বিশ্বকাপে উজ্জীবিত পারফরম্যান্সের পরও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সিরিজ নিয়ে সন্দেহ ছিল অনেকের মনেই। থাকাটাই ছিল স্বাভাবিক! কেননা ২০০৭ ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্বকাপে সুপার-এইটে ওঠার পরের সিরিজ থেকেই তো আগের 'দুর্বল' চেহেরায় পুনরাবর্তন ঘটেছিল টাইগারদের। কিন্তু এবার বাংলাদেশ যে এভাবে বদলে যাবে তা কি কারও কল্পনাতেও ছিল?
প্রতিপক্ষ হিসেবে পাকিস্তান এমনিতেই বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের কাছে ছিল 'মানসিক বাঁধা'! টাইগাররা সব দলের বিরুদ্ধে জয় পেলেও সেই ৯৯-র পর আর পাকিস্তানকে হারাতে পারেনি। কিন্তু এবার ঘরের মাঠে ওয়ানডে ও টি-২০তে পাকিস্তানকে বাংলাওয়াশ সেই মানসিক বাঁধাকে ঝেড়ে ফেলল বাংলাদেশ। টেস্ট সিরিজটা হাতছাড়া হলেও তা নিয়ে খুব বেশি চিন্তার কিছু নেই। প্রথম টেস্টে বাংলাদেশ ঠিকই তাদের সামর্থ্য বুঝিয়ে দিয়েছে। দ্বিতীয় টেস্টে হয়তো কিছুটা 'রিল্যাক্স মুড' আসার কারণেই হারতে হয়েছে। তবে ভারতের বিরুদ্ধে সিরিজের আগে এই টেস্ট থেকে অনেক কিছু শেখার আছে ক্রিকেটারদের। পেশাদার ক্রিকেটে মুহূর্তের জন্যও আত্দতুষ্টিতে ভোগার সুযোগ নেই।
ওয়ানডেতে বাংলাদেশ যে এখন ক্রিকেটের প্রতিষ্ঠিত শক্তি তা পাকিস্তান টের পেয়েছে হাড়ে হাড়ে। তিন ম্যাচের একটিতেও তারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলতে পারেনি। এই সিরিজের মাধ্যমে যেন বাংলাদেশের ওয়ানডে ক্রিকেটের ইতিহাসে নতুন এক অধ্যায় সংযোজিত হয়েছে। ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশের টপ অর্ডার নিয়ে দুশ্চিন্তা ছিল সব সময়ই। কিন্তু এই সিরিজে তা পুরোপুরি দূর হয়ে গেছে। টপ অর্ডার এতটাই চমৎকার ব্যাটিং করেছে যে, মিডল অর্ডার, লোয়ার অর্ডার ব্যাটসম্যানদের ২২ গজে যেতেই হয়নি। তাই তো রসিকতা করে বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান ওয়ানডে সিরিজ শেষে বলেছেন, 'র্যাঙ্কিংয়ে উন্নতি করব কীভাবে? ব্যাটিং করার সুযোগই তো পেলাম না!'
তামিম ইকবাল, সৌম্য সরকার ও মুশফিকুর রহিমই বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ে প্রধান কাজ করেছেন। ওয়ানডেতে তামিম টানা দুই সেঞ্চুরির সঙ্গে একটি হাফ সেঞ্চুরি করেছেন। তিন ম্যাচে ৩১২ রান করেছেন ড্যাসিং ওপেনার। আরেক ওপেনার সৌম্য সরকার একটি সেঞ্চুরিসহ করেছেন ১৬৪ রান। মুশফিকুর রহিমের সেঞ্চুরি না থাকলেও ওয়ানডে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক তিনি, করেছেন ২২০ রান। বোলিংয়ে ৬ উইকেট নিয়েছেন স্পিনার আরাফাত সানি, সাকিব ৫টি এবং চার উইকেট নিয়েছেন পেসার রুবেল হোসেন। অসাধারণ বোলিং করেছেন অন্য দুই পেসার মাশরাফি বিন মর্তুজা ও তাসকিন আহমেদও।
টাইগাররা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সিরিজের একমাত্র টি-২০ ম্যাচটা জিতেছে সাকিব-সাব্বিরের জোড়া হাফ সেঞ্চুরিতে। তবে টি-২০তে বিস্ময় ছিল নবাগত মুস্তাফিজুর রহমানের পেস আক্রমণ। বোলিংয়ে কী বৈচিত্র্য! ক্যারিয়ারের প্রথম খেলতে নেমেই তিনি ভড়কে দিয়েছেন পাকিস্তানের ব্যাটসম্যানদের। টি-২০ ক্যারিয়ারে প্রথম উইকেট হিসেবে আউট করেছেন শহীদ আফ্রিদিকে।
টেস্ট সিরিজ হাত ছাড়া হলেও প্রাপ্তির খাতা অনেক দীর্ঘ। সেখানেও নায়ক সেই তামিম। খুলনা টেস্টে ক্যারিয়ারের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি করেছেন তিনি। দ্বিতীয় ইনিংসে ২০৬ রান করায় তিনি এখন টেস্টে বাংলাদেশের টপ স্কোরার। তাছাড়া প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে টেস্টে টানা তৃতীয় ম্যাচে সেঞ্চুরি করার রেকর্ড গড়েছেন। টানা দ্বিতীয় সেঞ্চুরি পেয়েছেন ইমরুল কায়েসও। বিশেষ করে, খুলনা টেস্টে তামিমের সঙ্গে তার ৩১২ রানের ওপেনিং জুটিটা হয়ে থাকল বাংলাদেশের টেস্ট ইতিহাসে অনন্য মাইলফলক হয়ে। ওই জুটির কারণে হারতে বসা টেস্টেও জয়ের সমান এক ড্র করতে পেরেছিল টাইগাররা। মুমিনুল হকের অর্জনটা বিশাল। বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল টেস্ট ব্যাটসম্যান। শেষ ম্যাচে ব্যাটিং ব্যর্থতার জন্য বাংলাদেশ হারলেও 'প্রিন্স অব কক্সবাজার' ঠিকই হাফ সেঞ্চুরি করে নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। ঢাকায় মুমিনুলের হাফ সেঞ্চুরিটি ছিল টানা ১১তম ম্যাচে পঞ্চাশোর্ধ্ব রানের ইনিংস। এই রেকর্ড গড়ে ৫ ফুট ৩ ইঞ্চি উচ্চতার ছোট্ট মুমিনুল ছাড়িয়ে গেছেন ক্রিকেট ঈশ্বর শচীন টেন্ডুলকারকেও। তবে টেস্টে বাংলাদেশের বোলিং লাইন ছিল হতাশার। তারপরেও আশার আলো ছিল তাইজুলের স্পিনে। দুই টেস্টে ১০ উইকেট নিয়েছেন তিনি। তরুণ পেসার মোহাম্মদ শহীদও দারুণ বোলিং করেছেন। শেষ টেস্টের কথা বাদ দিলে চোখে পড়বে শুধু প্রাপ্তি আর প্রাপ্তি। তবে শেষ ম্যাচে পরাজয়ের ফলে ক্রিকেটাররা বেশ শকট্ হয়েছেন। মহাপ্রাপ্তির সিরিজটা বাজেভাবে শেষ হওয়ায় ক্রিকেটার মনে যেন আগুন জ্বলছে। আর মনের এই আগুনটা লাভার মতো বুদ বুদ করতে থাক আরও এক মাস। তাহলে আগামী জুনে ভারতের বিরুদ্ধে ঠিকই অগ্নিগিরি দেখা যাবে!