১ জুন, ২০২০ ১৮:২৪

আসলে প্রয়োজন পরিমিতি

মোহাম্মদ মাসুদ রানা

আসলে প্রয়োজন পরিমিতি

মোহাম্মদ মাসুদ রানা

মানুষ সামাজিক জীব, আর এ একথাটি আমাদের সকলেরই জানা। সামাজিক জীবনে  যেমন আনন্দ উদযাপন থাকবে, তেমনি থাকবে উৎকণ্ঠা ও ভীতি; বলা চলে এটিই একভাবে সমাজের রীতি। এরই মাঝে সামাজিক মানুষ তাদের জীবনকে অতিবাহিত করছে যুগ যুগ ধরে। তবে সব সমাজে এই আনন্দ, উৎকণ্ঠা আর ভীতি একই মাত্রায়  ঝেঁকে বসবে এমনটা হয়তো কাঠামোবাদী তাত্তি¡করা ভাবতে পারেন। কিন্তু আমার কাছে মনে হয় এভাবে সকল সমাজের মানুষের চিন্তাভাবনাকে এক করে দেখা অনেক ক্ষেত্রেই অযৌক্তিক হবে।

কারণ করোনা সংক্রমণ এবং একে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া উৎকণ্ঠা ও ভীতি সকল সমাজে একভাবে কাজ করবে, এমনটা ভাবার কোনো অবকাশ নেই। যেটা হয়তো ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন কায়মনোবাক্যে চাইছে, কিন্তু বাস্তবতা বলছে ভিন্নতাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশের মানুষ, এর পরিবেশ প্রতিবেশ সবকিছুকে ইউরোপীয় বা পশ্চিমাদের আদলে হতে হবে এমনটি ভাবা আমার কাছে মনে হয় ভাবনার অসঙ্গতি। আর এই বিষয়টি উপলব্ধি করে মার্কিনী নৃবিজ্ঞানের জনক ফ্র্রানজ বোয়াস পশ্চিমা কেন্দ্রে অবস্থান করেও বলতে পেরেছিলেন সাংস্কৃতিক আপেক্ষিকতাবাদের কথা। আমি বরং আপাতত উৎকণ্ঠা, ভীতি ও আনন্দ উদযাপনের বিষয়গুলোকে আপেক্ষিকতাবাদের আলোকে দেখতে পারলেই বেশি খুশি। 

এখন চলুন আলোচনাটাকে একটু ন্যায়-নীতির দিকে নিয়ে যাই। বাংলাদেশে যথার্থ পিপিই নেই, তাই বলে কি সেবা প্রদানকারীরা ঘরে বসে থাকবেন! এই ধরনের ন্যায়- নীতির বোধ করোনা সংক্রমণের শুরুতে জাগ্রত হলো, ফলাফল শুরুতেই কিছু মানুষের আত্মাহুতি। সেবা প্রদানকারী যেমন ডাক্তার, পুলিশ সদস্যদের নিয়ে সমাজে এক ধরনের উৎকণ্ঠা তৈরি হতে দেখেছি। প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী ডুর্খেইম বেঁচে থাকলে হয়তো তাদের এই মৃত্যুকে পরার্থপর আত্মহত্যার এক অনবদ্য পরিণতি হিসেবে দেখতেন। আমরাও সমাজের এই বিষয়টিকে খানিকটা এভাবেই দেখেছি।

বলা বাহুল্য, এই নিয়ে সামাজিক  যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক হাপিত্যেশও করেছি। অপরদিকে ভিলেন হিসেবে সামনে এনেছি গার্মেন্টস মালিকসহ ছোট-বড় ব্যবসায়ীদেরকে। আমি মনে করি, গার্মেন্টসসহ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সীমিত পরিসরে খোলা রাখা অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সমাজ বাস্তবতায় সময়ের দাবি। এই প্রতিষ্ঠানসমূহ খোলা রাখার কারণেই আমাদের অর্থনীতির চাকা গতিশীল থাকছে, এর পাশাপাশি খাদ্যের যোগান অনেকটা নিশ্চিত হচ্ছে। এর ফলে হয়তো আমরা ডুর্খেইম নির্দেশিত নৈরাজ্যমূলক আত্মহত্যার হাত থেকে নিজেদেরকে বাঁচাতে পারছি।

কেউ কেউ হয়তো বলবেন প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী উৎপাদক প্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়টি  তো বুঝলাম, কিন্তু ঈদে দোকানপাট খোলার কি প্রয়োজন বলুন দেখি! আমার মতে এগুলো আনন্দ অনুভূতি। মানুষ বাঁচে আসলে আশায়, সে জানে মৃত্যু অবধারিত। তবুও  শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বাঁচা ও আনন্দ উপভোগ করতে চাওয়া মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। তাই  দোকানপাট খোলার বিষয়টিকে কেবলমাত্র অর্থনৈতিক মারপ্যাঁচে না গিয়েও বোঝা যায়। ঘরে বসে নিরানন্দ মৃত্যুর চেয়ে কিছু সময় আনন্দে কাটানোতে মনে হয় নেই তেমন  কোন ক্ষতি। আসলে যা ভেবে দেখা দরকার তা হলো পরিমিতি। পরিমিতিবোধ আমাদের মাঝে জাগ্রত হওয়া দরকার। কারণ অতিরিক্ত কোন কিছুই ভালো নয়, সে আনন্দ উদযাপনই হোক, আর ভীতি সঞ্চারই হোক।

আর এই পরিমিতিবোধ আমার মনে হয় আমজনতার তুলনায়, ‘মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত’  শ্রেণির মাঝে জাগানো একান্ত জরুরি। কারণ আমরা (মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণি) ঘরে বসে অফিস করাসহ প্রায় সকল ধরনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছি। বিনোদনের প্রায় সকল এক্সেস আমাদের আছে। এর ফলে লকডাউন দীর্ঘমেয়াদী করার প্রতি আমাদের আগ্রহের উদ্রেক ঘটছে। নিজেদের মতো করে করোনা মোকাবিলায় গাইডলাইনগুলো আমরা তৈরি করছি এবং এগুলো আপামর জনসাধারণকে এরকমভাবে মানতে বাধ্য করতে চাইছি। আর না মানলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের আওয়াজ তুলছি।

কিন্তু আম জনতার কথা বলা ও শোনার কোন সুযোগ কি আমরা রাখছি? মিশেল ফুকোর ভাষায় বর্তমান পরিস্থিতিকে বলা যায়, জ্ঞান ও ক্ষমতার পারস্পরিক যোগাযোগের আদলে আমরা অনেক ক্ষেত্রে শাসন কায়েম করছি। তাছাড়া এই আমরাই অনলাইন প্লাটফর্মগুলোর অযাচিত ব্যবহার নিশ্চিত করে পৈশাচিক আনন্দে মেতে উঠছি, আবার উৎকণ্ঠা ও ভীতির সাম্রাজ্যও তৈরি করছি। যা আমাদের পরিমিতিবোধ না থাকার মানসিকতাকে প্রকাশ করছে। ফলে সমাজে সমস্যা আরো ঘনীভূত হচ্ছে। 

এবার সাধারণ মানুষ বা আমজনতার কথা বলি। যাদের কাছে ঘরে বসে কাজ করে অর্থ উপার্জন করা আর অনলাইনে অর্ডার দিয়ে সকল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করার বিষয়টি একটি অলীক কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়। সেই সাধারণ মানুষের কাছে বাঁচার শক্তিই বড় শক্তি, আর এই শক্তির উৎস হচ্ছে তাদের মনোবল। আমরা ইদানিং ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন ও বাংলাদেশের আইইডিসিআর মারফতে হার্ড ইমিউনিটির কথা শুনছি। যে হার্ড ইমিউনিটির মূলমন্ত্র হচ্ছে মনোবল; সেই মনোবলের উপস্থিতি আমরা বাংলাদেশের আম জনতার মধ্যে করোনাকালীন পরিস্থিতির শুরু থেকেই লক্ষ্য করছি।

তবে আমি অবশ্যই বলবো না মাত্রাতিরিক্ত মনোবল বা বিশ্বাসকে ধারণ করতে। বরং আমি চাইবো এই চিন্তাধারাতেও পরিমিতবোধকে জাগ্রত করতে। আমাদের উচিত সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের মাঝে পরিমিতিবোধ জাগ্রত করা। কেননা সকল কিছুতে পরিমিতির শুদ্ধ ব্যবহারই পারে এই পরিস্থিতিতে তুলনামূলক স্বাভাবিক জীবনধারা নিশ্চিত করতে। 

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

বিডি প্রতিদিন/আল আমীন

 

সর্বশেষ খবর