৮ জুলাই, ২০২২ ১৫:৪০

“বিধিনিষেধই একমাত্র সমাধান নয়”

বিপ্লব কুমার রায়

“বিধিনিষেধই একমাত্র সমাধান নয়”

মোটরসাইকেল বর্তমানে বাংলাদেশে যাতায়াতের অন্যতম জনপ্রিয় ও সহজ একটি বাহন। উচ্চ, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং জনসাধারণের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে মোটরসাইকেলের বিক্রি বেড়েছে। নগরবাসী এবং অফিসগামীরা রাস্তায় যানজট এড়িয়ে সহজে গন্তব্যে পৌঁছাতে মোটরসাইকেল ব্যবহার করছেন। প্রান্তিক পর্যায়ে গ্রামের কাঁচা-পাকা রাস্তায় কৃষি উৎপাদন ও বিপণনকাজে এবং ব্যবসায়িক ও দাপ্তরিক কাজে যোগাযোগব্যবস্থার অন্যতম মাধ্যম মোটরসাইকেল। এমনকি, ‘জরুরি প্রয়োজনে জীবন বাঁচাতে মোটরসাইকেল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে’ এ ধরনের শিরোনামের খবর আমরা মাঝে মধ্যেই দেখতে পাই। মোটরসাইকেল যে শুধু ব্যক্তি নিজের প্রয়োজনে কেনে, সব সময় সেটা ঠিক নয়। অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মীদের জন্য মোটরসাইকেল কিনে থাকে। বিশেষ করে ওষুধ ও নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো তাদের বিপণন কর্মকর্তাদের মোটরসাইকেল সরবরাহ করে। করোনাকালীন সময়ে মোটরসাইকেলের ব্যবহারের এক নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে করোনা ভ্যাক্সিন প্রদানে যে সফলতা, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে এটি পৌঁছে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে মোটরসাইকেল।

যানজট বৃদ্ধিজনিত কারণে ও মানসম্পন্ন গণপরিবহনের অভাবে রাইড শেয়ারিং জনপ্রিয় হয়ে ওঠায় মোটরসাইকেলের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। রাইড শেয়ারিং থেকে দেশে লাখো বেকার ছাত্র-যুবকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। মোটরসাইকেল কোনো বিলাসবহুল পণ্য নয়, বরং এটি এখন মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয় বাহন।

সড়ক দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় সরকার মহাসড়কে মোটরসাইকেল চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। পবিত্র ঈদুল আজহার আগের তিন দিন, ঈদের দিন ও ঈদের পরের তিন দিন সারা দেশের মহাসড়কে যৌক্তিক কারণ ছাড়া মোটরসাইকেল চালানো যাবে না। পাশাপাশি এক জেলায় রেজিস্ট্রেশন করা মোটরসাইকেল অন্য জেলায় চালানো যাবে না। তবে যৌক্তিক ও অনিবার্য প্রয়োজনে পুলিশের অনুমতি নিয়ে মোটরসাইকেল চালানো যাবে। এ কথা ঠিক যে সাম্প্রতিক সময়ে মোটরসাইকেলের দেশীয় শিল্পের বিকাশের কারণে এর সংখ্যা বেড়েছে। সরকারও মোটরসাইকেল শিল্পকে এগিয়ে নিতে উদ্যোগী।

উদ্যোক্তারা বাংলাদেশে অন্তত ৯টি মোটরসাইকেল কারখানা করেছেন, বিনিয়োগ করেছেন প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। মোটরসাইকেল উৎপাদন, বিপণন ও অন্যান্য কাজে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত প্রায় দুই লাখ পরিবার। ২০১০ সাল পর্যন্ত দেশে মোটরসাইকেলের সংখ্যা ছিল সাড়ে সাত লাখের মতো। বর্তমানে তা পৌঁছেছে সাড়ে ৩৭ লাখে। অর্থাৎ গত এক যুগে মোটরসাইকেল বেড়েছে প্রায় ৩০ লাখ। বিশেষ করে ২০১৬ সাল থেকে ভাড়ায় চালিত (রাইড শেয়ারিং) মোটরসাইকেল চলতে দেওয়া ও ২০১৭ সালে সরকারের প্রগতিশীল মোটরসাইকেল নীতিমালার ফলস্বরূপ এই সংখ্যা বেড়েছে। এর সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার সংখ্যাও বেড়েছে। আমাদের ভাই, বন্ধু, নিকট স্বজন আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন যার একটিও আমাদের কাম্য ছিলো না। এই দুর্ঘটনার প্রতিটি ক্ষেত্রেই কি মোটরসাইকেলচালক দায়ী?

গত ঈদুল ফিতরে লাখ লাখ বাইকার মোটরসাইকেলেই গ্রামের বাড়িতে ফেরেন। গত ২৭ এপ্রিল রাত ১২টা থেকে ৩০ এপ্রিল রাত ১২টা পর্যন্ত ৭২ ঘণ্টায় ২১ হাজার ৩৬০টি মোটরসাইকেল বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু পারাপার হয়। ১৯৯৮ সালের জুনে সেতুটি চালু হওয়ার পর তিন দিনের হিসাবে এত বিপুলসংখ্যক মোটরসাইকেল এর আগে কখনো পারাপার হয়নি। স্বাভাবিক অবস্থায় প্রতিদিন এক থেকে দেড় হাজার মোটরসাইকেল বঙ্গবন্ধু সেতু পার হয়। অন্যদিকে ২৬ জুন পদ্মা সেতু চালুর পর এক দিনেই ৪৫ হাজারের মতো মোটরসাইকেল চলাচল করেছিল (অধিকাংশই সেতু দেখতে যাওয়া পর্যটক)। বিশৃঙ্খলা ও দুর্ঘটনায় দুজনের মৃত্যুর পর ২৭ জুন থেকে সেতু দিয়ে মোটরসাইকেল পারাপার বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু পরবর্তীতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরালকৃত ভিডিওতে দেখা যায় যে উৎসুক কয়েকজন জনতাকে রক্ষা করার চেষ্টার কারণে দুর্ঘটনাটি ঘটে। আর এর পুরো দায় দেয়া হয় মোটরসাইকেল বাহনটিকে ও এর চালককে।

মূলত, বাস মালিক-শ্রমিক সংগঠন গত ৩ জুলাই ২০২২-এ আন্তঃজেলা সড়কে মোটরসাইকেল বন্ধের দাবি করার প্রেক্ষিতে কি এ সিদ্ধান্ত কিনা তা জনমনে এক বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। মোটরসাইকেল দূরপাল্লার যাত্রায় গণপরিবহনের তুলনায় ‘আকর্ষণীয়’ বিকল্প হয়ে ওঠল কেন? এ প্রশ্নের উত্তর গভীরে গিয়ে খুঁজতে হবে।

প্রশ্ন হচ্ছে, ঠিক যে যে মৌলিক কারণে আন্তঃজেলা যাতায়াতে মোটরসাইকেল বিকল্প হিসেবে উঠে এসেছে, সেসব সমাধান করা হয়েছে কি? মহাসড়কে কিংবা পদ্মা সেতুতে মোটরসাইকেল চলাচলের গতিবেগ ও নিরাপত্তাবৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণ না করে, সেতুতে গাড়ি পার্কিং নিষিদ্ধকরণ বাস্তবায়ন না করে মোটরসাইকেল নিষিদ্ধ করলেই দুর্ঘটনার সমাপ্তি হবে? মোটরসাইকেল যে নগরে ও নগরের বাইরের দূরপাল্লার যাত্রায় যাত্রীবাহী গণপরিবহনের ‘আকর্ষণীয়’ বিকল্প হয়ে ওঠল, তার সমাধান না করে একতরফা মোটরসাইকেল নিষিদ্ধ করা একমাত্র সমাধান হতে পারে না।

সবার আগে খতিয়ে দেখা উচিত, আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে সড়কে দুর্ঘটনার কারণ এবং তা থেকে পরিত্রাণ পেতে কী করণীয়। নিরাপদ সড়কের দাবি এখন পুরো জাতির। আর তার জন্যই আমাদের কাজ করা উচিত। আমরাও চাই প্রতিটি মোটরসাইকেল চালক বৈধ লাইসেন্স ব্যবহার করুক। কিশোর/অপ্রাপ্ত বয়সের কাউকেই মোটরসাইকেল চালাতে দেয়া উচিত নয়। এসব বিষয়ে আমাদের সামাজিক সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। সেই সঙ্গে মোটরবাইকের মতো স্বাধীন যানবাহন নিয়ে যাতে মানুষ নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে এবং দেশে এই শিল্পের ব্যবসায়িক সমৃদ্ধি ও প্রসার হয়, সে লক্ষ্যেই যথোপযুক্ত সিদ্ধান্তই সরকারের নেয়া উচিত। সরকার, গণমাধ্যম, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এবং সাধারণ জনগণ একযোগে কাজ করলেই কেবল দেশে নিরাপদ সড়ক বাস্তবায়ন করা সম্ভব। নিয়ম মেনে ও নিজে যথাযথ নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত করে মোটরসাইকেল চালালে দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব। এক্ষেত্রে মোটরসাইকেল চালকের পাশাপাশি সাধারণ জনগণের রাস্তায় চলাচল ও অন্য পরিবহনের চালকদেরকেও সচেতনতা বাড়াতে হবে।  কোনো কিছু বন্ধ করে দেওয়া একমাত্র সমাধান হতে পারে না। আমাদের জাতীয় স্বার্থ ও জনগণের কল্যাণে যেকোনো সিদ্ধান্তকে আমি সাধুবাদ জানাই। পাশাপাশি যাঁদের জীবন ও জীবিকার স্বার্থে এ মোটরসাইকেল ওতপ্রোতভাবে জড়িত সে বিশাল গোষ্ঠীর কথা মাথায় রেখে সামগ্রিকভাবে একটি সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা একটি সময়োচিত দাবি বলে আমি মনে করি। 

লেখক: সিইও
টিভিএস অটো বাংলাদেশ লিমিটেড 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর