উইসকনসিন স্টেটে মিলওয়াকি সিটিতে ‘ইউনাইটিং আমেরিকা’ স্লোগানে ডেমক্র্যাটিক পার্টির ৪দিনব্যাপী জাতীয় সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন মঙ্গলবার দুপুরে মুসলিম নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখেন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান অনুযায়ী সকল ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের মানুষের চলমান সংকট আলোকে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আমেরিকার নীতি-নৈতিকতার পরিপন্থী আচরণে অভিবাসী সমাজ তথা মসলমানরাও যে কঠিন এক পরিস্থিতির মধ্যে দিনাতিপাত করছেন তা বিস্তারিতভাবে উপস্থাপিত হয় বিভিন্ন পর্যায়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিগণের বক্তব্যে। এতে বাংলাদেশি আমেরিকান শেখ রহমানও বক্তব্য দেন।
উল্লেখ্য, এই প্রথম ডেমোক্র্যাটিক পার্টির জাতীয় সম্মেলনে কোন বাংলাদেশি-আমেরিকান বক্তব্য প্রদান করেছেন। অর্থাৎ মার্কিন ধারার রাজনীতিতে বাংলাদেশিদের উত্থানের ইতিহাসে এ এক অনন্য নজির হয়ে থাকবে।
চার বছর অন্তর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর নাম চূড়ান্তভাবে ঘোষণার উদ্দেশ্যে প্রধান দুই পার্টির জাতীয় সম্মেলন হয়ে থাকে। করোনা আতঙ্কে এবারই প্রথম ভার্চুয়াল সম্মেলন হচ্ছে।
আটলান্টা থেকে প্রদত্ত বক্তব্যে সিনেটর শেখ রহমান বলেন, আমি হচ্ছি জর্জিয়ায় প্রথম মুসলমান এবং এশিয়ান-আমেরিকান স্টেট সিনেটর তথা আইনপ্রণেতা। আমি এমন একটি এলাকার নির্বাচিত প্রতিনিধি যেখানে শতাধিক দেশের শতাধিক ভাষা-বর্ণ-ধর্ম-গোত্রের মানুষেরা বাস করেন। সবকটি স্টেটের লোকই রয়েছেন আমার এলাকায় এবং তারা সকলেই জর্জিয়াকে নিজের এলাকা ভাবেন। এজন্যে আমি নিজেকে অত্যন্ত ভাগ্যবান মনে করি কারণ, আমি সবসময় আমেরিকার সুন্দর ভবিষ্যতের প্রতিনিধিত্ব করতে চাই।
কিশোরগঞ্জের সন্তান ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নীতি-নির্ধারকদের অন্যতম শেখ রহমান উল্লেখ করেন, আজকের এই ভার্চুয়াল কনভেনশনে বক্তব্যের সুযোগ পেয়ে সম্মানিতবোধ করছি। শারীরিকভাবে আমরা কাছাকাছি আসতে না পারলেও প্রযুক্তির সমন্বয়ে সকলেই ভিন্ন একটি চেতনায় আজ মিলওয়াকির কনভেনশনের স্লোগান ধারণ করছি। আমি আশা করছি, আপনারা সকলেই আমার মত অভিভূত, উদ্বেলিত, আনন্দিত জো-বাইডেন-কমলা হ্যারিসের মত যোগ্য প্রার্থী পেয়ে। আমি থামবো না কিংবা বিশ্রামেও যাবো না ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ২০ জানুয়ারিতে হোয়াইট হাউজ থেকে বের না করে দেয়া পর্যন্ত। এটি আমার অঙ্গীকার সকলের সামনে। কারণ, এটি আমরা সকলেই জানি যে, ৩ নভেম্বরের নির্বাচনে ট্রাম্পের ভরাডুবি হলেও দায়িত্ব হস্তান্তরের আগ পর্যন্ত তিনি অভিবাসী, মুসলমান, কৃষ্ণাঙ্গ-বাদামি রংয়ের মানুষদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতেই থাকবেন। চলমান করোনা মহামারির মধ্যেও আমরা ট্রাম্পের কদর্য চেহারা দেখেছি। ট্রাম্পের এমন অমানবিক আচরণের বলি হয়েছে পৌণে দু’লাখের অধিক আমেরিকান। এ মানুষই নির্বাচনে জয়ী হওয়ার আগে যেমন আমেরিকার জন্যে বিপদজনক ছিলেন, দায়িত্ব গ্রহণের পরও একই মানসিকতার প্রকাশ ঘটিয়েছেন এবং নির্বাচনে পরাজিত হলে মানবতা বিপন্ন হয় এমন কামড় দিতেই থাকবেন।
ট্রাম্পের অনাচার-মিথ্যাচারে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের মর্যাদা-নেতৃত্ব প্রশ্নের সম্মুখীন। এমন অবস্থার অবসান ঘটানোর অভিপ্রায়ে শেখ রহমান বলেন, সামনের নির্বাচনে শুধু জয়ী হলে চলবে না, বড় ধরনের ব্যবধানে বিজয় ছিনিয়ে নিতে হবে। সিনেটেও দখল নিতে হবে। তাহলেই আমেরিকার প্রকৃত চেহারা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। নাগরিক অধিকার, অভিবাসীদের মর্যাদা, কর্মজীবী-খেটে খাওয়া মানুষের ন্যায্য পারিশ্রমিক, বৈষম্যহীন-ন্যায় বিচার-সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে। একইসাথে সকলের জন্যে চিকিৎসা-সেবা নিশ্চিত, মানবাধিকার নেতা জন লুইসের প্রত্যাশার পরিপূরক ভোটাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠাও সম্ভব হবে হোয়াইট হাউজ এবং কংগ্রেসে ডেমক্র্যাটরা সংখাগরিষ্ঠতা অর্জনে সক্ষম হলে। মুসলিম নিষিদ্ধের আইন চিরতরে বিলুপ্তির পথও সুগম হবে। এদেশে প্রতিদিনই কিছু পুলিশের গুলিতে কৃষ্ণাঙ্গ-বাদামি রংয়ের মানুষের প্রাণ ঝরছে। সেসব হত্যায় জড়িতদেরকেও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা যাবে ট্রাম্পের মত দুশ্চরিত্রের মানুষকে প্রশাসন থেকে হটিয়ে দিতে পারলে। এজন্যে আমি সকলের প্রতি উদাত্ত আহবান রাখছি, আসুন একযোগে কাজ করি কোর্ট হাউজ থেকে স্টেট হাউজ হয়ে হোয়াইট হাউজে বিপুল বিজয় নিশ্চিতের জন্য। এ নিয়ে কালক্ষেপণের অবকাশ নেই।
শেখ রহমান বলেন, প্রিয় বন্ধুরা, থেমে থাকলে চলবে না। ৩ নভেম্বরের নির্বাচনে ব্যালট বিপ্লব ঘটিয়ে সিটি, স্টেট, কংগ্রেস এবং হোয়াইট হাউজে যত স্বৈরাচার-দুর্নীতিবাজ রয়েছে সকলকে বিদায় জানানোর সংকল্প নিতে হবে এই কনভেনশন থেকে। আমি এ ব্যাপারে প্রচণ্ড আশাবাদী, ডেমক্র্যাটরা জয়ী হবেই। আর এজন্যেই সকলকে মাঠে নামতে হবে। ভোট কেন্দ্রে যেতে হবে অথবা ডাকযোগে আগাম ভোটে অংশ নিতে হবে।
তৃণমূলের জনপ্রিয় এই ডেমোক্র্যাট আরও বলেন, আসুন আমরা জয়ী হই সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতকে হাতের মুঠোয় ধারণ করতে, আসুন পরবর্তী প্রজন্মের বাসো উপযোগী আমেরিকার স্বার্থেই আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকি। আসুন আমরা বিজয় ছিনিয়ে আনি আমাদের মতো মানুষের স্বার্থ সংহত করতে, যারা আমেরিকার সত্যিকারের কল্যাণ চায় তাদের কথা ভেবে। গণতন্ত্রের স্বার্থে আসুন আমেরিকার নীতি-নৈতিকতা সমুন্নত রাখার শপথ গ্রহণ করি।
সোমবার শুরু হওয়া ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ৪ দিনব্যাপী জাতীয় সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন দুপুরে মুসলমান ডেলিগেটদের উদ্যোগে এ ভার্চুয়াল আলোচনায় আরও অংশ নেন ডেমোক্র্যাটিক পার্টির জাতীয় কমিটির চেয়ারপার্সন টম পেরেজ, সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স, কংগ্রেসম্যান আন্দ্রে কারসন, কংগ্রেসওম্যান রাশিদা তাইয়্যেব, কংগ্রেসওম্যান ইলহান ওমর, মিনেসোটা স্টেটের এটর্নি জেনারেল কীথ এলিসন, ফারুক মিথা, কানেকটিকাট স্টেট সিনেটর সউদ আনোয়ার, পেনসিলভেনিয়া স্টেট সিনেটর শরিফ স্টিট, ভার্জিনিয়া স্টেট সিনেটর গাজ্জালা হাশমী, লিন্ডা সারাসোর এবং গিলবার্টো হিনোজোসা। সকলেই ট্রাম্পের মুসলিম বিদ্বেষমূলক এবং বর্ণবাদী কাজকর্মের নিন্দা জানিয়ে ব্যালট যুদ্ধে এমন বাজে মানুষকে হটানোর সংকল্প ব্যক্ত করেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমেরিকার নেতৃত্ব পুনপ্রতিষ্ঠার পাশাপাশি মানবিকতায় পরিপুষ্ট একটি প্রশাসনিক কাঠামো হোয়াইট হাউজ ও ক্যাপিটল হিলে প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই বলেও মন্তব্য করেন সকলে।
এদিন সন্ধ্যায় সারা আমেরিকার ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রতিনিধিরা দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় অংশ নেন ভার্চুয়ালে। জো বাইডেন এবং বার্নি স্যান্ডার্স ছিলেন প্রার্থী। ২৩৭৪ ডেলিগেটের ভোট প্রয়োজন ছিল চূড়ান্ত মনোনয়নে। সে ক্ষেত্রে জো বাইডেন পেয়েছেন ৩৫৫৮ ভোট। স্যান্ডারসের প্রাপ্ত ডেলিগেট ভোট এক হাজারেরও কম। অর্থাৎ জো বাইডেনকে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ঘোষণা করা হলো আনুষ্ঠানিকভাবে। তাৎক্ষণিক এক প্রতিক্রিয়ায় বাইডেন সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন, দেলওয়ারে স্টেটের নিজ বাসা থেকে। বাইডেন সম্মেলনের শেষ রাতে মনোনয়ন গ্রহণের বক্তব্য দেবেন।
এদিকে, মঙ্গলবার রাতে প্রাইম টাইমে কেন ট্রাম্পকে হোয়াইট থেকে সরানো জরুরী সে ব্যাপারে জোরালো যুক্তি-তর্কের অবতারণা করে বক্তব্য দেন সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ও জিমি কার্টার, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি, ইউএস সিনেটে সংখ্যালঘিষ্ট দলের নেতা সিনেটর চাক শ্যুমার, ট্রাম্পের মুসলিম নিষিদ্ধ আদেশের বিরোধিতা করায় চাকরি হারানো ইউএস এটর্নি স্যালি ইয়াটস, জিলি বাইডেন, কংগ্রেসওম্যান আলেক্সান্দ্রিয়া অকাসিয়ো-করটেজ, ইউনাইটেড অটো ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সাবেক প্রেসিডেন্ট বব কিং, জর্জিয়া স্টেটের গভর্নর প্রার্থী স্ট্যাসি আব্রামস, রিপাবলিকান পার্টির নেতা ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেনারেল কলিন পাওয়েল, ক্যারোলিন কেনেডি, জ্যাক স্কলসবার্গ, কংগ্রেসওম্যান লিসা ব্লান্ট রচেস্টার। দিনের পুরো অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন অভিনেত্রী ট্র্যাসি রোস।
বিডি প্রতিদিন/ফারজানা