একটা সময় ছিল, যখন এক টাকার চকলেটের জন্য শিশুরা বাবা-মায়ের কাছে বায়না করত। কিন্তু বর্তমানে ঊর্ধ্বগতির এই বাজারে এক টাকার যেন কোনো মূল্যই নেই। বর্তমানে নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে হাজার টাকা দিয়েও যখন প্রত্যাশিত কিছু জোটে না, তখন এক টাকায় মিলছে চিকিৎসা সেবা। রোগী দেখছেন এমবিবিএস পাস করা চিকিৎসক। বিষয়টি আশ্চর্যের হলেও তা বাস্তবে পরিণত করেছেন রাজশাহীর ইসলামী ব্যাংক মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করা ডা. সুমাইয়া বিনতে মোজাম্মেল।
বাবার ইচ্ছা পূরণে ব্যতিক্রমী এ উদ্যোগ নিয়েছেন রাজশাহীর মেয়ে সুমাইয়া। নগরীর সাহেববাজারে একটি ওষুধের দোকানে প্রাথমিকভাবে এই কার্যক্রম শুরু করেন তিনি। সেখানেই প্রতি শনি থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত রোগী দেখছেন।
২০১৫ সালে রাজশাহীর নিউ গভর্নমেন্ট ডিগ্রি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন সুমাইয়া। বড় চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্নে প্রস্তুতি নিতে থাকেন মেডিকেল কলেজে ভর্তির। সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ না পেলেও বুনতে থাকেন স্বপ্নের জাল। এমবিবিএস কোর্সে ভর্তি হন রাজশাহীর ইসলামী ব্যাংক মেডিকেল কলেজে। সম্প্রতি এমবিবিএস পাস করে ইন্টার্ন শেষ করেছেন তিনি। প্রাইভেট একটি ক্লিনিকে চাকরির পাশাপাশি বিসিএস প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আর এর পাশাপাশি করছেন জনসেবা।
ডা. সুমাইয়া বলেন, মূলত বাবার ইচ্ছে ছিল আমি যেন জনসেবামূলক কিছু একটা করি। মানুষকে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দিতে চেয়েছিলেন তিনি। তারই ধারাবাহিকতায় এই জনসেবামূলক কাজটি আমি শুরু করেছি। ইচ্ছে আছে, যতদিন আল্লাহর রহমতে বেঁচে থাকি, ততদিন এই কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার।
তিনি বলেন, সবে কয়েকদিন রোগী দেখা শুরু করেছি। লিফলেট বানানো হয়েছে। সেগুলো বিলি করা হচ্ছে। বিষয়টি এখনো সেভাবে কেউ জানে না। এক প্রকার এক্সাইটমেন্ট থেকে গত ৭ জানুয়ারি ফেসবুকে লিফলেটসহ একটা পোস্ট করেছিলাম। এতেই অনেকের নজর পড়ে। ডা. সুমাইয়া বলেন, ফেসবুকে পোস্ট করার পর থেকে অনেকেরই কল পেয়েছি, অনেকে মেসেজও করেছেন। অনেকে সাধুবাদ জানাচ্ছেন, এগিয়ে যাওয়ার জন্য বলছেন। এমনকি একজন শিক্ষক ফোন করে আমার বিস্তারিত শুনে জানতে চাইলেন আমার লক্ষ্য কী। বিসিএস প্রস্তুতির কথা বলতেই জানালেন, ‘তোমার যদি ইংলিশে প্রিপারেশন নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে, তুমি নির্দ্বিধায় আমাকে বলতে পার।’ এসব শুনেও ভালো লাগছে বলেও জানান এই চিকিৎসক।
চিকিৎসা নিতে আসা নাজমুল হক নামে এক রোগী জানান, জনসেবার উদ্দেশ্যে এমন উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। কতজন এমবিবিএস পাস করে ব্যবসার মতো টাকা রোজগারে নেমে যান, সে তুলনায় তার উদ্যোগটা খুবই ভালো। আমি নিজেও ফেসবুকে জানতে পেরে দেখা করলাম। কিছু সমস্যা ছিল আমার, উনি শুনে প্রেসক্রিপশন দিলেন। মাত্র এক টাকার ভিজিটেই ডাক্তারি পরামর্শ পেলাম। আশা করছি, এলাকার হতদরিদ্ররা তার কাছে সেবা পেয়ে উপকৃত হবেন। রোগীর ভিজিট এক টাকা নেওয়ার কারণ জানতে চাইলে এই নারী চিকিৎসক বলেন, ‘দি ফাইভ ফাউন্ডেশন’ নামে আমার একটা ছোট্ট অর্গানাইজেশন আছে। করোনার সময় থেকেই সংগঠনটির কার্যক্রম শুরু করেছিলাম। আমরা মূলত সেখানে মানুষের পাঁচটি মৌলিক চাহিদা (খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা) নিয়ে কাজ করে থাকি। এ ছাড়াও শীতার্তদের শীতবস্ত্র প্রদান, কোরবানির গোশত বিলি, অসহায়দের অর্থ সহায়তা দিয়ে ছোটখাটো ব্যবসা বা কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা, কিছু দুস্থ পরিবারে নিয়মিত খাবার সহায়তা দেওয়া, একটি এতিম বাচ্চার ভরণপোষণ দেওয়ার মতো অনেক কাজই ওই সংগঠনের পক্ষ থেকে করা হয়। সেজন্য ওই সংগঠনের আয় হিসেবে এই এক টাকা নেওয়া হচ্ছে।
নিজের ব্যক্তিজীবন নিয়ে ডা. সুমাইয়া বলেন, “আমার বিয়ের বয়স প্রায় আট বছর। পাঁচ বছর ও দুই বছর বয়সী দুটি সন্তান আছে। আমার স্বামীও পেশায় চিকিৎসক। আমার এই উদ্যোগে তিনিও খুশি এবং সব রকম সাপোর্ট দিচ্ছেন। আমি আমার আব্বু-আম্মুর স্বপ্ন পূরণ করার চেষ্টা করছি।’ সুমাইয়ার বাবা রাজশাহীর শহীদ কামারুজ্জামান সরকারি ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক মীর মোজাম্মেল আলী। স্বপ্ন পূরণে মেয়ের এমন মহৎ উদ্যোগের বিষয়ে মীর মোজাম্মেল আলী বলেন, ‘ইচ্ছে ছিল আমার চার ছেলে-মেয়েই ডাক্তার হবে। তিন মেয়ে ডাক্তার হয়েছে, আরেকজন ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে। আমাদের লক্ষ্য ছিল, তারা মানুষের সেবা করবে। আমরা ডাক্তার হতে পারিনি, সেই একটা দুঃখ ছিল সব সময়। তাই ছেলে-মেয়েদের মধ্য দিয়েই স্বপ্নটা পূরণ করার চেষ্টা করছি।’