রমনি। ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে অসংখ্য ছবি রয়েছে বিভিন্ন স্থানে বিবিধ সময়ে। আলি দেখতে অনেকটা স্যামি ডেভিস জুনিয়রের মত। বহু বছর আগে ঐ ভদ্রলোক ছিল নামকরা নৃত্যশিল্পী ও গায়ক। ট্রাম্প আদর করে আলিকে সম্বোধন করে স্যামি ডেভিস জুনিয়র বলে।

লুজিয়ানা স্টেটে ডেমোক্র্যাটিক গভর্নর জন বেল এডওয়ার্ডের কমিশনার অব এডমিনিস্ট্রেশন হোল রিপাবলিকান যে ডারডেন। ২০১৫ সালে ডারডেন ছিল গভর্নর এডওয়ার্ডের প্রতিদ্বন্দ্বী। মজার ব্যাপার হল আলি ছিল ডারডেনেরে নির্বাচন পরিচালনার ডিজিটাল ডিরেক্টর। গত ছয় বছরের অন্তত: পাঁচ বছর বাস করেছে ব্যাটন রুজে। আলি হাজার হাজার ডলার হাতিয়ে নিয়েছে রিপাবলিকান ধনকুবেরদের কাছ থেকে। হেজ ফান্ড বিলিওনেয়ার রবার্ট মার্সারের কাছ থেকে এক দাগে মেরে দিয়েছে এক লক্ষ পঞ্চান্ন হাজার ডলার। বর্তমানে পলাতক আলি তার নিরাপত্তার জন্য ভক্তদের কাছে চাঁদা আবদার করেছে দিন প্রতি দুই হাজার ডলার। সে জানিয়েছে ডাকিনী এবং ডাইনীরা তাকে আশরা এবং আক্রমণ করার চেষ্টা করছে। এই আলি ছিল ৬ জানুয়ারির কিউআনন আয়োজিত ট্রাম্পের অনুকূলে 'স্টপ দ্যা স্টিল' আন্দোলনের প্রধান নেতা। আলির অনুসারীরা উন্মাদের মত ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ক্যাপিটল হিলে।

কিউআনন ষড়যন্ত্র তত্ত্বের আরেক উজ্জ্বল তারকা হলেন- ট্রাম্প সরকারের এককালীন নিরাপত্তা উপদেষ্টা লেফটেনেন্ট জেনারেল মাইকেল ফ্লিন। এফবিআই এর কাছে রাশিয়ার সাথে তার সম্পর্ক নিয়ে মিথ্যা বলার জন্য সে হয়েছিল দাগী আসামি। ট্রাম্প ফ্লিনকে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শন করে তার হোয়াইট হাউজ ছাড়ার আগে। শিশু-খেকো গুপ্ত চক্র অথবা কাবালকে বর্ণনা করতে এই লোক ব্যবহার করেছিল ‘ডিপ স্টেট’। এটাই পরে কিউআনন দর্শনের মূল ভিত্তি হোয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২০ সালের ৪ জুলাই ফ্লিন কিউআননের প্রচলিত শপথ উচ্চারণ করেছিল সম্মিলিতভাবে তার সাগরেদদের সঙ্গে। অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ফ্লিন ট্রাম্পকে উস্কানি দিচ্ছিল সামরিক আইন জারি করে ক্ষমতা দখল করতে।

কিউআনন ষড়যন্ত্রের হাত কতটুকু লম্বা তা বোঝার জন্য এখন আসা যাক ২০২০ সালের ৩ নভেম্বরের নির্বাচনে। মিডিয়া ম্যাটার্স এর বর্ণনা অনুযায়ী ৭৭ জন রিপাবলিকান কংগ্রেস প্রার্থী কিউআনন ষড়যন্ত্রের মত এক ভুয়া হাস্যকর তত্ত্বের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছিল। এর মাঝে দুই জন মার্জারী টেলর গ্রিন এবং লরেন বোবার্ট নির্বাচনে জয়ী হয়ে কংগ্রেসের সদস্যপদ লাভ করেছে। কিউআনন বিশ্বাসী গ্রিন লুকিয়ে রাখা যায় এমনি রিভলভার সাথে নিয়ে কংগ্রেসের অধিবেশনে আসত। তার ব্যবহার ভীষণ উগ্র। তাই তার পাশের অফিসের কংগ্রেস সদস্যা কোরি বুশ প্রাণ ভয়ে তার অফিস সরিয়ে নিয়েছে। স্পিকার পলোসি আগ্নেয় অস্ত্র নিয়ে কংগ্রেস কক্ষে প্রবেশ নিষেধ করার পরও গ্রিন মেটাল ডিটেক্টর জোর করে পাড় হওয়ার চেষ্টা চালায়। ৪ ফেব্রুয়ারি গ্রিনকে কংগ্রেসের শিক্ষা ও শ্রম এবং বাজেট নামক দুইটি স্থায়ী কমিটি থেকে অপসারণের জন্য কংগ্রেসে ভোট হয়েছে। এই মহিলা অপসারিত হয়েছেন।

এই চারজন বিচিত্র চরিত্র যারা সকলেই কিউআনন ষড়যন্ত্রের ধর্মবিশ্বাসী অনুরাগী। চোর হিসেবে সাজাপ্রাপ্ত আলি, মিথ্যাবাদী হিসেবে সাজাপ্রাপ্ত ফ্লিন, এবং গ্রিনকে দেখা গেছে অনেক ছবিতে এক সাথে। ৬ জানুয়ারির ব্যর্থ অভ্যুত্থানে এরা উস্কানি এবং নেতৃত্ব প্রদান করে। এই অবিমৃষ্যকারিরা যুক্তরাষ্টের চিরায়ত গণতন্ত্রের বুকে খঞ্জর চালিয়ে ডোনাল্ড  ট্রাম্পকে করতে চেয়েছিল স্বৈরশাসক।

কিউআনন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ও ধর্ম বিশ্বাস অনুযায়ী এর পয়গম্বর হল ডোনাল্ড ট্রাম্প। এই ভুয়া সংগঠনের প্রতি ট্রাম্প প্রকাশ্যে তার সমর্থন ব্যক্ত করেছিল রি-টুইট করে। ২০২০ সালের ১৯ আগস্ট হোয়াইট হাউসের প্রেস ব্রিফিংএ ট্রাম্প কিউআনন অনুসারীদের দেশপ্রেমিক বলে আখ্যায়িত করে। শুধু তাই নয় ট্রাম্প প্রতিধ্বনিত করেছিল কিউআননের মূল প্রতিপাদ্য, যেটা ভুয়া। সে বলেছিল, "যদি আমি পৃথিবীর সমস্যা সমাধান করতে পারি, আমার ইচ্ছা আমি করবই। আমরা পৃথিবীকে রক্ষা করছি এক উগ্র বামপন্থী দর্শন থেকে যা এই দেশকে ধ্বংস করবে। যখন এই দেশ যাবে, তখন গোটা বিশ্বও অনুকরণ করবে"।

আর কি কথা আছে? কিউআনন ষড়যন্ত্রে বিশ্বাসীরা প্রমাণ পেল তাদের পয়গম্বর তাদের উৎসাহিত করছে। ষড়যন্ত্র তত্ত্বের প্রতিপাদ্য ছিল পয়গম্বর ট্রাম্প এক ঝটিকা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শিশু মাংস খেকো এবং শিশু রক্ত পানে আসক্ত ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নেতাদের, হলিউডের নায়ক নায়িকাদের, টেক বিপ্লবের মহামানবদের বন্দী করে মৃত্যুদণ্ড বাস্তবায়িত করবে। সামরিক বাহিনীর লুকিয়ে থাকা জেনারেল কিউ এর সহায়তায় ডোনাল্ড ট্রাম্প একনায়কত্ত্ব কায়েম করে এক সমৃদ্ধ পৃথিবী গড়বে। কিন্তু এর সবটাই ভুয়া ও গোঁড়ায় গলদ। ৬ জানুয়ারি এবং ৪ মার্চে ট্রাম্পের জোরপূর্বক ক্ষমতা দখলে ব্যর্থতার পর ষড়যন্ত্রে বিশ্বাসীরা বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে। আমেরিকায় ষড়যন্ত্র তত্ত্বের কবর রচনা হয়েছে বলে অনেকেরই আশা।

 

বিডি প্রতিদিন/ ওয়াসিফ

সর্বশেষ খবর