বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা কি পালাতে চাচ্ছেন? না, তাদের সামর্থ্যই এতটুকু? মিরপুরে ৩২৮ রানের পাহাড়সম ব্যবধানে হারের পর প্রশ্নগুলো একে একে বের হয়ে এসেছে ঝাঁপি খুলে। প্রশ্ন উঠেছে টেস্ট খেলতে যে পরিকল্পনা ও সামর্থ্য থাকা দরকার একটি দলের, সেটি কতটা রয়েছে মুশফিকবাহিনীর?
গত ডিসেম্বর থেকে স্বপ্নিল সময়ের মধ্যে হাঁটতে থাকা বাংলাদেশের জন্য একটি ক্ষত হয়ে রইল মিরপুর টেস্ট। গত পাঁচ মাসে জিম্বাবুয়েকে হোয়াইটওয়াশ, বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল খেলাসহ পাকিস্তানকে প্রথমবারের মতো ওয়ানডে সিরিজে বিধ্বস্ত করেছে টাইগাররা। তার উপর খুলনায় খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে যে দৃঢ়তায় ড্র করেছে, তাতে স্বপ্নের পথ দিগন্ত ছাড়িয়েছে। অথচ সেই পাকিস্তানের বিপক্ষে মাত্র সাড়ে তিনদিনে টেস্ট হেরে ফের চলে এসেছে পুরনো রাস্তায়। এ হার যেমন-তেমন নয়, রানের বিচারে নিজেদের ৯০ টেস্ট ইতিহাসে চতুর্থ বৃহত্তম লজ্জার হার। অবশ্য নিশ্চিত ইনিংস হারের লজ্জা থেকে মুশফিকবাহিনীকে বাঁচিয়ে দেয় মিসবাহ-উল হকের আশ্চর্য সিদ্ধান্ত(!)। ৩৫৪ রানে এগিয়ে ফলোঅনে পাঠানোর সুযোগ থাকার পরও ফায়দা নেননি পাকিস্তান অধিনায়ক। উল্টো বোলারদের বিশ্রাম দিয়ে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিং করে ১৯৫ রান তুলে ইনিংস ঘোষণা করেন। জয়ের জন্য মরিয়া পাকিস্তান টার্গেট দেয় ৫৫০ রানের। ১৩৮ বছরের ২১৬১ টেস্ট ইতিহাসে সাড়ে পাঁচশ রান করে ম্যাচ জেতার রেকর্ড নেই। তাই নির্ভার পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ বাঁচাতে নামে টাইগাররা। কিন্তু ব্যাটসম্যানদের ব্যাটিং, শটস সিলেকশন দেখে একবারের জন্যও মনে হয়নি, ম্যাচ বাঁচানোর কোনো পরিকল্পনা ছিল টাইগারদের। যদিও টাইগার অধিনায়ক মুশফিক ম্যাচ হেরে বলেন, 'আমাদের পরিকল্পনা ছিল প্রথম সেসনে ভালো ব্যাটিং করা এবং এক-দুটি জুটি গড়া। যাতে ম্যাচটি অন্যরকম হয়।' কিন্তু আদৌ কি পরিকল্পিত ক্রিকেট খেলেছে? যদি পরিকল্পনাই থাকত, তাহলে ২২.৪ ওভার থেকে ৩৭.৩ ওভার; ১৪.৫ ওভারের মধ্যে দলের সেরা চার বাটসম্যান তামিম, মাহমদুল্লাহ, সাকিব ও মুশফিক কিভাবে সাজঘরে ফিরেন? তাদের উইকেট বিলানো দেখেও প্রশ্ন উঠেছে সামর্থ্য নিয়ে। খুলনায় ২০৬ রানের দুর্দান্ত ইনিংস খেলা তামিমকে ছায়ায়ই মনে হয়েছে মিরপুরে। ৫৫০ রানের টার্গেটে তৃতীয় দিন পার করে চতুর্থদিন যে প্রত্যয়ের সঙ্গে ব্যাটিং করা উচিত, কাল সেই ধারায় ব্যাটিং করেছেন কি তামিম? কিংবা বিশ্বকাপে টানা দুই সেঞ্চুরি করে মহাবীর হয়ে যাওয়া মাহমুদুল্লাহ, বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব এবং অধিনায়ক মুশফিক? দলের চার স্তম্ভ যেভাবে আউট হয়েছেন, তাতে তাদের কমিটমেন্ট নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। ইমরান খানের অফ স্ট্যাম্পের বাইরের বলকে যেভাবে ফ্ল্যাশ খেলে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দেন তামিম, সেটা তার অতি আক্রমণাত্দক মানসিকতার কথা বলে। যা টেস্টের সঙ্গে যায় না। রানে ফিরতে লড়াই করতে থাকা মাহমুদুলস্নাহ হঠাৎ লাফিয়ে উঠা বলকে ব্যাকফুটে খেলে দ্বিতীয় স্লিপে আউট হন। সাকিবের ব্যাটিং দেখে বিস্ময়ে চোখ ছানাবড়া হয়েছে পাকিস্তানি কোচ ওয়াকার ইউনুসেরও। প্রথম ইনিংসে তিন তিনটি সুযোগ পেয়ে খেলেছিলেন ৮৯ রানের ইনিংস। কিন্তু কখনোই আস্থাশীল মনে হয়নি। কাল যেভাবে আউট হয়েছেন, তাতে মনে হচ্ছিল যেন কোনো কাজ রেখে এসেছেন সাজঘরে। নির্বিঘ্নে মোহাম্মদ হাফিজকে হঠাৎ তুুলে খেলতে যেয়ে মিডঅফে ওয়াহাব রিয়াজের তালুবন্দী হন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার। ১৩ রানে আউট হওয়া সাকিবের কাছ থেকে তখন দলের আশা ছিল বড় স্কোর। খুলনায় আঙুলে ব্যথা পাওয়ার পর হঠাৎই ছন্দ হারিয়ে ফেরেন দেশের সেরা ব্যাটসম্যান মুশফিক। দুই টেস্টের চার ইনিংসে তার স্কোর ৩২, ০, ১২, ০। অবিশ্বাস্য! চার স্তম্ভের উপর যখন পুরো দল তাকিয়ে, তখন তাদের ফিরে যাওয়া দেখে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের ভাবনা এখন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। ব্যাটসম্যানদের পরিকল্পিত ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশের দ্বিতীয় ইনিংস শেষ হয় ২২১ রানে। চরম ব্যর্থতার মধ্যেও উজ্জ্বল ছিলেন মুমিনুল হক। ৬৮ রানের ইনিংস খেলে টানা ১১ টেস্টে হাফসেঞ্চুরি বিরল রেকর্ড গড়েন এই বাঁ হাতি ব্যাটসম্যান। তার পাশে এখন স্যার ভিভি রিচার্ডসের মতো ক্রিকেটার। তার সামনে শুধু এবি ডি ভিলিয়ার্স। ব্যাটসম্যানদের এমন লাগাতার ব্যর্থতা যেমন ব্যক্তিবিশেষ। তেমনি মিরপুর টেস্টকে ঘিরে টিম ম্যানেজমেন্টের কি পরিকল্পনা ছিল, সেটা এখনো রহস্যময়। খুলনায় ব্যাটিং উইকেট বানিয়ে ড্র করার পর হঠাৎই মিরপুরে সবুজ ঘাস আচ্ছাদিত উইকেট বানানোর কারণ বুঝা গেল না। বানালোই যখন, তখন একাদশে পেসারদের আধিক্য থাকল না কেন? কিংবা শুভাগত হোমের মতো অলরাউন্ডারকে কেন আট নম্বরে বাটিং করতে হয়, এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর কি কোনোদিন আলোর মুখ দেখবে। মনে হয় না। লাল ফিতায় বাঁধা পড়ে দুলো পড়ে যাবে বিসিবির কোনো কক্ষে কিন্তু এটা কি ভালো হবে? পরিকল্পিত ক্রিকেট খেলতে না পারলেও আসন্ন ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজে কিন্তু ফের লজ্জায় সিক্ত হতে হবে।