বড় গল্প
মতিবিবি বাড়ি এলো সন্ধ্যার দিকে। আগেই ফোনে জানিয়েছিল। বাড়িতে প্রস্তুতি ছিল। রাবেয়া পাঙাশ মাছ রান্না করে রেখেছে। নদীর পাঙাশ পাবে কোথায়? ম্যালা দাম। চাষ করা পাঙাশ এনে দিয়েছে বশির।
বশিরের একটা পা খোঁড়া। এ জন্য লোকে ডাকে ‘ল্যাংড়া বশির’। গৌধূলিয়া বাজারে তার একটা চায়ের দোকান আছে। তবে দোকানের আয়ে পাঁচজনের সংসার চলে না। সংসার ছিল ছ’জনের। চার মেয়ে আর স্বামী-স্ত্রী। দু’বছর আগে বড় মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেছে। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই মেয়ের কোলে মেয়ে। বড় নাতনির নাম জরিনা। বাড়ির লোকে ডাকে ‘জরি’। জরির স্বামী ভাগচাষী। গরিব মানুষের সংসার।
রাবেয়ার সংসার আগলে রাখে মতিবিবি। জরি পড়াশোনা করতে পারেনি। পরের তিন নাতনিকে স্কুলে ভর্তি করিয়েছে সে। মেজো নাতনির নাম আয়না। পড়ে ক্লাস টেনে। ছাত্রী সুবিধার না। টেনেটুনে ক্লাস টপকায়। সেজোটা ময়না। সেটাও আয়নার মতোই। ছোট নাতনি শালিক। পড়ে ক্লাস সিক্সে। সে ছাত্রী ভালো। মতিবিবি বলেছে, আয়না ময়নার বিয়ে দিয়ে দেবে তাড়াতাড়ি। শালিককে পড়াবে, যতদূর সে পড়তে চায়। বিএ, এমএ পাস করাবে। স্কুল মাস্টার বানাবে।
মতিবিবির বয়স চুয়াত্তর। পঁয়তাল্লিশ বছর আগে রাবেয়াকে কোলে নিয়ে ঢাকায় চলে গিয়েছিল ঝিয়ের কাজে। রাবেয়ার তখন চার বছর বয়স। মতিবিবির বিয়ে হয়েছিল তেইশ বছর বয়সে। গ্রাম এলাকায় মেয়ের তেইশ বছর মানে সে বুড়ি। শরীর স্বাস্থ্যের কারণে আরও বুড়ি মনে হতো। লোকে ভেবেছিল এই ধুমসি মেয়ের বিয়েই হবে না। শেষ পর্যন্ত হলো। দু’বছর পর মেয়েও জন্মাল। বিয়ে হয়েছিল মধ্যপাড়ায়। সতীনের সংসার। সতীনটি ছিল খাঁড়েদজ্জাল। দুই ছেলে। কিশোর বয়সেই সে দুটি মহাত্যাঁদড়। মতিবিবিকে সতীন তো জ্বালাতই, ট্যাটন ছেলে দুটিও খোঁচাখুঁচি করত। স্বামীটা চরিত্রহীন। চাষের জমি ছিল ভালোই। মতিবিবির পর আরও দুটো বিয়ে করেছে। তার পরও রাবেয়াকে নিয়ে মাটি কামড়ে স্বামীর বাড়িতে পড়েছিল সে। একটা পর্যায়ে আর পারেনি। স্বামী সতীনের অত্যাচার, ডেকরা হয়ে ওঠা ছেলে দুটো বেদম মারধর করে রাবেয়াকে। নিজে অত্যাচার সহ্য করতে রাজি ছিল মতিবিবি। ওইটুকু মেয়ের ওপর নির্যাতন মানতে পারেনি। মেয়ে কোলে চোখ মুছতে মুছতে বাপের বাড়িতে চলে এসেছিল। বাপ-মা গত হয়েছে অনেক দিন। একটা মাত্র ভাই। বড়। তার তিনটা ছেলে। আথালে পাঁচটা গোরু। বাড়িটা বিঘাখানেকের ওপর। চাষের জমি আছে তিন-চার বিঘা। ছেলেদের নিয়ে চাষবাস করে মন্দ চলে না।
ভাই আশ্রয় দিয়েছিল বোন ভাগ্নিকে। তার অবশ্য কারণও ছিল। আইন মতো বাপের সম্পত্তির চার ভাগের এক ভাগ পাবে মেয়ে। ভাইটা লোক খারাপ না। বোনের হক মারতে চায়নি। তবে বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াতেও রাজি না। জায়গা সম্পত্তির অংশ পাবে ঠিক আছে। বোন তা বুঝে নিলেও অসুবিধা নেই। বসিয়ে খাওয়ানো যাবে না।
মতিবিবির তখন সাতাশ বছর বয়স। ভাই আবার বিয়ে দিতে চাইল। সে রাজি হলো না। মেয়ে নিয়ে যে সংসারেই যাক, মেয়ের নির্যাতন হবে। এটা মতিবিবি মেনে নেবে না। এই কারণেই বিয়েতে সে রাজি হলো না। গৌধূলিয়া গ্রামের হাফেজা ঝিয়ের কাজ করে ঢাকায়। মহিলাটি মধ্যবয়সি। তার সঙ্গে ঢাকায় চলে এলো। কোলে রাবেয়া। বাচ্চাসহ কাজের ঝি রাখতে চায় না কেউ। তবে রাবেয়া হয়েছে তার মায়ের মতো। নিরীহ, চুপচাপ। এই কারণে এক লঞ্চ ব্যবসায়ীর বাড়িতে কাজ পেয়েছিল। রাবেয়া ধীরে ধীরে বড় হচ্ছিল। ওই বাড়িতেই ফুটফরমাসের কাজ করত। চৌদ্দ-পনেরো বছর বয়সে মায়ের মতোই উঁচু লম্বা হয়ে উঠল। মতিবিবি ছ’ফুটের কাছাকাছি লম্বা। মোটা। হাঁটাচলা ধীর, শান্ত। সারা দিনে দশ-বিশটা কথাও বলে না। রাবেয়া হয়েছে তার মতোই। শরীর স্বাস্থ্যের কারণে পনেরো বছরের মেয়েটিকে পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের মনে হয়। এ সময় মেয়ে নিয়ে বাড়ি এসেছে মতিবিবি। ভাইয়ের ঘটকালিতে গরিব চাচার সংসারে লাত্থিগুতা খেয়ে বড় হওয়া এতিম ল্যাংড়া বশিরের সঙ্গে রাবেয়ার বিয়ে হয়ে গেল। নিজের ভাগের কিছু অংশ ভাইয়ের কাছে বিক্রি করে আর লঞ্চ ব্যবসায়ী পরিবারটির সহায়তায় ধুমধাম করেই রাবেয়ার বিয়ে হলো। বাড়িতে নিজের যেটুকু অংশ ভাগে পেয়েছিল, সেই অংশ আলাদা করে, চারদিকে বাঁশের বেড়া, মাথার ওপর টেউটিনের চাল, একটা ঘর তোলা হলো রাবেয়ার জন্য। ল্যাংড়া বশির ঘরজামাই হয়ে এই ঘরে উঠল। বাজারে চায়ের দোকান করল মতিবিবির টাকায়।
রাবেয়ার বিয়ের পর মতিবিবি ভেবেছিল মেয়ের সংসারেই থেকে যাবে। নিজের ভাগের জমিটুকু বর্গা দেওয়া। দোফসলি জমি। ভাগে যেটুকু ধান পাওয়া যায়, খেয়েপরে বাঁচতে পারবে।
মাস ছয়েক মেয়ের সংসারে মতিবিবি থেকেও ছিল। রান্নাচালার পাশে একচালা একটা ছাপরা ঘর তুলে থাকত। তবে সংসারে শাশুড়ি থাকাটা বশির পছন্দ করত না। এই নিয়ে রাবেয়ার সঙ্গে খ্যাচরম্যাচর করত। সেই সব কানে যেত মতিবিবির। বড় লজ্জা লাগত।
শেষ পর্যন্ত আবার ঢাকায়। আবার ঝিয়ের কাজ। এক বাড়িতেই কাটিয়ে দিল বত্রিশ বছর। সেই জীবন শেষ করে ফিরে এলো মেয়ের সংসারে। তত দিনে ছেলের আশায় চার চারটি মেয়ে জন্ম দিয়েছে বশির। সংসার বড় হয়েছে ঠিকই, আয় রোজগার বাড়েনি। তার সংসার সচ্ছলভাবে চালিয়ে দিত মতিবিবি। থাকা খাওয়া বাদে সে বেতন পেত চার হাজার টাকা। ধীরে ধীরে সেটা হয়েছে বারো হাজার। হাজার পাঁচেক নিজের হাতে রেখে বাকিটা পাঠিয়ে দিত রাবেয়াকে। নাতনিদের জন্য বাড়িতে আরেকটা ঘর তুলে দিয়েছে। মাঝখানে বাঁশের বেড়া দেওয়া সেই ঘরে দুই কামরা। বড় নাতনির বিয়ের টাকা দিয়েছে। বাড়িতে কারেন্ট আনিয়েছে। চাপকল বসিয়েছে। তিন নাতনিকে স্কুলে পড়ায়। যে বাড়িতে এত দিন আছে, সেই বাড়ির সাহেব ম্যাডাম খুবই ভালো। বেতনের বাইরেও নাতনিদের পরীক্ষার ফি, ঈদের সময় জামাকাপড়, সবই তাঁরা দেন। বড় নাতনির বিয়ের সময় পঞ্চাশ হাজার টাকাও দিয়েছিলেন।
একটা সময়ে শরীর আর চলছিল না মতিবিবির। তার পরও সাহেব ম্যাডাম তাকে ছাড়তে চাননি। বলেছিলেন, ‘যত দিন বেঁচে আছ, আমাদের এখানেই থাক।’ মতিবিবির মন মানেনি। একদা রাবেয়া ছিল নয়নের মণি। নাতনিগুলো জন্মাবার পর সেই চারটি দখল করেছে মায়ের জায়গা। সে চাইল বাকি জীবনটুকু মেয়ে আর নাতনিদের সঙ্গে কাটাতে।
খাওয়া-দাওয়া সেরে নাতনিদের ঘরে এসে ঢুকেছে মতিবিবি। বিছানায় কাত হয়েছে। তিন নাতনি বসেছে পাশে। আয়নাকে একটা মোবাইল কিনে দিয়েছিল। নাতনিটার মোবাইলের ভারি শখ। মতিবিবির সামনে বসেও সেই মোবাইলই টিপাটিপি করছে আয়না।
মতিবিবি বলল, ‘‘কী রে, কারে এত ফোন করছ? ঘটনা কী?’’
আয়না মোবাইল টিপা বন্ধ করে নানির দিকে তাকিয়ে হাসল। ‘‘একটু ফেইসবুক দেখলাম। কও, কী কইবা?’’
ময়না বলল, ‘‘নানি, তুমি আয়নারে বেশি আদর করো। মোবাইলের শখ তো আমারও আছে! আমারেও একটা কিন্না দেও!’’
শালিক বলল, ‘‘এই কামও কইরো না নানি। মাইজাবু মোবাইল ছাড়া কিচ্ছু বোঝে না। হারাদিন মোবাইল লইয়া থাকে। লেখাপড়া করেই না। রাইত জাইগা মোবাইল টিপে। সাইজাবুও ওর লগে জাইগা থাকে।’’
আয়না ময়না কটমটে চোখে শালিকের দিকে তাকাল।
আয়না বলল, ‘‘বেশি ক্যাটক্যাট করবি না। আমরা দুই বইন তর লাহান মাস্টারনি হমু না।’’
মতিবিবি বলল, ‘‘মাস্টারনি না হছ, মেট্টিক পাস তো করবি? নাইলে ভালো বিয়া দেওন যাইব না। জরির লাহান চাষীর ঘরে বিয়া হইব।’’
আয়না বলল, ‘‘আমার বিয়া ভালো ঘরেই হইব।’’
মতিবিবি চোখ সরু করে আয়নার দিকে তাকাল। ‘‘পেরেম পিরিতি কইরা ফালাইছসনি?’’
আয়না বলল, ‘‘না না, ওই হগল কিছু না।’’
ময়নার ভাবান্তর নেই। শালিকের মুখে সূক্ষ্ম হাসি। মতিবিবি তা খেয়াল করল না। বলল, ‘‘খবরদার আয়না, মানইজ্জত নষ্ট করিস না। ময়না, তরেও কই। ঠিকঠাক মতন চলিস। তগো বয়স কম। দেকলে হেইডা মনে হয় না। তর মায় হইছে আমার লাহান আর তরা হইছস তর মার লাহান। উঁচা লাম্বা, ধুমসি। আয়নার বয়স সতের। ময়নার পোনরো। শালিকের তেরো। তয় বেবাকটিরেই মনে হয় কুড়ি-পঁচিশ বৎসর বয়স। চেহারা-সুরতও খারাপ না। দেকলে বেডাগো চোখ টাটাইব। খবরদার! ফান্দে পরিস না। বুইজা চলিস।’’
আয়নার ফোন বেজে উঠল। ব্যস্ত ভঙ্গিতে রিংটোন অফ করে দিল সে।
মতিবিবি বলল, ‘‘কার ফোন?’’
আয়না বলল, ‘‘রং নম্বর।’’
এবারও শালিক আগের মতো হাসল। মতিবিবি খেয়াল করল না। আয়না করল। নানি যাতে দেখতে না পায়, সেই ভাবে চোখ পাকিয়ে শালিকের দিকে তাকাল।
বোনকে বাঁচাবার জন্য কথা অন্য দিকে ঘুরাল ময়না। ‘‘ও নানি, আমরা চাইর বইন বাবার কিছুই পাই নাই। বাবায় বাইট্টা। মা-র থিকা লাম্বায় অনেক ছোট। আমরা এত উঁচা লাম্বা হইছি ক্যান? মাইনষে কয়, এমুন মাইয়াগো এমুন সাইজের জামাই পাওয়া যাইব না। বড়বুর জামাইডাও বাইট্টা।’’
আয়না বলল, ‘‘আমি বাইট্টা মাইনষের কাছে বিয়া বমু না।’’
মতিবিবি বলল, ‘‘তরে লাম্বাই আইন্না দিমু নে।’’
তখন আবার বাজল আয়নার ফোন। এবার ফোনই অফ করে দিল আয়না। কপট রাগের ভঙ্গিতে গজগজ করতে লাগল। ‘ইস, এত রং নম্বর আসে...’!
দুই.
আয়নার ফোনের রহস্য পর দিন ফাঁস করে দিল শালিক। বিরুলিয়ার রুস্তম মিয়ার ছেলে মিজানের সঙ্গে সম্পর্ক হয়েছে আয়নার। স্কুল ফাঁকি দিয়ে আয়না তার সঙ্গে দেখা করে। মোবাইলে দিনরাত ফুসুর ফুসুর। মিজানদের অবস্থা ভালো। জায়গা সম্পত্তি আছে অনেক। বাজারে পাইকারি মালের দোকান। ক্লাস নাইন পর্যন্ত পড়ে সে আর পড়াশোনা করেনি। বাড়ির ছোট ছেলে। মোটরবাইক আছে। ইয়ারদোস্তদের সঙ্গে বাইক দাবড়ায় আর আড্ডাবাজি করে। আয়নার জন্য পাগল।
সব বলে মতিবিবিকে খুবই অনুনয় করল শালিক। ‘‘খবরদার নানি, আমি যে তোমারে বেবাক কথা কইছি, এইডা জানলে মাইজাবু আর সাইজাবু দুই জনে মিলা আমারে মারব। দুই বইনে বিরাট খাতির।’’
শুনে মতিবিবি কোনও কথা বলল না। চিন্তিত চোখে শালিকের দিকে তাকিয়ে রইল।
পাঁচ দিনের মাথায় আয়নাকে হাতেনাতে ধরল মতিবিবি। এই ক’দিন ঘুণাক্ষরেও কাউকে কিছু বুঝতে দেয়নি। এমনভাবে আয়নার ওপর চোখ রাখছিল, সে কল্পনাও করেনি নানির হাতে ধরা পড়বে।
ধরা পড়ল মধ্যরাতে। ঘর অন্ধকার। এক কামরায় শালিকের সঙ্গে ঘুমায় মতিবিবি। বাঁশের বেড়ার মাঝখানে খোলা দরজা। ওপাশে আয়না আর ময়না। সেই রাতে হঠাৎই ঘুম ভাঙল তার। ও পাশ থেকে আয়নার ফিসফিসে কথা কানে এলো। নিঃশব্দে উঠল সে। পা টিপে টিপে গেল আয়না ময়নার বিছানার কাছে। ময়না বেঘোরে ঘুমাচ্ছে আর আয়না মোবাইলে ফিসফিস করে কথা বলছে। কখনও কখনও চাপা কণ্ঠের হাসি। মতিবিবি জানে চৌকির সামনের দিকটায় শোয় আয়না। সে আয়নার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। এক সঙ্গে দুটো কাজ করল। থাবা দিয়ে ফোনটা নিল এক হাতে, আর অন্য হাতে চেপে ধরল আয়নার মুখ, যেন নাতনি কোনও শব্দ করতে না পারে।
মতিবিবি ফোন কানে লাগাল। ও পাশে উত্তেজনার ঘোরে কথা বলে যাচ্ছে মিজান। কানে শোনা যায় না এমন অশ্লীল, যৌন উত্তেজক কথাবার্তা। খানিক শুনে কঠিন গলায় মতিবিবি বলল, ‘‘ছি ছি ছি! তর মতন অসভ্য পোলার লগে আমার নাতনির ভালোবাসা হইছে? তুই তো ইতর। খাড়া, তর খবর আমি লইতাছি।’’
আয়নার মুখ ছেড়ে দিয়ে বলল, ‘‘তরে তো অহনই পিটাইয়া বাড়িত থিকা বাইর কইরা দেওন উচিত। এই রকম খাচ্চরের লগে পিরিত বাজাইছস?’’
ততক্ষণে ময়নার ঘুম ভেঙেছে, শালিকের ঘুম ভেঙেছে। তারা কেউ রাঁ শব্দ করছে না। আয়না বিছানায় উঠে বসেছে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে আর নানির হাতে পায়ে ধরছে। ‘‘আমারে মাপ কইরা দেও নানি। আমি ওর লগে আর সমন্দ রাখুম না। তোমার পায়ে ধরি। বাবারে কইয়ো না। বাবায় আমারে পিটাইয়া মাইরা ফালাইব।’’
‘‘তরে তো পিটানই উচিত। এই রকম বজ্জাতের লগে গেছস? ভুল আমারই হইছে। তরে ফোন কিনা দিছিলাম। আমার ফোন আমি লইয়া গেলাম। তুই আর ফোন পাবি না।’’
পর দিন কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে মিজানদের বাড়িতে গিয়ে হাজির হলো মতিবিবি। এগারোটার মতো বাজে। মিজান তখনো ঘুমে। মিজানের বাবা মা, ভাইদের বউ আর বাচ্চাকাচ্চারা বাড়িতে। মতিবিবিকে কেউ চেনে না। পরিচয় দিয়ে মিজানের মা-বাবাকে সব খুলে বলল সে। ছেলেকে সাবধান করতে বলে এলো। পরিবারটি ভদ্র। মতিবিবির কথায় খুবই লজ্জা পেল। ছেলেকে সামলাবার আশ্বাস দিল।
পরের সপ্তাহে স্কুলে যাওয়ার নাম করে আয়না উধাও হয়ে গেল। বিকেলবেলা স্কুল থেকে একা ফিরল ময়না। শুকনা মুখে বলল, ‘‘মাইজাবু আমার লগে ইশকুলে গেছিল ঠিকই, ছুটির পর ওরে আর খুঁইজা পাইলাম না। অনেক ক্ষণ খুঁজছি।’’
বিকেল ফুরিয়ে সন্ধ্যা হলো। আয়না ফিরল না। বশিরকে ফোন করা হলো। সন্ধ্যারাতেই দোকান বন্ধ করে সে ফিরে এলো। বাড়ির মানুষরা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। এক ফাঁকে শালিক ফিসফিস করে মতিবিবিকে বলল, ‘‘মাইজাবু মনে হয় মিজান ভাইর লগে পলাইছে।’’
আয়নার ফোনে মিজানের নাম্বার ছিল। সেই নাম্বারে ফোন করল মতিবিবি। ফোন বন্ধ। রাতেই বশিরকে নিয়ে গেল মিজানদের বাড়িতে। মিজান বাড়িতে নেই। দুপুরের পর বাইক নিয়ে বেরিয়েছে। সঙ্গে ব্যাগ ছিল। বাড়িতে বলে গেছে, তার বন্ধু হাসিবদের বাড়িতে যাবে। কয়েক দিন থাকবে সেখানে। হাসিবদের বাড়ি বরিশালের আন্ধারমানিক গ্রামে।
মুহূর্তে পুরো ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে গেল মতিবিবি আর বশিরের কাছে। ওই নিয়ে কথা বলল তারা। মিজানদের বাড়ির লোকজন হতভম্ব। মিজানের বড়ভাই হাসিবকে ফোন করল। হাসিব বলল, ‘‘তিন চার দিন ধরে মিজানের সঙ্গে তার দেখাই হয় না। সে কিছুই জানে না।’’ সবাই বুঝল আয়নাকে নিয়ে পালিয়েছে মিজান।
পর দিন থানায় গিয়ে নাবালিকা অপহরণের ডায়েরি করল মতিবিবি। ওসি সাহেব তেজিয়াল লোক। বলল, ‘‘চিন্তা করবেন না। তিন দিনের মাথায় থানায় এসে নাতনিকে দেখতে পাবেন।’’
হলোও তাই। তিন দিন পর সকালবেলা থানা থেকে ফোন এলো। বশিরকে নিয়ে ছুটে গেল মতিবিবি। আয়না আর মিজানকে বসিয়ে রাখা হয়েছে থানায়। মিজানের বাবা আর বড় দু’ভাই এসেছে। লজ্জায় সংকুচিত হয়ে আছে মানুষ তিনটি।
ওসি সাহেব কর্তৃত্ব নেওয়ার কণ্ঠে বললেন, ‘‘কী, বলেছিলাম না? দেখলেন তো, যা বলেছি তাই করেছি! পুলিশের ওপর আস্থা রাখবেন। পুলিশ সব পারে।’’
মতিবিবি কথা বলল না।
ওসি সাহেব বললেন। ‘‘এই মেয়েকে আপনি ইমম্যাচিউর বলছেন? ওকে দেখলে তো চব্বিশ-পঁচিশ বছরের মেয়ে মনে হয়।’’
বশির বলল, ‘‘না স্যার, মাইয়ার বয়স সতের আঠার। আমার চাইর মাইয়াই মা আর নানির ধরন পাইছে।’’
ওসি সাহেব হাসলেন। ‘‘তাই তো দেখছি। এখন কী করতে চান? মেয়েকে বাড়ি নিয়ে যাবেন আর ছোকরাকে আমি হাজতে ঢুকাব? নাকি দু’পক্ষের মধ্যে আন্ডারস্ট্যান্ডিং করিয়ে দেব? মেয়ে বলেছে, সে স্বইচ্ছায় মিজানের সঙ্গে চলে গিয়েছে। একটা কাজ করি, থানায়ই দু’জনের বিয়ে পড়িয়ে দিই। এটাই ভালো। নয়তো দুটো পরিবারই কেলেংকারিতে পড়বে।’’
দু’পক্ষই মেনে নিল ওসি সাহেবের কথা। তবে থানায় বিয়ে হলো না। সাত দিন পর খুবই ঘরোয়াভাবে মিজানের সঙ্গে আয়নার বিয়ে হয়ে গেল। দশ-পনেরো হাজার টাকা খরচও হলো মতিবিবির। মেয়ের সংসার কেলেঙ্কারি থেকে বেঁচে গেল।
তিন.
শ্বশুরবাড়িতে মাস তিনেক ভালোই কাটল আয়নার। বিয়ের পর কিছু দিন সুবোধ হয়ে থাকল মিজান। বাজারের দোকানে গিয়েও বসল। তার পর নতুন এক বায়না ধরল। তার দুই বন্ধু থাকে ইতালিতে। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। ঢাকায় তাদের লোক আছে। পনেরো লাখ টাকা খরচ করলে মিজান চলে যেতে পারবে ইতালিতে। বছর দুয়েক পর বউও নিয়ে যেতে পারবে। ইউরোপের সুখি সুন্দর দেশে জীবন কাটাতে পারবে।
বাড়ির লোকজন মিজানের কথা শুনল। পাত্তা দিল না। বাপ সিদ্ধান্ত দিল, ও সব হবে না। এত বড় ব্যবসা, সবাই মিলে সামলালে আরও বড় হবে। বিদেশের জীবন কষ্টের। কী দরকার সেই জীবনের?
মিজান গোঁ ধরেই থাকল। মিজানের মা আর ভাবিরা আয়নাকে ধরল তার গোঁ সামলাতে। আয়না চেষ্টা চালাতে লাগল। কাজ হলো না। ইতালিতে মিজান যাবেই। বাপ-ভাইকে চাপ দিতে লাগল তার ভাগের জায়গা সম্পত্তির অংশ থেকে যেন টাকাটা দেওয়া হয়। ভাগে সম্পত্তি যা পাবে তার দাম পঞ্চাশ লাখের কম হবে না। ওই পনেরো লাখ দিলেই পুরো ভাগ সে ছেড়ে দেবে।
তাতেও কেউ রাজি হলো না। বাড়িতে শুরু হলো অশান্তি। মিজান তখন অন্য তরিকা ধরল। আয়নাকে পটাতে লাগল। মিষ্টি মিষ্টি কথায় বউকে বোঝাতে লাগল, পরিবারের লোকজন ওপরে ওপরে ভালো। ভিতরটা তাদের কুটিলতায় ভর্তি। আয়নাকে তারা শান্তিতে থাকতে দেবে না। আর ইতালিতে গেলে জীবন কাটবে মহাসুখে। সাদা সাদা বাচ্চা হবে। তাদের দেখে নয়ন জুড়াবে।
অল্প বয়সি মেয়েদের যা হয়, প্রেমিক যদি স্বামী হয় তা হলে সেই মানুষের প্রতি প্রথম প্রথম ভালোবাসা আর আবেগের শেষ থাকে না। আয়নার চলছিল সেই অবস্থা। (পরের সংখ্যায় শেষ হবে)