নিউইয়র্কে বাংলাদেশিদের দুটি সমাবেশে দুই কংগ্রেসম্যান অভিন্ন ভাষায় সকলকে ট্রাম্প প্রশাসনের অ-আমেরিকান কর্মকাণ্ড রুখে দেয়ার আহ্বান জানালেন। ডেমক্র্যাটিক পার্টির জাতীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট কংগ্রেসওম্যান গ্রেস মেং ক্ষোভের সাথে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের নীতি-নৈতিকতা আজ আক্রান্ত। মানবিক মূল্যবোধে শ্রদ্ধাহীন ব্যক্তির কবলে পড়েছে আমেরিকা। এ থেকে উত্তরণে সকলকে নভেম্বরের মধ্যবর্তী নির্বাচনেই শুধু নয়, আঞ্চলিক ও স্থানীয় পর্যায়ের সকল নির্বাচনে ডেমক্র্যাটদের ভোট দিতে হবে।’
কংগ্রেসে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত কমিটির সদস্য কংগ্রেসম্যান গ্রেগরী মিক্স বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস-ঐতিহ্য আজ ভুলুণ্ঠিত হওয়ার পথে। এ অবস্থা থেকে আমেরিকাকে রক্ষায় চাই সকলের ঐক্য এবং বাংলাদেশিরা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম। মূলধারার রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হবার পাশাপাশি সকলকে ভোটার হিসেবে তালিকাভুক্ত হওয়াও জরুরি।’
কংগ্রেসম্যান মিক্স জোর দিয়ে বলেন, ‘আমেরিকাকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম রাষ্ট্রে পরিণত করতে বাংলাদেশি অভিবাসীরাও নিষ্ঠার সাথে কাজ করছেন। তাই মার্কিন প্রশাসনে অভিবাসীদের সম্মান অটুট রাখতে ডেমক্র্যাটরা বদ্ধপরিকর।’
ডেমক্র্যাটিক পার্টির জাতীয় নির্বাহী কমিটিতে একমাত্র বাংলাদেশিই শুধু নন দক্ষিণ এশিয়ান শেখ রহমান বলেন, ‘এখন সময় হচ্ছে ঘুরে দাঁড়ানোর। এখন সময় হচ্ছে আমেরিকান স্বপ্ন পূরণে জোরালো ভূমিকায় অবতীর্ণ হবার।’
জাতিসংঘে বাংলাদেশের সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি ও বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের জাতীয় কমিটির প্রেসিডেন্ট ড. এ কে এ মোমেন বলেন, ‘বাংলাদেশ এগুচ্ছে দিপ্ত প্রত্যয়ে। বাংলাদেশ উন্নয়নের মহাসড়কেই শুধু নয়, বাংলাদেশ এখন গোটাবিশ্বে উন্নয়নের মডেল হিসেবে পরিণত হয়েছে। উন্নয়নের এ অভিযাত্রায় প্রবাসীরাও শরীক হচ্ছেন। আমি নিজেও সে কাজে রয়েছি।’
জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের সিনেট পড়ে লড়ছেন বাংলাদেশি-আমেরিকান শেখ রহমান। তার সমর্থনে গত শনিবার সন্ধ্যায় নিউইয়র্ক সিটির জ্যাকসন হাইটসে এক সমাবেশে কংগ্রেসওম্যান গ্রেস মেং বক্তব্য রাখেন। গ্রেস মেং তার বক্তব্যে নিজেকে বাংলাদেশিদের অকৃত্রিম বন্ধু হিসেবে অভিহিত করে বলেন, গত ১০ বছরে ডেমক্র্যাটরা কংগ্রেসসহ অঙ্গরাজ্য ও স্থানীয় পর্যায়ে সহস্রাধিক আসন হারিয়েছি। সেগুলো রিপাবলিকানদের দখলে চলে গেছে। এ অবস্থার অবসানে সকলকে সংঘবদ্ধ হতে হবে। গত এক বছরের আমরা মাত্র ৪০টি আসন পুনরুদ্ধারে সক্ষম হয়েছি। সামনের নির্বাচনে কংগ্রেসের অধিকাংশ আসন দখলে নিতে হবে। এজন্যে যারা ইতিমধ্যেই সিটিজেনশিপ গ্রহণ করেছেন, তাদের উচিত হবে ভোটার হিসেবে তালিকাভুক্ত হওয়া।’
এ সমাবেশ সঞ্চালনা করেন প্রখ্যাত শ্রমিক ইউনিয়ন নেতা মাফ মিসবাহউদ্দিন। অন্যান্যের মধ্যে আলোচনায় অংশ নেন কম্যুনিটি লিডার মোর্শেদ আলম, ফখরুল আলম, খোরশেদ খন্দকার, গিয়াস আহমেদ, হাসানুজ্জামান হাসান, করিম চৌধুরী, আলী হোসেন, এ কে এম নূরল হক এবং সাংবাদিক মাহফুজুর রহমান। সকলেই শেখ রহমানের বিজয়ে নিজ নিজ অবস্থান থেকে কাজের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।
বৈশাখী মেলায় বক্তব্য রাখছেন কংগ্রেসম্যান গ্রেগরী মিক্স।
এ সময় প্রদত্ত বক্তব্যে মোর্শেদ আলম বলেন, স্টেট সিনেট নির্বাচনে ৪২ শতাংশ ভোট পেয়েও হেরে গেছি। কারণ, ডেমক্র্যাটরাই আমাকে ভোটদানে কার্পণ্য করেছে। অথচ ফ্লাশিংয়ের চায়নিজরা দলে দলে ভোট দিয়েছেন। সে ঋণ আমি কখনো ভুলবো না। এ প্রসঙ্গে কংগ্রেসওম্যান গ্রেস মেং বলেন, চায়নিজরা এডপ্ট করেছিলেন মোর্শেদ আলমকে। এর প্রতিদান হিসেবে জ্যামাইকার বাংলাদেশিরা আমাকে এডপ্ট করেছেন। তারা আমার পক্ষে রয়েছেন সব সময়।
বাংলাদেশ সোসাইটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ফখরুল আলম বলেন, পরস্পরের সহযোগী হয়ে সামনে এগোতে হবে। শেখ রহমানকে সে তাগিদেই সর্বাত্মক সহায়তা দিয়ে যাবো। এর বিকল্প নেই।
গিয়াস আহমেদ বলেন, রিপাবলিকান হয়েও আমি ডেমক্র্যাট শেখ রহমানের পক্ষে কাজ করছি। কারণ, তিনি হলেন বাংলাদেশি। এ চেতনায় সকলকে কাজ করতে হবে।
বাংলাদেশি আমেরিকান ডেমক্র্যাটিক লীগের প্রেসিডেন্ট ও ডেমক্র্যাট ন্যাশনাল কমিটির সদস্য খোরশেদ খন্দকার বলেন, রোহিঙ্গা সংকটে জর্জরিত বাংলাদেশ। এ থেকে উত্তরণে গ্রেস মেং-এর সহায়তা চাই। বিশেষ করে রোহিঙ্গারা যাকে সসম্মানে মিয়ানমারে নিজের বসতভিটায় ফিরতে পারে-সে ব্যাপারে মার্কিন কংগ্রেসের হস্তক্ষেপ জরুরি। এর পরিপ্রেক্ষিতে মেং বলেন, ‘মিয়ানমারের বর্বরতায় সকলেই ক্ষুব্ধ। আমরা বদ্ধপরিকর সে সমস্যার স্থায়ী সমাধানে। এজন্য চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
হাসানুজ্জামান হাসান বলেন, শেখ রহমান আমাদের ঘুরে দাঁড়াতে প্রেরণা দিচ্ছেন। তার মত আরো যারা লড়ছেন, সকলের জন্যেই কাজ করতে হবে। বাংলাদেশি-আমেরিকানদের জন্য দলমত-নির্বিশেষে জোট গঠন করতে হবে।
মাফ মিসবাহ বলেন, ঐক্যের বিকল্প নেই। আর এ ঐক্যের প্ল্যাটফরম হচ্ছে ডেমক্র্যাটিক পার্টি। মূলধারায় প্রবাসীদের সম্পৃক্ত করতে আমরা ‘আসাল’ (এলায়েন্স অব সাউথ এশিয়ান-আমেরিকান লেবার) এর মাধ্যমে নেটওয়ার্ক রচনা করছি। বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে কমিটি হয়েছে। অন্যসকল রাজ্যেও কমিটির চেষ্টা চলছে। এভাবেই আমাদের মধ্যেকার সাংগঠনিক সম্পর্ক সুসংহত রাখতে পারলে যে কোন নির্বাচনে আমাদের সমর্থিত প্রার্থীর বিজয় আনা সম্ভব।
কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরের সন্তান শেখ রহমান বলেন, ডিশওয়াশারের কাজের মাধ্যমে আমার প্রবাস জীবন শুরু। ১৪ বছর লেগেছে কলেজ-ভার্সিটির লেখাপড়া শেষ করতে। আর আজকের এ অবস্থানে আসতে সময় লেগেছে ৩৫ বছর। আমি সকলের প্রতি অনুরোধ রাখতে চাই, একবার হেরে গেলেই হাল ছেড়ে দেবেন না। এটি হচ্ছে ভাগ্য গড়ার অপূর্ব সুযোগের একটি স্থান। চেষ্টা করলে ভাগ্য প্রসন্ন হবেই। ডেমক্র্যাটিক পার্টিতে আমি এবং গ্রেস মেং-এশিয়ান। এটি একটি ইতিহাস। গ্রেস মেং ভোটে জয়ী হয়ে ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং আমি নির্বাহী সদস্য হয়েছি। নির্বাচনে জয়-পরাজয় উভয়ই রয়েছে। একবার হারলেই যেন কেউ হতাশ না হন।
অপরদিকে, একই দিন বিকালে নিউইয়র্ক সিটির কুইন্সে ‘জ্যামাইকা বাংলাদেশ ফ্রেন্ডস সোসাইটি’র বৈশাখী উৎসবে অতিথি ছিলেন কংগ্রেসম্যান গ্রেগরী মিক্স। হাজার হাজার প্রবাসীর উচ্ছ্বল উপস্থিতিতে এ মেলায় কম্যুনিটি সার্ভিসের জন্যে হাজী আব্দুল কাদের মিয়াকে বিশেষ সম্মাননা জানানো হয়। মরনোত্তর সম্মাননা প্রদান করা হয় একুশে প্রদকপ্রাপ্ত শিক্ষাবিদ ড. মনসুর এবং ব্যবসায়ী সাঈদ রহমান মান্নানকে। এ দুটি এওয়ার্ড গ্রহণ করেন খান’স টিউটোরিয়ালের প্রেসিডেন্ট নাঈমা খান ও সিইও ডা. ইভান খান। এওয়ার্ড হস্তান্তর করেন ড. মোমেন এবং প্রয়াত দুই বরেণ্য ব্যক্তির ওপর আলোকপাত করেন পল খান। এ সময় মেলা কমিটির সমন্বয়কারি মনির হোসেন, রিজু মোহাম্মদসহ নেতৃবৃন্দ মঞ্চে ছিলেন।
‘হৃদয় নাচে বৈশাখী সাজে’ স্লোগানে এ উৎসবের আহবায়ক ফখরুল ইসলাম দেলোয়ারের সঞ্চালনায় কুইন্স ডেমক্র্যাটিক পার্টির লিডার এটর্নী মঈন চৌধুরী, সাবেক রাষ্ট্রদূত ড. এ কে এ মোমেন প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। বিশিষ্ট সমাজকর্মী ও ব্যবসায়ী শাহনেওয়াজ কর্তৃক উদ্বোধন করা এই উৎসবে বিশিষ্টজনদের মধ্যে আরো ছিলেন বাংলাদেশ সোসাইটির সভাপতি কামাল আহমেদ, সাবেক সভাপতি নার্গিস আহমেদ, রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন, সমাজকর্মী ও ব্যবসায়ী কাজী নয়ন, কংগ্রেসে ডেমক্র্যাটিক পার্টির মনোনয়নের লড়াইয়ে অবতীর্ণ মিজান রহমান, মূলধারার রাজনীতিক মোহাম্মদ এন মজুমদার, কম্যুনিটি লিডার মিসবাহ আহমেদ, ফরিদ আলম, সাপ্তাহিক বাংলাদেশ পত্রিকার সম্পাদক ডা. ওয়াজেদ এ খান প্রমুখ।
উভয় সমাবেশেই মূলধারার রাজনীতিতে বাংলাদেশিদের অপরিসীম আগ্রহের প্রকাশ ঘটেছে। বিশেষ করে ট্রাম্প প্রশাসনের সীমাহীন দমন-পীড়নে অতীষ্ঠরা বিকল্প পন্থা খুঁজছেন পরিত্রাণের জন্য-তা অবলিলায় উল্লেখ করেছেন বক্তারা।
এ মেলায় বাংলাদেশ সোসাইটির নির্বাচনে সম্ভাব্য প্রার্থীরাও ছিলেন সরব। সভাপতি পদে কাজী নয়ন এবং সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আলী জনসংযোগ করেন মেলায় আগতদের সাথে। একইভাবে কংগ্রেসের মনোনয়ন প্রত্যাশী মিজান রহমানও ছিলেন সরব। মিজানের পক্ষে মাঠে রয়েছেন এটর্নী সোমা সাঈদ। অর্থাৎ জ্যামাইকার এ মেলাকে নির্বাচনী প্রচারাভিযানের অবলম্বনে পরিণত করেন সম্ভাব্য প্রার্থীরা।
বিডি-প্রতিদিন/৩০ এপ্রিল, ২০১৮/মাহবুব