২০ এপ্রিল, ২০২১ ১৬:৩৩

বাংলাদেশে যেভাবে ইসলামপন্থীদের উত্থান

অনলাইন ডেস্ক

বাংলাদেশে যেভাবে ইসলামপন্থীদের উত্থান

প্রতীকী ছবি

গত ২৬ মার্চ বাংলাদেশ সফরে আসেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তার এই সফরের বিরোধিতা করে আন্দোলন গড়ে তোলে ইসলামপন্থীরা। এসময় তাদের তাণ্ডবে ১৩ জনের মৃত্যু হয়।

এই ইসলামপন্থীরা বর্তমানে হেফাজত নামে পরিচিত। এটি একটি জনপ্রিয় গোষ্ঠী। এদের রয়েছে বহুসংখ্যক অনুসারী। যদিও কৌশলগত কারণে তারা রাজনৈতিক দল হিসেবে নিজেদের ঘোষণা দেয়নি।

তবে এই গোষ্ঠীর প্রভাব এখন দেশের সর্বত্র বিস্তৃত। তারা এখন বাংলাদেশের সংস্কৃতি এবং বাংলা ভাষার দ্বারা প্রভাবিত ইসলামের অপেক্ষাকৃত মধ্যপন্থী গোষ্ঠীকেই হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে।

বাংলাদেশে হেফাজত জনপ্রিয় হয়ে ওঠার আগেও এদেশের ভাষা ও সংস্কৃতি জাতীয় পরিচয়ের মূল কেন্দ্রেই ছিল।  বেশিরভাগ মানুষ ধর্মভীরু হিসেবেই পরিচিত ছিল। অন্যভাবে বললে, এই দেশ ছিল ‘বিশ্বাস ধর্ম’ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ ছিল। বাংলাদেশে “ধর্মনিরপেক্ষতা” ধর্মের অনুপস্থিতিকে বোঝায়নি, বরং এর দ্বারা রাষ্ট্রকে ধর্মের প্রতি নিরপেক্ষ হতে হবে বলে বোঝায়।

এই দলটি প্রধান ইসলামী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর বিরোধী দল হিসেবে দেখা গেলেও মূলত তারা একই মতাদর্শের। বর্তমানে তারা শিক্ষা ও ব্যাংকিংসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরে প্রবেশ করছে।

বাংলাদেশে সম্প্রতি সন্ত্রাসী হামলা বেড়েছে। বিশেষ করে বিদেশি, বিভিন্ন অধিকারকার্মী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর।

এখন আর এসব হামলায় আগের মতো দরিদ্রদের ব্যবহার করা হয় না। এই ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে সুবিধাভোগী ব্যাকগ্রাউন্ডের লোকদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ সংক্রান্ত বিভিন্ন সংবাদ ইঙ্গিত দেয় যে তাদেরকে একটি মতাদর্শে অনুপ্রাণিত করা হয়েছে যে ইসলাম ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের দ্বারা হামলার শিকার। সুতরাং এটিকে রক্ষা করতে হবে। 

পাকিস্তানের সঙ্গে দীর্ঘ যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর যে দেশ ধর্মনিরপেক্ষতার ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সে দেশের জন্য এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। 

তবে ১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর ধারাবাহিকভাবে এই দেশ কখনও সামরিক শাসক আবার কখনও প্রক্সি সামরিক আসনের দ্বারা শাসিত হয়েছে দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে। এই সময়ে রক্ষণশীল ইসলামি মতাদর্শ বাংলাদেশের রাজনীতি ও সমাজে কেন্দ্রীয় ভূমিকায় চলে আসে।

জেনারেল জিয়াউর রহমান ও জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ইসলামপন্থীদের মূলধারার রাজনীতিতে নিয়ে আসেন। সেই সঙ্গে বাংলাদেশ সংবিধানের দুটি স্তম্ভ ‘সমাজতন্ত্র’ এবং ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ কে বিলুপ্ত করে দেন।

যাইহোক, তখনও এটি ঘরোয়া রাজনীতিতেই সীমাবদ্ধ ছিল। বিশ্বব্যাপী ইসলামের যে পরিবর্তন তার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিল না, বিশেষ করে ১৯৮০ এর দশক। কিন্তু তৎপরর্ব্তী সময়ে আফগানিস্তান সংঘাত সন্ত্রাসবাদের দিকে নিয়ে যায়, যা শেষ পর্যন্ত ৯/১১-এর মতো সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটায়।

মূলত পরিবর্তন ঘটে তখন যখন আফগানিস্তানে পশ্চিমাদের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত রাশিয়াবিরোধী যুদ্ধে অংশ নেওয়া বাংলাদেশিরা যখন ফিরে আসে। তারা এখানে আসার পর তাদের মতাদর্শগুলো প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে।

১৯৯৯ থেকে ২০০৫ সাল, এই সময়ে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র বাংলাদেশে ইসলামি সন্ত্রাসবাদের উত্থান ঘটে। জামায়াতে ইসলামি সহায়তায় ক্ষমতায় থাকা প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার আমলেই এটি বিস্তৃতি লাভ করে। ২০০১-২০০৬ শাসনামলে খালেদা সরকারে জামায়াতের ১৮ জন এমপি ছিল। এর মধ্যে কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীও ছিলেন।

এই ধারা ২০০৮ সাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। তবে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে এর তীব্রতা কিছুটা কম ছিল।

এই সময়কালে জামায়াত-উল-মুজহীন বাংলাদেশ (জেএমবি) এবং হরকাত-উল-জিহাদ-আল-ইসলামী (এইচইউজি) -এর উত্থান ঘটে বাংলাদেশে। ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং রাজনৈতিক বিরোধীরা টার্গেটে পরিণত হয়।

খালেদা জিয়া সরকার তাদের অস্তিত্ব অস্বীকার করেছিল যতক্ষণ না মিডিয়া এবং দেশ-বিদেশে এ নিয়ে হইচই শুরু হয়। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার হুমকিও দিয়েছিল। তখন ওইসব সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে কয়েকজনকে ধরে দোষী সাব্যস্ত করা হয় এবং ফাঁসি দেওয়া হয়।

এই ধারার পরিবর্তন শুরু হয় ২০০৮ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর। তার সরকার আবার ১৯৭৫ সালের পূর্বে বিদ্যমান সংবিধানের আইন ও বিধান পুনর্বহালের দিকে নজর দেয়। ফলস্বরূপ সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা পুনর্বহাল করা হয়। কিন্তু ইসলামিক রিপাবলিক ধারা থেকেই যায়।

ইসলামপন্থীরা নির্বাচনে জিততে পারে না। তবে তারা সামাজিক, সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এবং শিক্ষার ক্ষেত্রে ‘ইসলামিক’ ব্যাংকের একটি চেইন চালানোর পাশাপাশি যথেষ্ট এই ক্ষেত্রে যথেষ্ট শক্তি প্রয়োগ করে।

গত দশকে ইসলামপন্থীরা ধর্মনিরপেক্ষতার বিরুদ্ধে রাজপথে আন্দোলন গড়ে তোলার শক্তি অর্জন করে।

কিন্তু ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে যখন একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের বিচার হয় এবং তাদেরকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে একজনকে অপেক্ষাকৃত লঘু শাস্তি দেওয়ায় শাহবাগে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে ওঠে, যা ‘গণজাগরণ মঞ্চ’ নামে পরিচিতি পায়। এই আন্দোলন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নজর কাড়ে।

তখন এই আন্দোলনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তুলতে গিয়ে সংগঠিত হয় হেফাজতে ইসলাম। গড়ে তোলে দুর্বার আন্দোলন। এমনকি ৫ লাখের মতো অনুসারী একত্রিত হয়ে রাজধানী ঢাকার সব রাস্তাঘাট বন্ধ করে দেয়। 

তখন হেফাজত ১৩ দফা দাবি পেশ করে। এর মধ্যে ছিল ব্লাসফেমি জন্য তারা মৃত্যুদণ্ডের বিধান দাবি করে।  শুধু তা-ই নয়, বাংলাদেশের শিক্ষানীতিতে ধর্মীয় অধ্যয়নের চেয়ে বিজ্ঞান এবং গণিতের মতো “ধর্মনিরপেক্ষ” বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে, তাই এই শিক্ষানীতিরও পরিবর্তন দাবি করেন তারা। সেই সঙ্গে ইসলামি শিক্ষা বাধ্যতামূলক দাবি করেন তারা।

ইসলামপন্থীদের তুষ্ট করতে সরকার কিছু দাবি পূরণে সম্মত হয়। এরই অংশ হিসেবে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ও অবমাননার দায়ে আইসিটি অ্যাক্টের অধীনে ৮ জন ব্লগারকে গ্রেফতার করে সরকার।

হেফাজত তাদের সব দাবি আদায়ে সক্ষম না হলেও শিক্ষানীতি অনেকটাই ইসলামি ঘরানার করতে সক্ষম হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, এভাবে বাংলাদেশকে ধর্মনিরপেক্ষতার মতাদর্শ থেকে অনেকটাই বিচ্যুত করতে সক্ষম হয়েছে।

এর বাইরে বাংলাদেশে আরও একটি শক্তিশালী গোষ্ঠী রয়েছে, যারা বক্তবা হিসেবে খ্যাত। তারা বক্তব্যের মাধ্যমে বাংলাদেশকে প্রকৃত ইসলামের আদলে গড়ে তুলতে চায়।

বিডি প্রতিদিন/কালাম/আরাফাত

সর্বশেষ খবর