শিরোনাম
১৫ জুন, ২০২১ ১৬:৩৩

অন্ধকারের বিপরীতে চাই সংস্কৃতির জাগরণ

বাণী ইয়াসমিন হাসি:

অন্ধকারের বিপরীতে চাই সংস্কৃতির জাগরণ

বাণী ইয়াসমিন হাসি

ছেলেবেলায় আমরা গ্রীষ্ম ও শীতের ছুটিতে মামাবাড়ি বেড়াতে যেতাম। মামাবাড়িতে তখনও বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি। প্রতিদিন দুপুরের খাওয়া শেষে দেখতাম শীতল পাটি বিছিয়ে বাড়ির মেয়ে-বউরা কাঁথা সেলাই করতে বসতেন। একজন গান ধরতেন, যেটাকে তারা বলতেন গীত। এই গীত কিন্তু কোনো শেখা গান না, যার যা মনে আসতো তাই দিয়ে একজনের কাছ থেকে আর একজন কথা কেড়ে নিয়ে গান বাঁধতেন। এ এক অপূর্ব দৃশ্য। এই যে সুখ স্মৃতি নিয়ে বেড়ে ওঠা এটা আমার কাছে সম্পদের মত। আর এই যে সংস্কৃতি এটা কিন্তু চলে আসছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে।

দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গ্রামের বিশাল জনগোষ্ঠী নিজস্ব জীবনপ্রণালীর মাধ্যমে শতকের পর শতক ধরে যে বহুমুখী ও বিচিত্রধর্মী সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে। দীর্ঘকাল ধরে গড়ে ওঠা এই সংস্কৃতি জাতির প্রকৃত পরিচয় বহন করে।

আমাদের হস্তশিল্পের আজ বিদেশে ভীষণ চাহিদা। কিন্তু নিজের দেশে এর চাহিদা আছে কি? আমাদের বাড়িতে ছেলেবেলায় দেখেছি পাটের দড়ি দিয়ে বানানো শিকায় মাটির ভাড়ে রসুন, শুকনো মরিচ এ সব রাখা হতো। এখন গ্রামেও কয়জনের বাড়িতে শিকা দেখতে পাওয়া যায়?

আকাশ সংস্কৃতির কারণে লোকসংস্কৃতি থেকে আজ আমরা বিচ্ছিন্ন। কিন্তু নিজের শেকড়কে না জানলে কোন জাতির উন্নয়ন সম্ভব না। আমাদের শেকড় লুকিয়ে আছে লোকগান, হস্তশিল্প ও সাহিত্যে। আর এগুলোকে টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ।

অবহেলায় লোকসংস্কৃতির সহজ সরল ধারা আজ শহরের সংস্কৃতির সঙ্গে সংঘর্ষে উপনীত হচ্ছে। এ দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ছে রাষ্ট্রও। রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যম – সংস্কৃতির ধারাকে বেশ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে, সে কারণে এসবের ওপর সংস্কৃতির বিকাশও নির্ভরশীল।

আগে গ্রামে যেসব নির্মল বিনোদন ব্যবস্থা যেমন গ্রামীণ খেলা, যাত্রাপালা, জারি-সারি গান, নৌকাবাইচ, পুঁথিপাঠের আয়োজন ছিল কালের পরিক্রমায় সেগুলো আজ নির্বাসিত। এখন গ্রামীণ মেলা বলতেই যেখানে মদ ও জুয়ার আসর বোঝায়। মেলাকে সেই জায়গা থেকে উদ্ধার করতে হবে। যাত্রামঞ্চকে করতে হবে শালীন ও কলুষতামুক্ত। গ্রামে গ্রামে গড়ে তুলতে হবে সংস্কৃতি চর্চার এক একটি শক্তিশালী কেন্দ্র। সরকার পৃষ্ঠপোষকতা করবে কিন্তু আয়োজনগুলো চলবে স্বাধীন ও স্বতঃস্ফূর্ত সামাজিক অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে। ভাটি অঞ্চলে বর্ষা মৌসুমে যখন থাকে অখন্ড অবসর সেই সময়ে গ্রামে গ্রামে সংস্কৃতিকেন্দ্রগুলো যাতে সরব হতে পারে সেজন্য নিতে হবে পরিকল্পনা। একটি শক্তিশালী ও কার্যকর সাংস্কৃতিক জাগরণ যখন ঘটবে তখন খারাপ বহু উপসর্গ সমাজদেহ থেকে দূর হয়ে যাবে।

দেশে এখন অগণিত সঙ্গীত প্রতিষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক সংগঠন রয়েছে। আবার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটক, নৃত্যকলা ও সংগীত পড়ানো হচ্ছে। অথচ দেশে নাট্য আন্দোলন একসময় যেমন তুঙ্গে উঠেছিলো, সেটা অনেক ক্ষেত্রে অন্ধকার দূরীকরণে ব্যাপক অবদান রেখেছে। কিন্তু আজ তার অবস্থা কেমন যেন বেহাল।

১৯৫২ সালে তৈরি হয়েছিলো ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে শব্দ ‘অমর একুশে’। ১৯৭১ সালে বাঙালি পেয়েছে অবিনাশী শব্দ ‘মুক্তিযুদ্ধ’। এই দুই বিশাল ঘটনা আজকের দিনে বাঙালির সংস্কৃতিতে এক স্থায়ী আয়োজন। এই দুই ঘটনা বাঙালিকে দিয়েছে আন্তর্জাতিক বিশ্বে গৌরবের জায়গা। বাঙালির ২১ ফেব্রুয়ারি ইউনেস্কো কর্তৃক ঘোষিত হয়েছে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে। সংস্কৃতির এই গৌরবময় যাত্রা স্বাধীন দেশের মর্যাদার স্মারক। এভাবে সংস্কৃতি যেকোন অবস্থায় তার জায়গা খুঁজে নেয়।

সাংস্কৃতিক বোধ মানুষের শুভচেতনাকে জাগ্রত করে। সাংস্কৃতিক বোধ মানুষের প্রতিবাদ-প্রতিরোধকে তীক্ষ্ন করে তোলে। মানুষ সমবেত হয় একটি সম্মিলিত শক্তির জায়গায়। মৌলবাদী জঙ্গি-সন্ত্রাসীরা যখন ভাস্কর্য ভাঙে, তখন তার বিপরীতে তরুণ ছেলেমেয়েরা সাংস্কৃতিক গণজাগরণে প্রতিরোধের অবিনাশী আয়োজন করে। মানুষ শান্তির গান গেয়ে মিছিল করে। সেই মিছিলে শান্তির পতাকা উড়িয়ে হেঁটে যায় অগণিত শিশুরা যারা আগামী দিনকে ধরে রাখবে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে শান্তির পক্ষে। এখনো শান্তির প্রতীক হিসেবে পিকাসোর আঁকা সাদা কবুতর আকাশে উড়ে যায়, এখনো শান্তির পক্ষে আছে নাটক, গণসঙ্গীত, অবিনাশী কবিতার পঙ্ক্তিমালা। এসবই মানুষের হাতে শান্তির জন্য হাতিয়ার। এসব দিয়েই জয় করা যায় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে মানবতার হৃদয়কে। এই বাংলাদেশে তারুণ্যের শক্তির নানা উদাহরণ আছে। তারুণ্যের শক্তিই পারে এই আয়োজনকে মানবিক বোধসম্পন্ন মানুষের কাছে নিয়ে যেতে এবং প্রতিরোধের বিশাল দেয়ালটি গড়ে তুলতে।

বঙ্গবন্ধু যে সাড়ে তিন বছর সময় পেয়েছিলেন, তাতেই তিনি আমাদের মাতৃভূমিকে 'সোনার বাংলায়' রূপান্তরিত করে দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছিলেন। রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড, রাজনৈতিক তৎপরতা এবং দেশ পুনর্নির্মাণে ব্যস্ত বঙ্গবন্ধু সবকিছুর সঙ্গে বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতিকে পুনরুদ্ধার, চর্চা এবং দেশ ও বিদেশে উপস্থাপনার উদ্দেশ্য নিয়ে পাকিস্তান আর্টস কাউন্সিলকে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে রূপান্তরিত করলেন ১৯৭৪ সালে। তিনি চেয়েছিলেন বাংলার ঐতিহ্যবাহী লোকজ সংস্কৃতিকে যথার্থরূপে তুলে ধরে তাকে সমৃদ্ধ করার জন্য। দেশের সর্বত্র এই শিল্পকলা চর্চা ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্য নিয়েই এ ধরনের সংস্কৃতি কেন্দ্র জেলায় জেলায় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে কার্যক্রমও গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সপরিবারে হত্যার পর সেই কর্মচঞ্চলতা একেবারে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। আর তারপর থেকে জেনারেল জিয়াউর রহমান ও জেনারেল এইচএম এরশাদ রাষ্ট্র পরিচালনায় যে সাম্প্রদায়িক মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে গেছেন তাদের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে, তাতে রাজনীতির পাশাপাশি সংস্কৃতিও ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং এর বহুমুখী বিরূপ প্রভাব সমাজে পরিলক্ষিত হতে থাকে। এ ক্ষেত্রে চরম অবহেলা দেখা যায় এবং এ কারণেই এই শাখার কোন উন্নতি সামরিক শাসনের সময় হয়নি। বিএনপি শাসনামলে খালেদা জিয়া মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের বিচারের দাবিতে শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে ও তার সমন্বয় কমিটিকে যেভাবে হেনস্তা করতে চেয়েছিলেন তাতে বাংলার মাটিতে উদার গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি বাধাগ্রস্ত হলো পুনর্বার। তাই আমরা দেখেছি সংস্কৃতি অঙ্গনকে পরিপূর্ণতা দেওয়ার উদ্দেশ্যে যে ধরনের রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা ও অর্থ বরাদ্দ দেওয়া উচিত ছিল, তা আদৌ হয়নি সেই সময়ে।

আমাদের সংস্কৃতিকে শুধু রক্ষাই নয়, এর ব্যাপক প্রসারে যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে। সব অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণে সামাজিক অনাচার ও নানা দুর্নীতির বিরুদ্ধে দেশের মানুষকে জাগ্রত করার জন্য দরকার একটি সাংস্কৃতিক জাগরণ। জঙ্গিবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, সন্ত্রাসী তৎপরতা, সামাজিক নানা দুস্কর্ম এবং নানা ধরনের বিকারগ্রস্ত মানসিকতা থেকে মানুষকে বাঁচানোর জন্য সংস্কৃতির বিকাশ ও চর্চার কোন বিকল্প নেই, এ কথা সবাইকে মনে রাখতে হবে। আমাদের সংস্কৃতির যে পুষ্টধারা সেটার সঠিক চর্চাই পারে সব অন্ধকার দূর করে আলোর সন্ধান দিতে। 

লেখক: সম্পাদক, বিবার্তা২৪ডটনেট

বিডি প্রতিদিন/হিমেল

সর্বশেষ খবর