আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যে ইমদাদুল হক মিলন (১৯৫৫-) একটি উজ্জ্বল নাম। যাঁর হাতে প্রাণ পেয়েছে যন্ত্রণাকাতর মানুষের বিপর্যস্ত সময় ও বিপন্ন জীবন। তাঁর গল্পের সহজ-সরল গীতল ভাষার বয়ানে বারবার এবং প্রতিবার টান পড়ে জীবনকথার সুতোয়। জীবনবোধের উপান্তে নির্মিত এ সাহিত্যিকের প্রতিটি গল্প ও উপন্যাসের প্রেক্ষাপটে লুকিয়ে আছে বহুমাত্রিক জীবনের এক একটি হীরন্ময় টুকরো। সৃজনশীল এই মানুষটির কথার শব্দমালায় সহজাতভাবে তাই উঠে এসেছে ভেঙে পড়া মানুষের অন্তর্দহন, জীবন-সংগ্রাম ও কামনা-বাসনা। যে বিক্ষিপ্ত পরিসর ও সময়ের বেলাভূমিতে তাঁর বেড়ে ওঠা, সেখানকার উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের ক্লেদাক্ত বেশকে তিনি দেখেছেন খুব সতর্ক দৃষ্টিতে। তাঁর এ অবলোকন শুধু মানুষের বাইরের হতাশাগ্রস্ত চেহারা নয়, বরং তীক্ষ অন্তর্দৃষ্টির লেন্সে তাদের মর্মন্তুদ অবয়বের উপলব্ধিও।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে সাহিত্যচর্চার নতুন উদ্দীপনা দেখা দেয়। নিজস্ব নির্মাণশৈলীর অভিব্যঞ্জনায় দেশমুক্তির অব্যবহিত পরে অনেকে খ্যাতিমানও হয়ে ওঠেন। হাল সময়ে আবার তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ বিশেষ পরিচয়ের সুযোগে বাগিয়ে নেন ঈর্ষণীয় পুরস্কারের লাবণ্য। সুবিধাবাদী প্রাপ্তির প্রতিকূল স্রোতে নীরবে আপন প্রতিভাবলে সাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন নিজেকে তুলে ধরেছেন স্বকীয় উচ্চতার শীর্ষে। সমালোচনার মাপকাঠিতে নেতিবাচক দৃষ্টি ফেলে তাঁর সৃষ্টিকর্মকে যেভাবেই দেখা হোক না কেন, তাঁর শিল্প নির্মাণের অঙ্গীকার ও কাহিনি বুননের মুনশিয়ানা অনস্বীকার্য। প্রকৃত শিল্পীর মর্যাদা পেতে হলে সৃষ্টির মধ্যে যে প্রাতিস্বিকতা প্রয়োজন, মিলনের সৃষ্টি কাঠামোর আঁধারে শিল্পত্ব বৈশিষ্ট্যে তা দৃশ্যমান। সমালোচকদের সংজ্ঞার্থ বিশ্লেষণে প্রতিধ্বনি-সাহিত্য জীবনের নিরেট সত্য প্রতিচ্ছবি আঁকে। ফলে চাইলে সেখানে খেয়াল খুশি মতো জীবনের সবকিছু উন্মুক্ত করা যায় না। কেননা তার মধ্যে থাকে শিল্পীর সৃজনশীলতার দায় এবং বস্তুনিষ্ঠ শিল্প সৃষ্টির অনন্য প্রয়াস। ফলে শিল্পীর নির্মাণকলায় থাকে জীবনের মহৎ দিককে প্রসারিত করার আন্তরিক প্রণোদনা।
কিন্তু কোনো কারণে যদি কারও লেখার মধ্যে সেই ত্রুটি দেখা দেয়, তবে লেখকের দেখানো দর্শন জীবনকে দেখতে ও ভাবতে শেখার প্রবৃত্তি সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়। সংগতভাবে তাই লেখকের রচনায় থাকতে হয় অনিবার্য সত্যের প্রতীতি ও প্রকৃত শিল্প নির্মাণের প্রতিশ্রুতির পারঙ্গমতা। তা না হলে তাঁর লেখা অনর্থক হয়ে যায়। ফলে অনর্থক সৃষ্টির বাহুল্য লেখককে বর্তমান যে পরিচয়ে অভিনন্দিত করুক না কেন, পরিশেষে মহৎ লেখক হিসেবে তার অবস্থান অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। মানুষ ও তাঁর জীবনের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক প্রকাশই সাহিত্য। যার মৃণালে মানবজীবনের আনন্দ বেদনা কুসুমিত হয়ে ওঠে। অথচ এই পুষ্প বিকশিত করতে প্রয়োজন পড়ে প্রতিভাবান শিল্পীর সুস্থ হৃদয়ের নান্দনিক ও মানবিক নিবেদন এবং একই সঙ্গে পারিজাত প্রতিভাসের শৈল্পিক আল্পনার বর্ণিল অলিন্দ। বলার অপেক্ষা রাখে না, শক্তিমান লেখকদের বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে আত্মিক ও মননশীলতার স্বতঃস্ফূর্ত পরিস্ফুটনেই নির্মিত হয় মহৎ সাহিত্য। যে সাহিত্যের বিভায় আলোকিত হয়ে ওঠে বর্তমান ও অনাগত দিনের পাঠক সমাজ।
এ সূত্রের আনুক্রমিক পথে ইমদাদুল হক মিলন তাঁর সৃষ্টির মহাদেশকে প্লাবিত করেছেন একজন জীবনবোধে উদ্দীপ্ত শিল্পী হিসেবে। মানুষ ও প্রকৃতি তাঁর সৃষ্টির সত্তার অন্যতম দিক। অতীত জীবন অভিজ্ঞতা আশ্রয়ী এ সাহিত্যিকের সৃষ্টির ভিতরে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ থাকে নিরন্তর প্রবহমান। স্বাধীনতা-উত্তর শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, অল্পশিক্ষিত এবং নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষের প্রাত্যহিক দিনযাপনের যে অভিঘাতকে তিনি দেখেছেন, তাই তাঁর ভাব-ভাবনায় সঞ্চারিত করেছেন প্রবলভাবে। এক্ষেত্রে তার দার্শনিক সত্তার বীজ রোপিত হয় খুব ছোটবেলা থেকে। যেখানে প্রোথিত তাঁর জীবন উপলব্ধি, অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা। শিল্প আকাশে ব্যক্তি মানুষের অস্তিত্ব ও নিজের সম্পর্কে ব্যক্তির মানসিক এবং অবচেতন মূল্যায়ন সাহিত্যিকের জীবন ভাবনার মূল পরিপ্রেক্ষিত। অন্যভাবে বলা যায়, ‘জীবনকে অর্থপূর্ণ, উদ্দেশ্যময়, তাৎপর্যপূর্ণ ও সুসংহত করে’ তোলাও জীবনবোধের নামান্তর। মানুষের জীবনে প্রকৃত উপলব্ধি আসে হর্ষ-বিষাদের ভিতর দিয়ে। দুঃখ-যন্ত্রণা, আনন্দ, ব্যথা ও বেদনার মধ্য দিয়ে জীবনের অস্তিত্ব অনুভূত হলেই সত্যিকার জীবনবোধ বিস্রস্ত হয়ে ওঠে।
এই অনুভাবনার সীমানায় ইমদাদুল হক মিলনের সাহিত্যের মধ্যে একটু গভীরে নিরিখ দিলে তাঁর যাপিত জীবন, নৈতিকতা, আদর্শ ও জীবনবোধ সমকালীন সময়ের অনুভূতির দীপ্র আলো চোখে বিস্ময়ের ঘোর লাগায়। নিজের চারপাশের মানুষের স্বরূপকে প্রত্যক্ষ, আপন পরিবেশকে চেনা এবং সেইসঙ্গে ব্যক্তির গহীন মনের ভাঙচুরকে তিনি শিল্পিত্বের আঁচড়ে প্রতিপাদিত করেন আপন বেগে। প্রাসঙ্গিকভাবেই তাই দিন দিন তাঁর সাহিত্য জগৎ হচ্ছে ঋদ্ধ থেকে ঋদ্ধতর। চলমান সময় বিন্দুতে হুমায়ূন আহমেদ (১৯৪৮-২০১২) ও তৎপরবর্তী সময়ে যাঁরা লিখে বিখ্যাত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ইমদাদুল হক মিলনকে সহজেই তাঁর সৃষ্টি নৈপুণ্য সিদ্ধির জন্য আলাদাভাবে চেনা যায়। মিলনের জানার ক্ষেত্র বিস্তৃত হলেও তাঁর নির্দিষ্ট কোনো পূর্বসূরি নেই। বহুবিচিত্র অভিজ্ঞতা তাঁর সৃষ্টি বলয়ের প্রধান বর্ম। বস্তুনিষ্ঠ সাহিত্য সৃষ্টির সরোবরে তিনি ব্যতিক্রমী, সংগ্রামী, জেদি ও বিবেকী একক ব্যক্তিত্ব। মাত্র উনিশ বছর বয়সে প্রথম গল্প লেখেন ‘বন্ধু’ (১৯৭৩)। ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত হয়েছে প্রথম উপন্যাস ‘যাবজ্জীবন’। তারপর থেকে বিরতিহীনভাবে লিখে চলেছেন গল্প, উপন্যাস ও নাটক।
ইমদাদুল হক মিলনের সাহিত্য সম্পর্কে অনেকে প্রায় চারিয়ে থাকেন- তিনি শুধু বিনোদনের জন্যই গল্প-উপন্যাস লেখেন। কিন্তু তাকিয়ে থাকার নাম দেখা নয় বলে যে কথা প্রচলিত আছে, কেবল সে দৃষ্টিতে দেখলেই যে কোনো সৃষ্টিশীল মানুষের সৃষ্টিকে নিয়ে এমন বিভ্রান্তির পালে বেগ সঞ্চার করা সম্ভব। কিন্তু একটু নিমগ্ন চিত্তে তাঁর রচনা পড়লে এ অভিমতের পক্ষে কোনো সদর্থক উত্তর মেলে না। তবে সব গল্প-উপন্যাসের মাত্রাগুণ সমান হবে, সে অন্য কথা। বৌদ্ধিক চেতনা ও নিরাবেগ-নিরাসক্ত দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করলে এই সাহিত্যিকের শিল্প-সার্থকতার অন্তর্হিত শক্তিটি সহজেই বোঝা যায়। যেখানে দেখা যায়, সাহিত্যিক মিলন তাঁর গল্প-উপন্যাসের মধ্যে পাঠককে শুধু আনন্দ ও তৃপ্তি দিতে চান না বরং তিনি কাহিনির প্রেক্ষাপটে সমাজ ও জীবনের সত্যকে প্রতিষ্ঠা দিয়ে যান আদ্যন্ত। সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় হলো, লেখক তাঁর লেখার ভিতর কোনো মিথ্যার আশ্রয় নেন না কোনোভাবেই। যা সত্য তাকে তিনি শৈল্পিক ক্যানভাসে সার্থক শিল্পে রূপ দেন নির্ভার গদ্যে। বর্তমানে অনেক লেখকই নামডাকের আড়ালে প্রকৃত সত্যকে আড়াল করে বই বিক্রির নেশায় মিথ্যা কাহিনি নির্মাতা বনে যান নিমিষেই। ফলে তারা আজীবন সত্য থেকে পালিয়ে নিজকে পুরে রাখেন তাদের সৃষ্টির অন্ধকারে।
ইমদাদুল হক মিলন এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। গল্পের কাহিনি নির্মাণে সততা ও অনুপম জীবনবোধই তাঁর প্রধান শক্তি। সংবেদনশীল অনুভবের প্রাপ্ত কষ্ট ও বেদনাকে জীবনসম্পৃক্ত করেই তিনি নতুন সৃষ্টির পথে এগিয়ে চলেন দিনের পর দিন, রূপান্তর হতে হতে। রাগ-বিদ্বেষ ও সংকীর্ণতার বিপরীতে মহৎ শিল্পকর্ম সৃষ্টির উন্মাদনা ইমদাদুল হক মিলনের সাহিত্য রচনার উজ্জ্বল প্রান্ত। ফলে বিশেষ একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে আবেগে মাতাল হয়ে তিনি নিজেকে বেসামাল করেন না কখনো। কৃর্তিমান লেখকদের মতো তিনিও চিরন্তন সাহিত্য নির্মাণের ব্যাকুলতায় কলম হাতে নেন শাশ্বত রচনা উদ্ভাসনের অঙ্গীকারে। বিশেষ সুবিধা পাওয়ার প্রত্যাশায় একরোখা শ্রেণিভেদ শিল্প ক্যানভাস সৃষ্টিতে মগ্ন না হয়ে মানবতাকেই তিনি তাঁর লেখার ভরকেন্দ্র করেন দিবানিশি। ব্যক্তিগত হতাশায় আবাল সাহিত্য রচয়িতাদের মতো চিৎকার করে কোনো বিশেষ ঘরানার ঘেরে নিজেকে আবৃতও করেন না কোনোভাবেই। আর এই ব্যতিক্রম বৈশিষ্ট্যই তাঁর শিল্পকে দিয়েছে শক্তিশালী সাহিত্যিকের অনন্য মাত্রা। ৮ সেপ্টেম্বর কান্তিমান প্রিয় সাহিত্যিকের জন্মদিন। আলোকিত জন্মদিন, জন্মকে ছাপিয়ে জীবনোত্তর হয়ে উঠুন তিনি এখন, তখন এবং সর্বক্ষণ। অন্তর্লীন শুভকামনা ও শ্রদ্ধা রইল মহান এই লেখকের প্রতি।