৬ মে, ২০২২ ০০:০০

‘ব্যবস্থাপক যাহা করেন তাহাই ব্যবস্থাপনা’

অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান

‘ব্যবস্থাপক যাহা করেন তাহাই ব্যবস্থাপনা’

অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান

"সঠিক কাজটি সঠিকভাবে করা" - (তৃতীয় কিস্তি)

(...দ্বিতীয় পর্বের পর) McKinsey 7-S ফ্রেমওয়ার্ক এর তৃতীয় "S" টি হচ্ছে 'পদ্ধতি' (System)। 'পদ্ধতি' শব্দটি বহুমাত্রিক। বিভিন্ন অর্থে এর ব্যবহার আছে। কম্পিউটার দুনিয়ায় 'সিস্টেম' শব্দটিকে ব্যবহারের কারণে এর বৈচিত্র আরও বেড়েছে। সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ার, সিস্টেম এনালিস্ট, সিস্টেম ডিজাইনার, সিস্টেম এক্সপার্ট  ইত্যাদি অনেক কর্মক্ষেত্র তৈরি হয়েছে সিস্টেমকে কেন্দ্র করে। অভিধানে সিস্টেম শব্দটির ৯০টির মত সমার্থক শব্দ (synonyms) পাওয়া যায়। নমুনা হিসেবে কয়েকটি এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, যেমন- arrangement, blueprint, design, game, game plan, ground plan, master plan, plan, program, project, road map, scheme, strategy, procedure ইত্যাদি। সাধারণ ব্যবস্থাপনার প্রেক্ষিত আমার বিবেচনায় 'totality' বা 'whole' এই শব্দ দু'টিই যথোপযুক্ত। সিস্টেমের তিনটি ডাইমেনশন আছে। প্রথমত, কতগুলো পরস্পর নির্ভরশীল বা সম্পর্কযুক্ত অংশ নিয়ে সিস্টেম তৈরি হয়। দ্বিতীয়ত, এটি কোন লক্ষ্য অর্জন করার জন্য পূর্বনির্ধারিত একটি কর্মপন্থা। তৃতীয়ত, এটি হচ্ছে কোন কাজ করার একটা নির্দিষ্ট কর্মধারা বা কার্যপ্রণালী (procedure)। 

অতএব, যখন পরস্পর নির্ভরশীল বা সম্পর্কযুক্ত কতগুলো অংশ বা খন্ডাংশ সম্মিলিতভাবে যখন একটি লক্ষ্য অর্জনের জন্য ধাবিত হয় বা কাজ করে তাকে পদ্ধতি বলে (interdependent parts or components work together to achieve an objective)। যেমন- গাড়ি একটি মেকানিক্যাল সিস্টেম। ইদানিং কালের নতুন মডেলের একটি গাড়িতে প্রায় ৩০০০ পার্টস থাকে, সবগুলো নিয়েই গাড়ি। অতি ক্ষুদ্র একটি পার্টস যেমন ফ্ল্যাগ, তিন কোটি টাকা দামের গাড়িতে একটি ফ্ল্যাগের দাম মাত্র কয়েক শত টাকা মাত্র। ওই ফ্ল্যাগ পয়েন্টের মাথায় কার্বন জমে গেলে তিন কোটি টাকা দামের গাড়িটি স্টার্ট নেবে না। মানবদেহ একটি বায়োলজিক্যাল সিস্টেম। প্রায় এক ডজনেরও বেশি সাব-সিস্টেম আমাদের শরীরের গুরুত্বপূর্ণ ৭৮টি অর্গান নিয়ন্ত্রণ করে। এরমধ্যে কতগুলো মানুষের বেঁচে থাকার জন্যই অত্যাবশ্যকীয়, যেমন- হৃদপিণ্ড, মস্তিষ্ক, কিডনি, লিভার এবং ফুসফুস। আমাদের মস্তিষ্ক কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের অংশবিশেষ। এতে নিউরনের সংখ্যা ১০০ বিলিয়ন, প্রত্যেকটি নিউরন এই বায়োলজিক্যাল সিস্টেমের  অংশ। মানব শরীরের দাঁত একটা পৃথক সাব-সিস্টেম, বেশ জটিলও বটে । একবার উপ্রে গিয়ে গিয়ে আবার উঠে, অনেকটা টিকটিকির লেজ খসে গিয়ে আবার লেজ গজানোর মতন । টিকটিকির লেজ একাধিকবার গজায় কিনা আমার জানা নেই। এমবিবিএস ডাক্তাররা পুরো দেহ নিয়ে পাঁচ বছর পড়াশোনা করে। অপরদিকে বিডিএস ডাক্তাররা শুধু দাঁত নিয়েই পাঁচ বছর পড়াশোনা করে। দাঁতের ব্যথা যাদের হয়েছে তারা সিস্টেমের গুরুত্বটা ভালোভাবে বুঝতে পেরেছেন। শরীরের একটি ক্ষুদ্র দাঁত কিভাবে পুরো সিস্টেমকে অকার্যকর করে দিতে পারে দাঁতের ব্যথা হলেই বুঝতে পারবেন। ‌

(মনোবিজ্ঞানীরা বলে মানুষ নাকি সহজে কষ্ট ভুলে যায়, কেবল সুখ বেশি মনে রাখে। এক্ষেত্রে বোধহয় দাঁতের ব্যথার বিষয়টি ব্যতিক্রম। আজ থেকে প্রায় ৩০ বছর আগের ঘটনা। আমার দাঁতের ব্যথা হয়েছিল। প্রতিটা মুহূর্তের যন্ত্রণার কথা আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে। আমার বন্ধুরা আমাকে নিয়ে গিয়েছিল মালিবাগের 'পাইওনিয়ার ডেন্টাল কলেজে'। কলেজের অধ্যক্ষ রুমি ভাই আমাদের খুবই ঘনিষ্ঠ। প্রচণ্ড দাঁতের ব্যথা নিয়ে মালিবাগে রুমি ভাইয়ের চেম্বারের হাজির হলাম। রুমি ভাই ভীষণ ব্যস্ত। আমাদের বসতে বললেন। ব্যস্ততার ফাঁকে একবার জিজ্ঞেস করলেন, "কেমন আছেন?" বললাম, "আছি মোটামুটি", যদিও দাঁতে অসহনীয় ব্যথা হচ্ছিল। এটাই বাংলাদেশের রেওয়াজ, ভালো-মন্দ যাই থাকুক না কেন বলতে হবে, "ভালো আছি, আল্লাহ ভালো রাখছে"। সম্পূর্ন ফ্রি হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে অধ্যক্ষ সাহেব বললেন, "ভাবি কেমন আছে? অনিন্দ্য কেমন আছে?" আমি অনেক কষ্টে ব্যথাযুক্ত দাঁতের গাল চেপে ধরে ক্ষীণকণ্ঠে বললাম, "ওরা আছে, ভালো আছে"‌। এরপর বললেন, "কি খাবেন বলেন?" আমি ধৈর্য হারিয়ে ফেললাম; বললাম, "রুমি ভাই, প্রচণ্ড দাঁতের ব্যথা নিয়ে আমি আপনার কাছে এসেছি । আপনি আমার দাঁতের চিকিৎসা না করে এগুলো কি প্রশ্ন করছেন- "ভাবি কেমন আছে? কি খাবেন?" রুমি ভাই বললেন, "আপনার দাঁতে তেমন কোনো ব্যথা নেই, যা আছে তা একটু ফিলিং করে ওষুধ দিলেই সেরে যাবে"। আমি বললাম, "আপনি কি করে বুঝলেন?  আপনি তো আমার দাঁত দেখলেনও না"। উনি বললেন, "আপনি এতক্ষণ স্থির হয়ে এক জায়গায় বসে আছেন, এতে প্রমাণ হয় আপনার দাঁতের ব্যথাটা তেমন একটা কিছু না। সিরিয়াস দাঁতের ব্যথার রোগী এক জায়গায় বসে থাকতে পারে না।" জিজ্ঞেস করলাম, কি করে? "একবার বসে, একবার উঠে, অনবরত উঠবস করতে থাকে")

প্রত্যেকটা প্রতিষ্ঠানে নিজস্ব প্রক্রিয়া এবং ওই প্রতিষ্ঠানের অনুসরণকৃত যথাযথ কর্মধারা মেনেই দৈনিক কার্যাবলী সম্পাদন করা হয় ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। সিস্টেম বুঝতে হলে একটা কোম্পানির অভ্যন্তরীণ বিভাগগুলোর মধ্যে যে আন্তঃবিভাগীয় কর্ম বিভাজন এবং প্রবাহ আছে তা বুঝতে হবে। কোন বিভাগ এককভাবে কোম্পানির পুরো লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে না ।  প্রত্যেকটি বিভাগকে যথাযথ গুরুত্ব না দিলে সহযোগিতা দূরের কথা প্রতিবন্ধকতাও তৈরি করতে পারে। ধরা যাক, একটি প্রতিষ্ঠান ছয়টি বিভাগ আছে- টপ মানেজমেন্ট, উৎপাদন, মার্কেটিং, ফাইন্যান্স অ্যান্ড একাউন্টস, রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট এবং এইচ আর এম । এরমধ্যে কেবলমাত্র মার্কেটিং ডিপার্টমেন্টই কোম্পানির জন্য সরাসরি টাকা উপার্জন করে, যা দৃশ্যমান। অন্যরা সবাই টাকার হিসাব রাখে অথবা খরচ করে। এই বিবেচনায় যদি মার্কেটিং ম্যানেজার মনে করে যেহেতু প্রতিষ্ঠানের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি সে, অতএব সবাইকে সে দাবড়িয়ে বেড়াবে বা দাপট দেখাবে, তাহলে একটি ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি তৈরি হবে। (পুরনো দিনের কলকাতার বাংলা সিনেমায় একান্নবর্তী পরিবারের মধ্যে যে ভাইটির উপার্জন বেশি তাঁর স্ত্রীকে অন্যান্য যাদের উপর দাপট দেখাতে দেখেছি) । 

মনে রাখতে হবে অন্যান্য বিভাগের প্রধানরাও বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ ডিগ্রিধারী, হয়তো ফাইন্যান্স অ্যান্ড একাউন্টসে এমবিএ অথবা এফ সি এম এ, কেউ হয়তো কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, অথবা এইচ আর এম -এ এমবিএ ইত্যাদি।  ধরা যাক, আলোচিত একটা সল্ট কোম্পানি। লবণের বেচাকেনা ভালো, মার্কেটিং ম্যানেজার খুবই তৃপ্ত। তার উৎপাদন ক্ষমতার পুরোটাই বাজারে বিক্রি হয়ে যায়(full demand), এবং কোন বিজ্ঞাপন দেয়ার প্রয়োজন হয় না। ব্যবসা খুবই ভালো চলছে, "আল্লাহ ভালো রাখছে"। এই মুহূর্তে বিজ্ঞাপনের কোন প্রয়োজনও নেই। কিন্তু হঠাৎ করে যে ঘটনাটি ঘটে গেল তা হল, প্রতিযোগী কোম্পানি, ধরা যাক, আলোচিত নয় এমন সল্ট কোম্পানি রাতের বেলায় একটি বিজ্ঞাপন দিয়ে বসলো। যে বিজ্ঞাপনের মডেল ঐশ্বরিয়া রাই। ওমুক সল্ট কম্পানির ঐশ্বরিয়া লবণ কিনুন। লবনের প্যাকেটে ঐশ্বরিয়ার একটি খোলামেলা ছবি। এই দেখে এতদিন যারা অন্য সল্ট খেত তারা সকালে গিয়ে দোকানে খোঁজ করতে লাগলো নতুন ওই কোম্পানির ঐশ্বরিয়া লবণের। সকলে ঐশ্বরিয়ার পিছনে ছুটল। যদিও আগের আলোচিত সল্ট কোম্পানির বিজ্ঞাপন দেয়ার কোন ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু এখন আর বসে থাকার সুযোগ নেই। ক্রেতাদের ঐশ্বরিয়া প্রবণতা ঠেকাতে আগের আলোচিত সল্টকেও অতি দ্রুত একটি বিজ্ঞাপন দিতে হবে। আর সেই বিজ্ঞাপন নিশ্চয়ই আমাদের তেজগাঁও (এফডিসি) থেকে কাউকে দিয়ে দিলে হবে না। ঐশ্বরিয়াকে কাউন্টার করার জন্য ক্যাটরিনা কাইফ বা বিপাশা বসু এমন মডেলই লাগবে। সল্ট কোম্পানিটি বিজ্ঞাপনী সংস্থার সাথে যোগাযোগ করলো। ক্যাটরিনা কাইফ মডেল হতে রাজি হলো এবং বলল, লবনের প্যাকেটের গায়ে ব্যবহারের জন্য সে আরো খোলামেলা একটি ছবি দিবে। বুকিং মানি হিসেবে আজকেই ২৫ লক্ষ টাকা বোম্বেতে পাঠাতে হবে। মার্কেটিং ম্যানেজার বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে ফাইন্যান্স ম্যানেজারকে বলল, "Mr. Finance Manager, please disburse Taka 25 lakh immediately, because we have to booked Katrina Kaif"।  এই কথা শুনে ফাইন্যান্স ম্যানেজার বলল, "না ভাই, এই মুহূর্তে বিজ্ঞাপনের জন্য ২৫ লক্ষ টাকা দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। "  মার্কেটিং ম্যানেজার বলল, "কেন ? এ মাসেইতো আমরা  সরবরাহকৃত লবণের বিল পাওয়ার পরে এক কোটি টাকা জমা দিয়েছি । টাকা দিবেন না কেন?"  ফাইন্যান্স ম্যানেজার বলল, "টাকা আছে ঠিকই ।  কিন্তু এই টাকা এখন বিজ্ঞাপন খরচ করা যাবে না। আগামী সপ্তাহে নদীর ওই পারে আমাদের দুই নম্বর লবণ ফ্যাক্টরির ছাদ ঢালাই হবে সেখানে অনেক টাকা লাগবে।" এরকম একটি অবস্থায় মার্কেটিং ম্যানেজারকেই ফাইন্যান্স ম্যানেজারকে বুঝাতে হবে, "ফ্যাক্টরির ছাদের চেয়ে কাস্টমার উত্তম।" এটাই ইন্টার্নাল মার্কেটিং। ফাইন্যান্স ম্যানেজারকে বুঝাতে হবে 'কাস্টমার চলে গেলে ফ্যাক্টরির ছাদ তো দূরের কথা, দেয়ালও থাকবে না'।

এই গল্পটি বললাম "টোটালিটি" বা whole জিনিসটি অনুধাবনের জন্য। ফাইনান্স ম্যানেজারতো কোম্পানির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের একজন, এমনকি অতি একটি ক্ষুদ্র বা নগণ্য অংশ বেঁকে বসলেও লক্ষ্য অর্জন বিঘ্নিত হতে পারে। জনৈক মন্ত্রীর এপিএস-২ লিফট অপারেটরকে একটি থাপ্পর দেয়ায় একবার সচিবালয় তিনদিন বন্ধ ছিল। অতএব ব্যবস্থাপককে প্রতিষ্ঠানের সবকটি অংশকে সম্মিলিতভাবে লক্ষ্য অর্জনের জন্য ধাবিত করতে হবে। (চলবে...)

লেখক : অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান, মার্কেটিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

বিডি-প্রতিদিন/শফিক

সর্বশেষ খবর