বিশ্বকাপ ওরাই জিতবে। অন্তত ফাইনাল তো খেলবেই। ১৯৮২ বিশ্বকাপের আগে ফুটবলবোদ্ধারা দিব্য দৃষ্টিতে দেখছিলেন ব্রাজিলের হাতে চতুর্থ বিশ্বকাপ শিরোপা। ব্রাজিলিয়ান সমর্থকরাও উচ্ছ্বসিত। হাতের নাগালেই আছে সোনার হরিণ। ইচ্ছে হলেই ছোঁয়া যাবে! এ ধারণায় ১৯৮২ বিশ্বকাপের বেসরকারি ফাইনাল দেখতে ১২ হাজার দর্শক জাহাজ বোঝাই হয়ে পাড়ি দিলেন আটলান্টিক। ৫ জুলাই বার্সেলোনার সারিয়া স্টেডিয়ামেই ঘটল অঘটন। যে ইতালিকে গ্রুপ পর্বের বাইরে কল্পনা করতে রাজি ছিলেন না কেউ সেই ইতালিয়ানরাই দুর্ভেদ্য পাঁচিল তুলে ধরলেন জিকো-ফ্যালকাও-সক্রেটিসদের সামনে। ইতিহাসের সেরা দল নিয়েও সক্রেটিস ব্রাজিলকে পৌঁছাতে পারেননি কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে।
জিকো-সক্রেটিস-ফ্যালকাও। ব্রাজিলের ফুটবল ভাণ্ডারের এই তিন মানিক রতন পেলে-যুগকে ভুলিয়ে দিয়েছিলেন ব্রাজিলিয়ানদের। এই ত্রয়ীর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য জিকো। ফুটবলের অবিসংবাদিত সম্রাট পেলে বলেছিলেন, আমার খুব কাছে কেবল জিকোই পৌঁছতে পেরেছে। তাকে নিয়ে আরও কত জন কত কথা বলেছেন। সমালোচকদের দৃষ্টিতে তিনি 'হোয়াইট' পেলে। কিন্তু দুর্ভাগ্য জিকোর। ইতিহাসের সেরা দল নিয়েও ব্রাজিলকে উপহার দিতে পারেননি বিশ্বকাপ। ১৯৮২ বিশ্বকাপে ব্রাজিল দলে কিসের অভাব ছিল! জিকো-ফ্যালকাও-সক্রেটিস তখন 'জোগো বোনিতো'র নতুন অধ্যায় রচনা করছেন। কিন্তু কে জানত জেলখানার চার দেওয়ালের ভিতর ইতালি বিশ্বকাপ জয়ের মারণাস্ত্র প্রস্তুত করছে! সেই অস্ত্রের নাম ছিল পাওলো রোসি। তার কাছেই মূলত ব্রাজিল হেরেছিল ১৯৮২ বিশ্বকাপে। তবে বিশ্বকাপ না জিতেও যে কজন ফুটবলার কিংবদন্তি তালিকায় স্থান পেয়েছেন, জিকো তাদের মধ্যে সবার উপরে।
তার ভূমিকা ছিল 'ফলস নম্বর নাইনে'র। কেবলমাত্র 'মিডফিল্ডার' কিংবা 'স্ট্রাইকার' শব্দের মধ্যে জিকোকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাকে খুঁজতে হবে ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি রোনাল্ডো এবং রোমারিও দুজনের মধ্যেই। মধ্যমাঠের প্রাণ ভোমরা এবং চমৎকার একজন 'ফিনিশার'। ব্রাজিলের জার্সি গায়ে ৭১ ম্যাচে ৪৮ গোলই (ব্রাজিলের হয়ে চতুর্থ সর্বোচ্চ) কি জিকোর পরিচয় তুলে ধরে না! মাত্র ১০ বছর জাতীয় দলে ফুটবল খেলেছেন তিনি। এতটা কম সময়ে সম্ভবত তার মতো ফুটবলারের পক্ষেই কেবল কিংবদন্তি হওয়া সম্ভব ছিল।
ফুটবল ছেড়ে জিকো দীর্ঘদিন নিরুপদ্রব জীবন কাটিয়েছেন। অবশেষে ১৯৯৯ সালে জাপানি ক্লাব কাশিমা অ্যান্টলারসে কোচের দায়িত্ব গ্রহণের মধ্যদিয়ে শুরু করেন নতুন জীবন। ২০০২-০৬ পর্যন্ত ছিলেন জাপান জাতীয় দলের কোচ। তার অধীনেই জাপান ২০০৬ বিশ্বকাপে অংশ নেয়। ২০০৪ সালে এশিয়ান চ্যাম্পিয়ন হয় সামুরাইরা। এরপর জিকো তুর্কি ক্লাব ফেনারবাখ, রুশ ক্লাব সিএসকেএ মস্কো, গ্রিক ক্লাব অলিম্পিয়াকসের কোচ ছিলেন। ইরাক জাতীয় দলের কোচ ছিলেন ২০১১-১২ পর্যন্ত। সর্বশেষ তিনি কাতারি ক্লাব আল ঘারাফায় কোচের দায়িত্ব পালন করেছেন।
জিকো পর্তুগিজ বংশোদ্ভূত ব্রাজিলিয়ান। তার দাদা ফার্নান্দো আন্তুস কয়েমব্রা ছিলেন পর্তুগিজ। বাবা হোসে আন্তুস কয়েমব্রা ১০ বছর বয়সে ব্রাজিলে আসেন। হোসে আন্তুস ও ফেরেরা দা সিলভার সংসারে ছয় সন্তানের কনিষ্ঠ হচ্ছেন জিকো। বড় ভাই ইদোর শ্যালিকা সান্দ্রা কারভালহো দা সাকে ১৯৭৫ সালে বিয়ে করেন জিকো। সান্দ্রার গর্ভেই জিকোর তিন ছেলে জন্ম নিয়েছে। আর্থার জুনিয়র, ব্রুনো এবং থিয়াগো। ৬১ বছর বয়সী ব্রাজিলিয়ান ফুটবল কিংবদন্তি জিকো বর্তমানে ছুটিতে আছেন। তবে ব্রাজিল বিশ্বকাপ নিয়ে সরব তিনি। বিশ্বকাপের আয়োজকদের নিয়ে লিখিত এক গানের কোরাসে কণ্ঠ দিয়েছেন জিকো।
হোয়াইট পেলে আর্থার আন্তুনেস কয়েমব্রা বিশ্বকাপ জিততে পারেননি। তবে ভক্তদের হৃদয় জয় করেছেন নিপুণ ফুটবলশিল্পী হিসেবে। ভক্তের হৃদয় রাজ্যের সিংহাসনে এখনো বসে রাজত্ব করছেন তিনি অনায়াসেই। ঝুলিতে বিশ্বকাপ না থাকলেও তাই তিনি ফুটবল কিংবদন্তি।