দোস্ত, এভাবে চলে যাওয়া কি ঠিক হলো তোর? এখনো তো অনেক কাজ বাকি।
উজানে সাঁতার কেটে সাফল্যের তীরে ভেড়া এক কলমযোদ্ধা বন্ধু পীর হাবিবুর রহমান। আমরা উভয়ে উভয়কে হৃদয়ের গভীর থেকে সম্বোধন করি দোস্ত বলে সেই পরিচয়ের প্রথম দিন থেকে। আবেগ, যুক্তি, অপ্রিয় সত্য ও তথ্যনির্ভর কলাম লেখায় এক দ্যুতিময়, ছান্দিক সাবলীল ওর পথচলা।
সংবাদ লেখায়, কলামে, গদ্যে, সাহিত্যের প্রায় সব শাখায় লিখবার রুচি ও রসবোধ, শব্দ নিয়ে খেলা তার লেখাকে করে তোলে সুখপাঠ্য। তার হাতে শব্দ বাজে ঘুঙুরের মতো। কারো ভাবা-না ভাবা মাথায় নিয়ে কখনো কলম ধরে না। হিসেবের খাতা বাইরে রেখে দেশ, মানুষ ও উদার অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন মাথায় রেখে ও কলম চালায়।
সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলতেই সবচেয়ে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে সে। কোনো ভনিতা ছাড়াই নিজের বিশ্বাসকে সোজাসাপ্টা লেখে ফেলে। রাখঢাক না করে মনের তাগিদে লেখে যায় নিরন্তর। হঠাৎ রেগে যাওয়া, হঠাৎ আবেগে ভাসা পীর হাবিব বিশ্বাস করে দ্বিধাহীন চিত্তে নিজের বিশ্বাস লেখে সর্বদা। ওর বিশ্বাসে সৃষ্টিশীল মানুষের ক্ষরণ, অন্তহীন হাহাকার, অতৃপ্তি ও দহন দ্রোহ থাকে, যা ওর নিজেরও বর্তমান। তার রোমান্টিক প্রেমিক হৃদয়ের সবটা জুড়ে আছে রবীন্দ্রনাথ। সত্যের পক্ষে বিদ্রোহ করে উঠে নজরুল। হৃদয়ের গহীনে লুকানো এক লালন। মনের ক্ষত নিয়ে চরম প্রেমিক ও কবি হতে হয় যেমন বিশ্বাস থেকে, তেমনি ও জানে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ না হলে লেখক-সাংবাদিকও হওয়া যায় না। তার এই মন তাকে টেনে নিয়ে যায় তার প্রথম প্রেম জন্মশহর জল-জোছনার সুনামগঞ্জে।
প্রকৃতি আর সুন্দরের পুজারি পীর হাবিব ভরা পূর্ণিমার রাতে হাওড়ের নৌবিহারে প্রকৃতির সাথে মিশে যাওয়ার সুখ খোঁজে। জোছনার গাহনে শরীর ধুয়ে ধুয়ে বিশুদ্ধ হতে জানেও। বৃষ্টি, কাদা, ধুলিমাখা স্মৃতির সুনামগঞ্জ শহরে, বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ঘরে ফেরা কিংবা অচেনা ছুটি ঘোষণা করে বিরতিহীন আড্ডার নস্টালজিক ওকে ভীষণ ভাবায়। ইচ্ছা ও মনের বিরুদ্ধে চলতে বললে ওর শরীর অবশ হয়ে আসে। চোখে মুখে নামে বিষন্নতা। বৈরি স্রোতের বিপরীতে সাতাঁর কেটে অর্ধেকের বেশি জীবন পার করা পীর হাবিব জীবনের পরতে পরতে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছে বহুবার। তবু মাথা নত করেনি এখন পর্যন্ত।
দোস্ত পীর হাবিব বেশ অনেক দিন হলে জটিল রোগে ভুগছিলো। যদিও ওর মনোবল, চলাফেরা কথাবার্তায় তা বুঝবার উপায় নেই। তার পর দোস্ত চিকিৎসা শুরু করে ভারতের জাসলুক হসপিটালে। চূড়ান্ত চিকিৎসা করে ওর বোনমেরু ট্রান্সপ্লানটেশন করে ক্যানসার জয় করে দেশে ফিরে আসে। কিন্তু এবার তুই করোনা কে মোবাবেলা করতে পারলি না। প্রথমে তোর করোনা পজেটিভ হলো। তার পর তোর হঠাৎ ক্রিটিনাইন বেড়ে গেলো। যে কারণে তোকে এই দূূর্বল শরীরে ডাইলোসিস নিতে হলো। তুই আর সহ্য করতে পারলি না। তুই স্ট্রোকে আক্রান্ত হলি। তারপর তুই আমাদের সামনে খুব নিরবে ৫ ফেব্রুয়ারি বিকাল ৪টা ৮ মিনিটে সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেলি তারার দেশে। এটা কিছু হলো দোস্ত!
এর আগে তোর সে কি কঠিন চিকিৎসা। তখন তোর চিকিৎসক ছিলেন ভারতের মানুষ যাকে অনকোলজির ভগবান বলে, সেই সুরেশ আদবানি। জাসলুক হসপিটালে বোনমেরু ট্রান্সপ্লান্টে তোর শরীরের টিস্যুই ব্যবহার করে ওরা। গত ডিসেম্বরে মালটিপল মায়োলমা নামের ক্যানসার ধরা পড়লে মুম্বাই যাস তুই চিকিৎসার জন্য। মোট ২২টি কেমো ইনজেকশন নিস। ওরাল কেমোও নিয়েছিলি। ভিডিও কনফারেন্সে আদবানির চিকিৎসা। কিছু টেস্ট দিলে রিপোর্ট দেখে বললেন, ডিজিজ কন্ট্রোলে। এ রোগকে তারা ডায়াবেটিসের সাথে ধরেন। যা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। অনেকে কেমো নিয়ে মেডিসিন নির্ভর জীবন কাটালেও এর চূড়ান্ত চিকিৎসা বোনমেরু ট্রান্সপ্লান্ট। এতে শরীর বিষমুক্ত হয়। দোস্ত তুই সেটিই করলি। জীবনে যখন যেটির মুখোমুখি হয়েছিস মানসিক শক্তিতেই তা মোকাবেলা করেছিস। মানসিক শক্তি সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর তোর ও আমাদের সকল আনুগত্য ও ভরসা। যেহেতু তিনি দয়ালু। তোর ও আমাদের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু- বান্ধব, তোর পাঠকরা সব সময় দোয়া করেছেন।
আশা করি এই দোয়া আপনারা সকলে অব্যাহত রাখবেন। ওরা ৮ ভাই বোন ছিলো। ৪ ভাইবোন অকালে আগেই চলে গেছেন পরপারে। আজ দোস্ত চলে গেলো আমাদের সকলকে ফাঁকি দিয়ে না ফেরার দেশে। কিন্তু দোস্ত এমন তো কথা ছিলো না। তোর সাথে পূর্বপশ্চিম পোর্টল, তোর নতুন বেশ কয়টি উপন্যাস, দৈনিক পূর্বপশ্চিমের প্রিন্ট ভার্সন নিয়ে কত পরিকল্পনা। আরো কত কি! কিন্তু কিছুই তো করা হলো না। একদিন আগেও কথা হলো। তখনও তুই কিছু ইঙ্গিত দিলি না। এটা কি ঠিক করলি দোস্ত। তোর যা ভালো মনে হয়েছে, তাই করেছিস। ওপারে ভালো থাকিস দোস্ত। আমরাও আসছি।
লেখক: ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, পূর্বপশ্চিমবিডি.নিউজ
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন
