৮ মার্চ, ২০২১ ১৫:৩৪

আমেরিকায় কার্ল মার্কসের ভূত

ড. মোস্তফা সারওয়ার

আমেরিকায় কার্ল মার্কসের ভূত

ড. মোস্তফা সারওয়ার

ঊনবিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠতম চিন্তাবিদদের একজন হলেন কার্ল মার্কস। তাঁর মৃত্যু হয়েছে প্রায় এক শত আটত্রিশ বছর আগে ১৮৮৩ সালের ১৪ মার্চ। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধ এবং পুরো বিংশ শতাব্দী জুড়ে তাঁর চিন্তাধারা পৃথিবীর রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, সাহিত্য, সংস্কৃতি, দর্শন, ধর্ম, এমনকি পপ কালচার সহ জ্ঞান, বিজ্ঞান, বিধান অথবা পদ্ধতির এমন কোন শাখা নেই যেখানে আলোড়ন সৃষ্টি করে নাই। একবিংশ শতাব্দীতে তাঁর প্রভাব ক্ষীণ হয়ে আসছে। মার্কস ইহলোক ত্যাগ করেছেন কিন্তু তাঁর প্রেত এখনও হানা দিয়ে বেড়াচ্ছে বিশ্বময়। গেল শতাব্দীর শেষার্ধের বিখ্যাত ফরাসী দার্শনিক জ্যাক ডেরিডা (Jacques Derrida) তাঁর পুস্তক Spectres of Marx যুক্তি দেখিয়েছেন যে সাম্যবাদের পতন হয়েছে কিন্তু পুঁজিবাদ এবং উদারনৈতিক গণতন্ত্র সমাধান করতে পারেনি দারিদ্র, অনাহার, স্বাস্থ্য সেবা, সম্পদ ও উপার্জনের পর্বত সম পার্থক্য, অভিশংসন সমস্যা এবং উগ্র জাতীয়তাবাদ। তাই মার্কসের প্রেত এখনও হানা দিয়ে বেড়াচ্ছে। কেননা তিনি পৃথিবীর মানুষের বিরাজমান সমস্যার উপস্থাপন এবং সমাধানের অন্ততঃ চেষ্টা করেছেন। কিন্তু পৃথিবীর সমস্যা নিদারুণ জটিল এবং স্থান কালের আবর্তে ক্রম পরিবর্তনশীল। 

অপরিসীম ধন সম্পদে পরিপূর্ণ যুক্তরাষ্ট্রেও উপরোক্ত সমস্যা গুলো নিদারুণভাবে বিরাজিত। এখানে মার্কসের প্রেতের দৌরাত্ম্য সম্পর্কে আমার ধারণা নেই। কিন্তু এই কায়াহীন প্রেতের ভয় দেখিয়ে রিপাবলিকান এবং দক্ষিণ পন্থী রাজনৈতিক এবং ধর্ম ব্যবসায়ীদের রমরমা বাণিজ্য চোখে পড়ার মত। ক্যাপিটল হিলে ৬ জানুয়ারির ব্যর্থ অভ্যুত্থানে মারদাঙ্গা মনোবাসনা ছিল বামপন্থী এবং তথাকথিত "রেডিক্যাল সমাজতন্ত্রে" বিশ্বাসী ডেমোক্র্যাটদের ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলিয়ে দেওয়া। অনেক বছর ধরে আমেরিকার বহুল জনপ্রিয় এক ক্যাবল টিভি, কতিপয় রেডিও টক শো, উগ্র ডানপন্থী রক্ষণশীল রিপাবলিকানদের লাগামহীন প্ররোচনা এবং গত চার বছরে ট্রাম্পের মিথ্যাভাষণ ও টুইটার ট্যানট্রামে প্রচুর আমেরিকানদের মগজ ধৌলাই হয়েছে। সমাজতন্ত্র নামক মামদো ভূতের অলীক ভয় দেখিয়ে কায়েমি স্বার্থবাদীরা আমেরিকার আসল সমস্যাগুল ধামাচাঁপা দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে।

অর্ধেকেরও বেশি আমেরিকানদের বদ্ধমূল ধারণা যে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবেই। তাদের মতে এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল নিকটবর্তী কিউবা। এদেশের মাথা প্রতি জিডিপি হল $৮৮২২। যুক্তরাষ্ট্রের হল $৬৩০৫১। কিউবায় শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা বিনা খরচে পাওয়া যায়। প্রায় সকলের বাসস্থান রয়েছে। চাকুরী ও অবসর ভাতার ব্যবস্থা আছে। যুক্তরাষ্টে এগুলো নেই। যুক্তরাষ্ট্রে মোটামুটি মুক্ত অর্থনীতি। কিউবায় উৎপাদনের প্রায় সকল প্রতিষ্ঠান সরকারের মালিকানায় এবং সমাজতান্ত্রিক এক দলীয় একনায়ক তন্ত্র থাকার জন্য ব্যক্তি, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা নেই। এই সব কারণে কিউবানরা নিজ দেশ ছেড়ে আমেরিকায় পালিয়ে আসে। ডেমোক্র্যাটিক দলের প্রগতিশীল বামপন্থীদের নেতা বার্নি স্যানডার্স এবং আলেকজান্দ্রা ওকাজিয়ো করটেজ - এওসির মুখে সমাজতন্ত্রের কথা শুনলে কিউবানদের গায়ে জ্বর আসে। আর তাছাড়া ঐতিহ্য গত ভাবেই সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে পলাতক কিউবান আমেরিকানরা রক্ষণশীল এবং রিপাবলিকান দলের সমর্থক। এদের বিপুল অংশ দক্ষিণ ফ্লোরিডায় বাস করছে। এদের একচেটিয়া ভোটে রিপাবলিকানরা ফ্লোরিডায় বিজয় লাভে এগিয়ে থাকে। এবারেও ২০২০ সালের ৩ নভেম্বরের নির্বাচনে ট্রাম্প ফ্লোরিডায় বিজয়ী হয়েছেন। কিউবান আমেরিকানরা কার্ল মার্কসের ভূতগ্রস্ত ডেমোক্র্যাটদের অলীক ভয়ে দলে দলে ভোট দিয়েছিল ট্রাম্পকে। ৬ জানুয়ারির ব্যর্থ অভ্যুত্থানে বিপুল সংখ্যায় অশংগ্রহনকারী বর্ণবাদী অস্ত্রধারী সংগঠন প্রাউড বয়েজের (Proud Boys) নেতা কিউবান আমেরিকান এনরিকে টেরিওকে (Enrique Tarrio) বিচারের কাঠগড়ায় হাজির করার কাজ শুরু হয়েছে। অপরাধী হিসেবে জেলের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।

অধিকাংশ আমেরিকানদের কাছে সমাজতন্ত্রের জঘন্য ব্যর্থতার জ্বলন্ত প্রমাণ ভেনিজুয়েলা। উদ্দেশ্য প্রণোদিত প্রচারণায় সক্রিয়করণকারীরা (enablers) সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার উদাহরণ হিসাবে তুলে ধরে ভেনিজুয়েলার নাম। খনিজ তেল সমৃদ্ধ এক কালের ধনী দেশ ভেনিজুয়েলার বর্তমান আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। দক্ষিণপন্থীদের মত অনুযায়ী এর জন্য দায়ী সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থার অসফলতার সাথে রয়েছে সর্বব্যাপী দুর্নীতি এবং অন্যান্য কারণ। একটি প্রধান কারণ হল যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের দ্বারা আরোপিত অর্থনৈতিক এবং বানিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা। 

ভেনিজুয়েলার উৎপাদনের দুই তৃতীয়াংশ রয়েছে বেসরকারি মালিকানায়। এখানকার অর্থনীতি মিশ্র পুঁজিবাদী। কিন্তু শাসক দলের নামে লাগান রয়েছে 'সমাজতন্ত্র' শব্দটি। দুর্নীতি আর নির্বাচন কারচুপিসহ রয়েছে বদনাম। যুক্তরাষ্ট্রের প্রচার মাধ্যমে ভেনিজুয়েলা একটি ব্যর্থ শত্রু রাষ্ট্র। ঐ দেশ ছেড়ে যুক্তরাষ্টে আশ্রয়প্রাপ্ত ভেনিজুয়েলান আমেরিকানরাও দক্ষিণপন্থী রিপাবলিকান। সবচেয়ে কৌতুকপ্রদ বিষয় হল ৩ নভেম্বরে ঘটিত ইতিহাসের অন্যতম কারচুপিহীন নির্বাচনের ভোট বানচাল করার জন্য ট্রাম্প কর্তৃক দায়ের করা মামলায় তার কৌঁসুলীর জেরা। ট্রাম্পের এটর্নি মিসেস সিডনি পাওয়েল (Sydney Powell) এর বক্তব্য অনুযায়ী সমাজতন্ত্রী হুগো শ্যাভেজের নেতৃত্বে এবং আর্থিক সহায়তায় ভোট গণনাকারী ডোমিনিয়ন (Dominion) কোম্পানির মেশিন ট্রাম্পের ভোটগুল মুছে দিয়েছে (delete)। তাই ট্রাম্প নির্বাচনে হেরেছেন। ডেমোক্র্যাটরা সমাজতন্ত্রী হুগো শ্যাভেজের সাথে যোগসাযোগ করে এই জঘন্য ঘটনা ঘটিয়েছে। হাস্যকর বিষয় হল হুগো শ্যাভেজ ইন্তেকাল করেছেন ২০১৩ সালের ৫ মার্চ। এই ধরনের আজগুবি বানোয়াট তথ্যে জমজমাট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ওয়েভ পেইজের পাতাগুল।

ভেনিজুয়েলা ও কিউবার নাম উচ্চারিত হলেই মূলত: স্বল্প শিক্ষিত আমেরিকানদের হৃদকম্পন শুরু হয় সমাজতন্ত্র নামের এক মামদো ভূতের ভয়ে। অথচ কদাচিৎ শোনা যায় সুইডেন, ডেনমার্ক, নরওয়ের কথা। জনপ্রতি উপার্জন এবং জিডিপি (GDP)র মাপকাঠিতে এরা পৃথিবীর ধনী দেশগুলোর অন্যতম। এদের সকলের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোর ভিত্তি হল গণতন্ত্র এবং উদারনৈতিক সমাজতন্ত্র। কানাডা ও ইউরোপের ধনী দেশগুলকে বলা যায় কল্যাণব্রতী রাষ্ট্র (welfare state)। সমাজতান্ত্রিক দেশ গণপ্রজাতন্ত্রী চীন অর্থনৈতিক কাঠামোতে পুঁজিবাদের কিঞ্চিত সুস্বাদু মসলা মিশিয়ে অচিরেই যুক্তরাষ্ট্রকে পিছে ফেলে দিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী দেশে পর্যবসিত হবে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। সমাজতন্ত্রের সাথে কিঞ্চিত ধনতন্ত্রের ককটেল যে অর্থনৈতিক অগ্রগতির অন্তরায় নয় এমন বিশ্লেষণ সাধারণ আলোচনায় কদাচিৎ শোনা যায়। বস্তুত ভীষণ জটিল অর্থনৈতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক সমস্যা ও চ্যালেঞ্জের এক তরফা সমাধানের কোন ধন্বন্তরি ঔষধ অথবা তাবিজ কবজ আছে বলে মনে হয় না। কার্ল মার্কসের ভূত আমেরিকা সহজে ছাড়বে বলে মনে হচ্ছে না।

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক এবং সাবেক উপ-উপাচার্য: ইউনিভার্সিটি অব নিউ অরলিয়েন্স।

 

বিডি প্রতিদিন/ ওয়াসিফ

সর্বশেষ খবর