গল্প
লোকটি একা ধূলিময় প্রান্তরে বসে ভাবছিল। দুঃখে এখানকার মানুষ এভাবে ভাবতে অভ্যস্ত। কেন সে তাঁর কন্যাকে হত্যা করল; অনুশোচনায় তাঁর অন্তর পুড়ে যাচ্ছিল। তাঁর শরীরের রং বদলে যাচ্ছিল। কোনো অলৌকিক ঘটনার মাধ্যমে তাঁর সমস্যার সমাধান হবে। বিপদে পড়লে তারা এভাবে অপেক্ষায় থাকে। কে আসবে সে জানে না। নিশ্চয় কেউ একজন আসবে। কারণ সে বিশ্বাসী।
সেই তিনি, যিনি বলেছিলেন ‘তোমরা কেউ কাউকে মূর্খ মনে করো না’, মহা প্রজ্ঞাবান তিনি- কন্যা সন্তান হত্যাকারীকে যুগপৎ সময়ে পেয়ে গেলেন। তিনিই এলেন। জ্যোতির্ময় আলো ঝলমল বদনে তিনি সৌম্যকান্তি দেহে বাতাসে ভর করে কোথা থেকে এলেন।
হন্তারক পিতার সম্মুখে দাঁড়ালেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কেমন আছো?’
লোকটি সামান্য বিচলিত হলো। কিছুক্ষণ মুখে কোনো কথা এলো না তার। পরে বলল, ‘আমি বেঁচে আছি, তাই বলতে হবে ভালো আছি, আপনার করুণায়। কিন্তু অনুশোচনায় পুড়ে যাচ্ছি। দুই রকম জীবন ধারণকারী আমি ভালো থাকি কী করে! আমি আমার মেয়েকে মূর্খ ভেবে হত্যা করে মহা অন্যায় করেছি। আমাকে এর থেকে মুক্তির পথ দেখান। আপনি নিশ্চয় শুধু ক্ষমার ভিতর দিয়ে আমাকে যন্ত্রণায় নিক্ষেপ করবেন না।’
তিনি জানতে চান-, ‘এখন তুমি কী করতে পারো?’
‘আমি কী করতে পারি জানি না। আপনার সাহায্য চাই।’
‘তুমি একজন মূর্খ মানুষ খুঁজে নিয়ে এসো। তারপর তোমার সঙ্গে কথা হবে।’ বলে প্রজ্ঞাবান চলে গেলেন।
কন্যা হন্তারক তার পরিচিত লোকজনকে জিজ্ঞেস করতে লাগলেন, ‘তোমাদের মধ্যে কে আছো মূর্খ, যে আমার যন্ত্রণার ভাগ নেবে। কে আছো সেই সাহসী মূর্খ যে সবার সামনে দাঁড়িয়ে বলতে পারবে আমি মূর্খ। অন্তত আমার সঙ্গে যাবে মহান দয়াবানের সামনে মূর্খতার পরিচয় দিতে।
লোকজন তার আহ্বান শোনে আর অবাক দৃষ্টিতে তাকায়। লোকটা বলে কী! এখানে কেউ নিজকে মূর্খ মনে করে না। অনেক টাকার বিনিময়েও কেউ রাজি হবে না মূর্খ হতে। লোকটার মুখ কাপড় দিয়ে বেঁধে দেওয়া দরকার। এমন ডাক আমরা শুনতে চাই না।
এই আলোচনা আরও ঘন গভীর এবং জটিল হয়ে ওঠে এবং লোকজন বলে, ‘তুমি কোন অধিকারে মূর্খ লোক খুঁজছো। তুমি কী আমাদের এত দিনের অর্জনকে মিথ্যে প্রমাণ করতে চাও। তুমি চিৎকার করে মূর্খ খুঁজবে না।’
সে তখন সিদ্ধান্ত নেয় আর কোনো দিন মূর্খ খুঁজবে না। মনে করে সমাজে কোনো মূর্খ নেই। একটা পরিপাটি অমূর্খ পরিবেশকে সে কলুষিত করতে পারে না, এ অধিকার তার নেই। সে আবার বিস্তৃত ধূলির প্রান্তরে বসে চিন্তামগ্ন হয়। কোনো মূর্খ বন্ধুও যদি ভাগ্যে না থাকে তাহলে অনিঃশেষ ধূলিময় প্রান্তরই উত্তম। এখানে ভাবনাকে সীমাহীন দূরত্বে ছুড়ে দেওয়া যায়।
এমন মাঠে একদিন ধূলিঝড়ে সে বেঁচেছিল। যে তাঁকে বাঁচিয়েছে সেই ছেলেটিকে, সেই প্রেমিক যুবককে জিজ্ঞেস করলে কেমন হয়। ছেলেটি তো এ পথে আসা-যাওয়া করে।
ঘাতক পিতা অপেক্ষা করতে থাকে।
একদিন প্রেমিক যুবক এ পথে তাঁকে দেখে দ্রুত হাঁটতে শুরু করলে হন্তারক চিৎকার করে তাঁকে থামতে বলে, ‘আরে যুবক দাঁড়াও, দাঁড়াও বলছি। তুমিও কি জেনে গেছো আমি মূর্খ খুঁজছি। কী বিপদ! কথা সব সময় বাতাসের আগে চলে। আমি বলছি না তুমি মূর্খ কিন্তু আমার সঙ্গে একটু কথা বলে যাও। দয়া করে থামো।’
তারপর যুবক নিজের গতি মন্থর করে দাঁড়ায় এবং বলে ‘আপনি কেমন আছেন?’
সে বলে, ‘নিজের মেয়েকে হত্যার পর কেউ ভালো থাকতে পারে?’
তাঁর বোধের স্তরে আত্মজা হত্যার বেদনা দেখে যুবক আপ্লুত হয় তবু ধারালো প্রশ্ন করতে দেরি করে না।
‘কন্যা না হয়ে, অন্য কাউকে হত্যা করলে ভালো থাকা যায় তাহলে?’
‘এমন অভিজ্ঞতা আমার এখনো হয়নি। তুমি আমাকে ঘৃণা করো তা বুঝতে পারলাম।’
‘ঠিক আছে এখন বলুন কেন থামতে হলো আমাকে। আগে নিজের কথা বলি, আমি কৃষিকাজ করি। এবার বলুন, আমাদের বর্ধিত লোকজন কতভাবে ক্ষুন্নিবৃত্তি করে, আপনি কীভাবে করেন?’
‘আমি কথা বিক্রি করি। আমি এক প্রেমিক-প্রেমিকার হত্যার গল্প বলি। মানুষ কেন জানি হত্যার গল্প শুনতে চায়। আমি তাঁদের মুখে মৃত্যু অঙ্কিত বীভৎস ছবি দেখি। আমি এক হন্তারক পিতার কথা বলি। যে পিতা তার কন্যাকে হত্যা করার পর প্রেমিককে কাছে পেয়ে জীবনের বিনিময়ে চার প্রাণ হরণ করেছে। তুমি ভাবছো, যে নিজের কন্যার হত্যার গল্প বলে দানাপানি জোগাড় করে তার আবার শোক কীসের। বিশ্বাস করো যতবার এই গল্প বলি, ততবার আমি শোকগ্রস্ত হই। অনুশোচনা আমাকে লতার মতো পেঁচিয়ে ধরে, লাফিয়ে ওঠে। আমি আরও বেশি বাচাল হয়ে ওঠি। হত্যাকারী বাচাল হলেও মুক্তি নেই।’
যুবক বলে, ‘আমি কী করতে পারি। বলে রাখি আমি কিন্তু এখন মূর্খ না।’
‘তুমি কী আবার কারও প্রেমে নিমিজ্জিত?’
‘না। সম্ভব না।’
‘তাহলে তো তুমি মূর্খই রয়ে গেছো। চল আমার সঙ্গে, সেই মহান দয়াবান বলেছেন একজন মূর্খ নিয়ে গেলে আমাকে অনুশোচনা থেকে মুক্ত করে দেবেন। তুমি আমার মেয়েকে ভালোবাসতে শুধু এই কৃতজ্ঞতাবোধ থেকে চল।’
‘ইতোমধ্যে আপনি লোভী হয়ে গেছেন।’
‘জিঘাংসা এবং লোভ পাশাপাশি থাকে। মেয়ে জন্ম দিয়ে মেয়েকে যে মুক্তি দিতে হয় এ কথা ভুলে গিয়েছিলাম বলে হত্যা করেছিলাম।’
‘আমার এতো জ্ঞানের প্রয়োজন নেই। আমি যে এখনো আপনার গলা চেপে ধরিনি, এটাই আপনার ভাগ্য।’
‘তাই তো, তাই তো, আরও বলছি, মন দিয়ে শোনো। আমিও তো চেয়েছিলাম, অপেক্ষায় ছিলাম সেদিন তুমি আমাকে হত্যা করবে। তুমি মূর্খ বলে হত্যা করনি।’
‘না আপনার ধারণা ঠিক না। আমি আপনাকে হত্যা করলে যদি উদ্দিষ্ট ব্যক্তি ফিরে আসতো, তাহলে আপনাকে মুহূর্র্তে হত্যা করতাম।’
‘ঠিক বলেছো। আমিও তখন নিহত হতে তোমাকে প্ররোচিত করতাম। তুমি ক্রোধের বশে আমাকে হত্যা করলে অন্যায় হতো না।’
‘ন্যায়-অন্যায় জানি না। আমি আপনাকে ক্ষমাও করিনি হত্যাও করিনি। আমি যদি মূর্খ হই তবে মূর্খ।’
‘বাহ! এই তো ভালো ছেলের মতো স্বীকার করলে তুমি মূর্খ। আহ! ‘মূর্খ’। শুনতে কতো ভালো লাগছে! চারদিক থেকে কত নতুন প্রাণ জেগে উঠছে। আচ্ছা বল তো- সবাই বলছে, আমাদের এখানে কেউ মূর্খ না। কোনো মূর্খ নেই। ছি! কী নোংরা গন্ধযুক্ত কথা। বমি আসে আমার। আমরা কি বুঝি না জ্ঞান কী। ছি! শুধু একে অন্যকে ঠকানো। তুমি বল তুমি যে নিজকে মূর্খ ভাবছো তোমার ভালো লাগছে না? ইস! আমার মেয়েটা যদি বেঁচে থাকত। কী চমৎকার মূর্খ জুটি হতে তোমরা দুজনে। চল আমার আর তর সইছে না। আমাকে রক্ষা কর।’
একসঙ্গে বসবাসকারী সংখ্যায় বৃদ্ধিপ্রাপ্ত লোকজনের কাছে সংবাদ পেঁৗঁছে, তারা দুজন ধূলিময় মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ সময় কথা বলছে। সম্পর্কে বিপরীত মেরুতে অবস্থানকারী দুজন লোক এতক্ষণ কথা বলতে পারে না। লোকজন এক এক করে তাদের দিকে আসতে থাকে। একসময় অনেক লোক তাদের ঘিরে ধরে। প্রশ্ন করে-
‘তোমরা দুজনে কোন বিষয়ে কথা বলছো? আমরা জানি আমাদের মধ্যে আর কেউ মূর্খ নেই। সুতরাং কথা লুকাছাপারও কিছু নেই।’
তখন যুবক বলে, ‘আমি কিছুক্ষণ আগে স্বীকার করেছি, আমিই একমাত্র ব্যক্তি যে এখনো মূর্খ আছি।’
যুবকের কথা শুনে সবাই ছি ছি করে বলে, ‘তুমি কৃষি কাজ জানো, আগে শিকার জানতে, তুমি কেন মূর্খ হবে!’
যুবক বলে ‘এখনো কাউকে নতুন করে ভালোবাসিনি, তাই আমি মূর্খ ছাড়া আর কী! আর ভালোবাসলেও মূর্খতা থেকে মুক্তির বিষয়টি ভিন্ন, আমি মনে করি মূর্খতা সরল জীবনের পূর্বশর্ত।’
তার কথা শুনে সবাই একইরকম শব্দ করলে মৌমাছির গুঞ্জনের মতো শোনা যায়।
কে একজন বলে, ‘তুমি কতজনকে হারালে মূর্খতা থেকে মুক্ত হবে? এই কন্যা হত্যাকারী তোমাকে নিশ্চয় কথার প্যাঁচে ফেলে কথা আদায় করেছে। তুমি নিজের বিপদ নিজে ডেকে আনলে আমাদের কিছু করার নেই। তুমি ইচ্ছে করলে মহান ক্ষমাবানের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারো। নিশ্চয় তুমি পুরস্কার পাবে। তুমি যাতে পথ না হারাও, লোকটার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত না হও, তুমি ক্ষুদ্র অস্ত্রখানা সঙ্গে রাখতে পারো।’ এ কথা বলে বক্তা একটা ধারালো চাকু প্রেমিক যুবকের ডান হাতে গুঁজে দেয়, তারপর তারা প্রস্থান করে।
তিন দিন তিন রাত ধূলিময় মাঠের পশ্চিম অংশে অপেক্ষার পর তিনি-মহা দয়াবান, মহা প্রজ্ঞাবান সত্যি দেখা দেন। তিনি অযুত নিযুত শীতল জ্যোৎস্নার পরত সরিয়ে তাদের সামনে এসে দাঁড়ান।
তখন তিনি যুবককে বলেন, ‘তুমি কি সত্যি এখনো মূর্খ আছো?’
যুবক কম্পিত কণ্ঠে বলে, ‘না- আমি মূর্খ নই।’
‘তাহলে কেন এসেছো? তুমি জানো নিশ্চয় আমি একজন মূর্খকে আসতে বলেছি।’
‘হ্যাঁ আমি জেনেশুনে এসেছি। আমি এই লোকটিকে কন্যা হারানোর যাতনা থেকে মুক্তির বিনম্র অনুরোধ নিয়ে এসেছি। আপনি এই কন্যা হারানো পিতাকে মুক্ত করে দিন।’
যুবকের এমন বিনীত প্রার্থনা শুনে কন্যা হারানো লোকটি এক গগনবিদারী আর্তচিৎকার দিয়ে ভূতলশায়ী হয়।
জ্যোৎস্নামাখা ধুলুবালিতে গড়াগড়ি শেষ হলে তার প্রাণবায়ু তাকে ত্যাগ করে।
মহান দয়াবান তখন বলেন, ‘তার মুক্তি এভাবেই লেখা ছিল।’
যুবক মনে মনে বলে, ‘আমি তাকে রক্ষা করতে পারলাম না প্রভু। আমাকে ক্ষমা করো।’
শোনা যায়
সেই থেকে মূর্খ-অমূর্খ কেউ কাউকে রক্ষা করতে পারে না।
সেই থেকে মূর্খতা থেকে বুদ্ধি, বুদ্ধি থেকে চালাকি উৎপন্ন হতে শুরু করে।
সেই থেকে জ্ঞানের শিল্পরূপ দেখে মানুষ বারবার বিস্মিত হয়।