শিরোনাম
২০ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ১৪:৫২

‘আমাদের দাবায়ে রাখা যায় না’

নাজনীন মুন্নী

‘আমাদের দাবায়ে রাখা যায় না’

নাজনীন মুন্নী

বেশ কয়েকদিন ধরেই হিমালয় কন্যা নেপাল থেকে আনন্দ গড়িয়ে এই দেশে আসছিল। একের পর এক পরাজয়, দুর্বিষহ সব পরাজয়ে ম্লান হয়ে থাকা এই দেশের মানুষ টের পাচ্ছিলো একটা আনন্দের বাতাস কোথা থেকে যেন আসছে এই দেশে। নত চোখ তুলে যখন চাইলো অনেকে, দেখলো বাংলার কন্যারা জয় করছে একের পর এক পর্বত। তখনও জমাট বাঁধেনি আশা, কিন্তু স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিলো অনেকে। ১৯ বছর এই দেশে আসেনি সাফের শীর্ষ ট্রফি। এবার কি সম্ভব? নড়েচড়ে বসেছিলাম আমরা সবাই। স্বপ্নও তো পূরণ  হয়, হয় না?

শেষ পর্যন্ত ফাইনালে উঠে গেলো মেয়েরা। তবু তেমন কোনও সাড়া নেই কোথাও। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছু পোস্ট, মিডিয়ায় খুব গতানুগতিক কিছু খবর। এর বাইরে খুব বেশি কিছু না। বড় কোনও সাক্ষাৎকার, বড় বড় ছবি, জীবন কাহিনি তেমন কোথাও ছাপা হলো না। ১১ জন মেয়ে কারা, অন্য কিছু তো দূর, তাদের সবার নামও মুখস্থ হলো না আমাদের। কেউ জানতে চাইলো না কেমন তাদের অনুভূতি। তাদের সফলতা, স্বপ্ন বা পরিকল্পনা খুব বড় করে উঠে এলো না খবরের পাতায় পাতায়। কিন্তু ফাইনালের দিন সকালে তারাই নাড়া দিলো আমাদের। সামাাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তারাই লিখে দিলো যা তারা চায়। গায়ের লোমকূপ জেগে যাওয়া সেই লিখা পুরো বাংলাদেশকে জাগিয়ে দিলো হঠাৎ...

ফুটবলার সানজিদা আক্তার তার ফেসবুকে লিখেছেন, “ফাইনালে আমরা একজন ফুটবলারের চরিত্রে মাঠে লড়বো এমন নয়, এগারোজনের যোদ্ধাদল মাঠে থাকবে, যে দলের  অনেকে এসেছে বাবাকে হারিয়ে, মায়ের শেষ সম্বল নিয়ে, বোনের অলংকার বিক্রি করে, অনেকে পরিবারের একমাত্র আয়ের অবলম্বন হয়ে। আমরা জীবন যুদ্ধে লড়ে অভ্যস্ত। দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বের জন্য শেষ মিনিট পর্যন্ত লড়ে যাবো।” তারা লড়েছে। তারা লড়াই করে প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে। মাঠে। মাঠের বাইরে।

একজন ‘এ’ শ্রেণির নারী ফুটবলারের মাসিক বেতন কত জানেন? মাত্র ১০ হাজার টাকা। যে ‘সি’ ক্যাটাগরি তার বেতন মাসে মাত্র ৬ হাজার টাকা। এক বছর খেললে এদেশের ছেলে ফুটবলার পান ৪০ থেকে ৫০ লাখ টাকা। সেখানে মেয়েদের আয় বছরে ৩ লাখও গড়ায় না। সঙ্গে তো আছে নানা হুমকি, আর্থিক কষ্ট, অমনোযোগ, অনীহা। এই দেশের সব অযত্ন তাদের প্রতি। তবু তারা লড়েছে, লড়েছে এই দেশের মৌলবাদসহ সকল বাধা আর অবহেলার বিরুদ্ধে। অজপাড়া গাঁ কলসুন্দরের আলোহীন ঘরের মেয়েরা এই দেশে আলো জ্বালিয়েছে বার বার।

তারা জীবন যুদ্ধে জিতেছে কতখানি জানি না, কারণ তাদের খোঁজ রাখা হয় না আমাদের। কিন্তু মাঠের যুদ্ধে জিতেছে তারা। অথচ সেই লড়াইয়ের সময়ও এই দেশের কর্তা ব্যক্তিরা তাদের খোঁজ রাখেননি, সাহসও জোগাননি পাশে থেকে। এদেশের মানুষ টিভি পর্দায় দেখতে পায়নি পুরো টুর্নামেন্ট। যদিও ফাইনাল খেলা দেখার স্বাদ মিটেছে। কেউ কি দুঃখ প্রকাশ করে বলবেন, ‘আমরা তোমাদের যে অবহেলা করেছি তার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। কেউ কি বলবেন?’

সানজিদা  লিখেছেন, ‘ছাদখোলা চ্যাম্পিয়ন বাসে ট্রফি নিয়ে না দাঁড়ালেও চলবে, সমাজের টিপ্পনীকে একপাশে রেখে যে মানুষগুলো আমাদের সবুজ ঘাস ছোঁয়াতে সাহায্য করেছে, তাদের জন্য এটি জিততে চাই’।

তার লেখার ধরন সত্যি এক যোদ্ধার। যে শব্দচয়ন, যে বাক্য, যে আবেগ দিয়ে তিনি লিখেছেন। দীর্ঘ সেই পোস্টে জয়ের আকুলতা ছিল, দোয়া ছিল, সৃষ্টিকর্তার ওপর বিশ্বাস ছিল, ছিল অনুজদের জন্য পথ তৈরির আকুলতা আর উচ্চারণ না করেও যা ছিল তা হলো অভিমান। তীরের মতো তা বুকে এসে লাগলো আমাদের বুকে।

তারা জিতেছেন। এবার আমাদের পালা। আমরা কি জিতবো? যত অবহেলা তাদের দিয়েছি তা পেছনে ফেলে আমরা কি তাদের প্রাপ্য সম্মান দেবো? বন্ধ ছাদের গাড়িতে লুকিয়ে দেশে ফেরা দেখতে দেখতে আমরা হয়রান হয়ে গেছি। একবার আমরা জয়ের উল্লাস করি। ছাদখোলা বাসে তাদের অভিবাদন দিয়ে শুরু হোক। আরও একবার চোখে কান্না নিয়ে হাসতে থাকি তাদের জন্য। অন্তত একবার আমরা তাদের কাছে জিতি। এই দেশ দেখাক, এই বিশ্ব দেখুক– আমাদের দাবায়ে রাখা যায় না।

সর্বশেষ খবর