২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ১৯:৩৫

আন্তর্জাতিক নদী দিবসে প্রত্যাশার সাথে প্রাপ্তির ফারাক

নজরুল মৃধা

আন্তর্জাতিক নদী দিবসে প্রত্যাশার সাথে প্রাপ্তির ফারাক

প্রতি বছর ২৬ সেপ্টেম্বর পালিত হয় আন্তর্জাতিক নদী দিবস। এক সময়ের হাজার নদীর দেশ বাংলাদেশ কেমন আছে- এমন প্রশ্ন করা হলে এক কথায় বলা চলে ভালো নেই সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা নদীর এই দেশটি। বর্তমানে দেশের নদ-নদীগুলো যৌবন হারিয়ে বৃদ্ধ অবস্থায় এখন মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে। যৌবনহারা এসব নদীকে বাঁচিয়ে রাখতে কার্যকর কোনো ওষুধ এখনো পাওয়া যায়নি।

নদীগুলোকে বাঁচানো না গেলে দেশকে একসময় বাঁচানো সম্ভব হবে না। কারণ নদীকে ঘিরে এক সময় গড়ে উঠেছিল দেশের প্রতিটি শহর, বন্দর, হাটবাজার, গঞ্জ। সেগুলো এখন শুধুই স্মৃতি। নদীকে ঘিরে মালামাল পরিবহন ও যোগাযোগের সহজ উপায় ছিল পাল তোলা নৌকা। এখন এই নৌকার দেখা মেলা ভার। সময়ের বিবর্তনে যেটুকুবা নদী পারাপারের বাহন রয়েছে তা দখল করেছে ইঞ্জিনচালিত নৌকা।

জলবায়ু পরিবর্তন, দখল, দূষণসহ নানা কারণে নদনদী অস্তিত্ব বিলুপ্তির পথে। বিলুপ্ত প্রায় এসব নদী নিয়ে বিস্তর লেখা হলেও সমাধানের কোনো সুনির্দিষ্ট পথ খুঁজে পাওয়া যায়নি। নদী নিয়ে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা না থাকায় বছরের পর বছর ধরে আবহাওয়া ও জলবায়ুর পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে খরা মৌসুমে তীব্র খরা আবার শীত মৌসুমে প্রচণ্ড ঠাণ্ডার কারণে নদী স্বাভাবিক গতিতে চলতে পারছেনা। বৃষ্টিপাত কম হওয়া ও খরা মৌসুমে অপরিকল্পিত ভাবে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করায় পরিস্থিতি দিন দিন জটিল হয়ে উঠছে।

প্রায় পাঁচ দশকে দেশ থেকে হারিয়ে গেছে কয়েকশত নদী ও হাজার হাজার খেয়া ঘাট। এখনো শতাধিক নদী যৌবন হারিয়ে ক্ষীণ ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে। দিনের পর দিন পলি পড়ে ভরাট হয়ে নাব্যতা ও গভীরতা হারাচ্ছে দেশের নদীগুলো। প্রতি বছর দেশের নদ-নদীতে গড়ে জমা পড়ছে ৪ কোটি টন পলি। ফলে নৌপথ ছোট হয়ে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। গত ৫০ বছরে নৌপথের দৈর্ঘ্য কমেছে ১৯ হাজার কিলোমিটার। স্বাধীনতার আগে দেশে নৌপথের দৈর্ঘ্য ছিল ২৪ হাজার ১০০ কিলোমিটার, এখন তা কমে মাত্র ৫ হাজারেরও নিচে এসে দাঁড়িয়েছে।

খননের অভাবে পদ্মা, মেঘনা, ব্রক্ষ্মপুত্র, তিস্তাসহ অন্যান্য নদীগুলো এখন ধু-ধু বালুচর। এছাড়া দেশজুড়েই অব্যাহত রয়েছে নদী দখল ও দূষণ। ফলে কৃষি, জনস্বাস্থ্য, প্রাণী, উদ্ভিদ হুমকির মুখে পড়েছে। নদীকে ঘিরে যেটুকু উন্নয়ন হচ্ছে তা প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম। ফলে প্রাপ্তির ফারাক দিন দিন বাড়ছে। 

নদীর সমার্থক শব্দগুলো হচ্ছে তটিনী, তরঙ্গিণী, সরিৎ ইত্যাদি। সাধারণত মিষ্টি জলের একটি প্রাকৃতিক জলধারা যা ঝরনা ধারা, বরফগলিত স্রোতে অথবা প্রাকৃতিক পরিবর্তনের মাধ্যমে সৃষ্ট হয়ে প্রবাহ শেষে সাগর, মহাসাগর, হৃদ বা অন্য কোন নদী বা জলাশয়ে পতিত হয়। মাঝে মাঝে অন্য কোন জলের উৎসের কাছে পৌঁছানোর আগেই নদী সম্পূর্ণ শুকিয়ে যায়। নদীকে তার গঠন অনুযায়ী শাখানদী, উপনদী, প্রধান নদী, নদ ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়। আবার ভৌগোলিক অঞ্চলভেদে ছোট নদীকে একেক এলাকায় একেক নামে ডাকা হয়। 

বাংলাদেশের প্রধান নদীগুলোতে প্রতি বছর ১ দশমিক ২ বিলিয়ন (১২০ কোটি) ঘনমিটার পলি প্রবাহিত হয়। আর তার বড় অংশই নদীর তলদেশে জমা হয়ে নাব্যতা সংকট সৃষ্টি করছে। ৪৮ বছরে নদীগুলোতে পলি জমেছে প্রায় ১৭৮ কোটি টন। পলির কারণে ইতিমধ্যে মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে প্রায় ৩০০ নদী। অধিক হারে পলি জমা, সংরক্ষণে অবহেলা, অবকাঠামো নির্মাণ, ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন, জলবায়ু পরিবর্তন, খনন যন্ত্রপাতি ও দক্ষ জনবলের অভাবসহ নানা কারণকে এর জন্য দায়ী করা হয়েছে। 

সাধারণত উঁচু ভূমি বা পাহাড় গিরিখাত থেকে সৃষ্ট ঝরনাধারা, বরফগলিত স্রোত কিংবা প্রাকৃতিক পরিবর্তন থেকে নদীর জন্ম। হাজার হাজার ফুট উঁচু পাহাড় থেকে তীব্র বেগে ধেয়ে আসা জলরাশিতে এক ধরণের প্রচণ্ড গতি সঞ্চারিত হয়। ছুটে আসা এই দ্রুত গতিসম্পন্ন জলস্রোতে স্থলভাগ অতিক্রম করার সময় নদী নামে পরিচিত হয়। নদী যখন পাহাড়ি এলাকায় প্রবাহিত হয় তখন তার যৌবনাবস্থা বলা। এ সময় নদী ব্যাপক খননকাজ চালায় এবং উৎপত্তিস্থল থেকে নুড়ি, বালি, পলি প্রভৃতি আহরণ করে অতি সহজে সমুদ্রে নিক্ষেপ করে।

নদী এভাবেই আবহমানকাল ধরে ভূপৃষ্ঠকে ক্ষয় করে চলেছে। তার এ কাজ শেষ হয় তখনই যখন সমস্ত নদী অববাহিকা ক্ষয় প্রাপ্ত হয়ে সমভূমি বা প্রায় সমভূমিতে পরিণত হয়। নদীকে ৩ অবস্থায় ভাগ করা হয়েছে। এর প্রথম অবস্থাকে বলা হয় যৌবন অবস্থা। দ্বিতীয় অবস্থাকে বলা হয় পরিপক্ব অবস্থা এবং তৃতীয় ধাপকে বৃদ্ধ অবস্থা বলা হয়। 

যৌবন অবস্থায় নদীর প্রধান কাজ হল ক্ষয় এবং বহন। সাধারণত পার্বত্য অবস্থাটিই নদীর যৌবনকাল। এ সময় নদী বড় বড় পাথর বহন করে নিয়ে আসে। এসব পাথরের ঘর্ষণে নদীর তলদেশ ক্ষয় পেয়ে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি করে। পার্বত্য অঞ্চলে নদীর ক্ষয় ক্রিয়ার ফলে গিরিখাত, ক্যানিয়ন এবং জলপ্রপাতের সৃষ্টি হয়। এরপর নদীর যে অবস্থানটি তাকে বলা হয় পরিপক্ব অবস্থা। এ অবস্থায় নদী একটু স্তিমিত হয়। ফলে নদীর বেগ ও বোঝা বয়ে নেওয়ার ক্ষমতাও কমে যায়। সাধারণত নদী মধ্যস্থানে বা উপত্যকায় প্রবেশ করলে এই পরিপক্ব অবস্থা বোঝায়। এই অবস্থায় গিরিখাত, খরস্রোত, জলপ্রপাত প্রভৃতি আর দেখা যায় না। 

সর্বশেষ অবস্থা হল বৃদ্ধা অবস্থা। নদীর বৃদ্ধ অবস্থায় বলতে যা বুঝায় তা হল, নদীর ক্ষয় করার ক্ষমতা একেবারেই কমে যায়। তবে ভাঙ্গার কাজ অল্পস্বল্প চলে। সাধারণত সমতল ভূমিতে নদীর এই অবস্থা হয়। এতে কোথাও কোথাও উঁচু ভূমি থাকতে পারে। এ সময় নদীর গতিমাত্রা এত কমে যায় যে, সামান্য বাধা পেলেই নদী তার গতিপথ পরিবর্তন করে। নদী এই অংশে খুব এঁকে-বেঁকে চলে। পথে পথে অশ্বখুরাকৃতি হ্রদ সৃষ্টি করে। এ অবস্থায় নদী বর্ষাকালে প্রায়ই দু’কূলে বন্যার সৃষ্টি করে। নদীর পানি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। 

এর ফলে বালি ও পলি দুই তীরে ছড়িয়ে পড়ে। নদীর বুকে জেগে উঠে চর । তবে নদী সবসময় ঠিক এভাবে চলে না। মাঝে মাঝে ভূকম্পনের ফলে নদী আবার যৌবন পেতে পারে। এ ছাড়া অন্যান্য কারণেও নদীর তীব্রতা ও গতি বৃদ্ধি পেয়ে যৌবন ফিরে পেতে পারে। আমাদের দেশে যৌবনপ্রাপ্ত নদীর সংখ্যা গণনা করলে যোগফল হবে শূন্য এটা নিঃসন্দেহে বলা চলে। কারণ বাংলাদেশের নদীর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় এদেশের নদ-নদীর যৌবন অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। এদেশের নদীগুলোর এখন চলছে বৃদ্ধ অবস্থা। যে কোন সময় এগুলোর মৃত্যু হতে পারে। 

বাংলাদেশে ঠিক কত নদী আছে তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে  বাংলাদেশ নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিভিন্নভাবে তাদের পরিসংখ্যান তুলে ধরেছেন। নদী, উপনদী ও শাখানদীর সর্বমোট সংখ্যা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে যথেষ্ট মতদ্বৈধতা আছে। একটি নদী থেকে অসংখ্য নদী সৃষ্টি হয়েছে। আবার কোন কোন নদী থেকে খাল বা ছড়ায় পরিণত হয়েছে। এগুলোও প্রাকৃতিক নদীর অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশের প্রধান নদী পাঁচটি নদীর নাম এলে প্রথমে বলতে হবে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, পশুর ও কর্ণফুলী। এরপর ধরা যায় তিস্তা, গড়াই, মধুমতী, রুপসা, আড়িয়াল খাঁ, কুমার, আত্রাই, কীর্তনখোলা, বিষখালী ইত্যাদি। এসব নদীর মধ্যে কোনটা বড় কোনটা ছোট বলা কঠিন। তবে অনুমান ও হিসাব কষে  ছোটবড় মিলিয়ে বাংলাদেশে কমপক্ষে ৭০০ নদী আছে বলে  অনেক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
 

রংপুর শহর থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দুরে গঙ্গাচড়া উপজেলা। এ উপজেলার ১০ টি ইউনিয়নের মধ্যে ৭ টি ইউনিয়নই হচ্ছে তিস্তা নদী বেষ্টিত। শুকনো মৌসুমে তিস্তাতে থাকে হাঁটু জল। ডালিয়া থেকে কাউনিয়া পর্যন্ত প্রায় ৭০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে জেগে উঠেছে বিশাল চর। বগুড়ার প্রমত্মা করতোয়া এখন ক্ষীণ খালে পরিণত হয়েছে। তেমনি গাইবান্ধার ঘাঘট, কুড়িগ্রামের ধরলা ও ব্রহ্মপুত্র। এসব নদী শুকনো মৌসুমে হেটে পার হওয়া যায়। পদ্মা নদীর ক্ষেত্রে একই অবস্থা।

জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে নদীগুলো মরে গেছে। নদীগুলো শুকিয়ে ক্ষীণ ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে। এসব নদী দেখলে এখন আর কেউ মনে করে না এক সময় এসব নদীর খরস্রোতা যৌবন ছিল। ভারতের এক তরফা পানি প্রত্যাহার ও প্রকৃতি বিরূপ আচরণ করায় কালের অতল গহ্বরে হারিয়ে যেতে বসেছে এই নদীগুলো। সেই সাথে হারিয়ে গেছে নদী পথে পারাপারে প্রায় হাজার হাজারের ওপর খেয়াঘাট।

অথচ এই খেয়াঘাটগুলোকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল নগর জীবন। সেসব এখন শুধুই অতীত। যেখানে এক সময় মাছের চাষ হতো এখন সেখানে চাষ হচ্ছে ধান, পাট, তামাকসহ অন্যান্য কৃষিপণ্য। নদী শুকিয়ে যাওয়ায় এ অঞ্চলের যুগ যুগ ধরে নদী দিয়ে বয়ে চলা প্রাণের প্রবাহিত থেমে গেছে। এসব নদী, উপনদী, শাখা প্রশাখা নদী, ছড়া নদী, নালা নদী এবং নদীখাত এখন শুধুই এ দেশের মানুষের কাছে স্মৃতি।

১৯৮০ সাল থেকে প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসের শেষ রোববার বিশ্ব নদী দিবস হিসেবে পালন করতে শুরু করে ব্রিটিশ কলম্বিয়া ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি। এরপর ২০০৫ সাল থেকে জাতিসংঘের বিভিন্ন সহযোগী সংস্থা দিবসটি পালন করছে। বাংলাদেশে ২০১০ সাল থেকে থেকে রিভারাইন পিপল নামের একটি সংস্থা এ দিবস পালন করে আসছে। ২০০৫ সালে জাতিসংঘ দিবসটি অনুসমর্থন করে।

আজ রবিবার দিবসটি অনুষ্ঠিত হবে। সেই সাথে হবে বিভিন্ন সভা সেমিনার। নানান সমস্যার কথা উঠে আসবে। সমস্যার সমাধানে সুচিন্তিত মতামত ও কার্যকর পদক্ষেপে হয়তোবা যৌবনাহারা নদীগুলো ফিরে পেতে পারে তাদের হারানো যৌবন।

লেখক: লেখক কবি ও সাংবাদিক

বিডি প্রতিদিন/আবু জাফর

সর্বশেষ খবর