ঘড়িতে কাঁটায় কাঁটায় চারটা বাজে। কুর্মিটোলা গলফ কোর্সে বিকালেই ঘনিয়ে এসেছিল ঘোর অন্ধকার! মেঘে ঢাকা আকাশ, দর্শক-কর্মকর্তা-সাংবাদিকদের মুখেও হাসি নেই। ফ্রন্ট-নাইনের নয় নং হোলে পাটিং করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন সিদ্দিকুর রহমান। পাশেই কয়েকশ দর্শকের ভিড়ে নির্বাক দৃষ্টি স্বামীর দিকে তাকিয়ে সিদ্দিকুরের সহধর্মিণী সামাউন আঞ্জুম অরনি। দর্শকরাও ভীষণ টেনশনে। সিদ্দিকুর রহমান পাটিং করে বল সরাসরি হোলে ফেলে দিয়ে 'বার্ডি' আদায় করে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই উচ্ছ্বাস! মুক্তির আনন্দ চারিদিকে। নয় নম্বর হোলে পাওয়া এই 'বার্ডি'র কল্যাণেই 'কাট' পেয়ে গেলেন সিদ্দিকুর রহমান। অর্থাৎ দেশসেরা গলফারের তৃতীয় রাউন্ডে খেলা নিশ্চিত হয়ে গেছে।
সিদ্দিকুরের সঙ্গে বসুন্ধরা বাংলাদেশ ওপেনের শীর্ষ ৬৫-তে জায়গা পেয়েছেন দেশের আরও পাঁচ গলফার। তা হলেন-দুলাল হোসেন, সজীব আলী, নুর জামাল, সাখাওয়াত হোসেন সোহেল ও দিল মোহাম্মদ।
বসুন্ধরা বাংলাদেশ ওপেনে দ্বিতীয় রাউন্ডের সেরা তারকা বাংলাদেশের দুলাল হোসেন। সিঙ্গাপুরের গলফার মারদান মামত দুই দিন মিলে পারের চেয়ে মোট নয় শট কম খেললেও শুধুমাত্র দ্বিতীয় রাউন্ডেই পারের চেয়ে ৮ শট কম খেলে বাজিমাৎ করেছেন দুলাল হোসেন। আগের দিন পারের চেয়ে দুই শট বেশি খেলায় দ্বিতীয় দিন শেষে দুলাল পারের চেয়ে মোট ছয় শট কম খেলে লিডার বোর্ডের পঞ্চম স্থানে তিনি।
এশিয়ান ট্যুরের মতো এমন টুর্নামেন্টে একদিনে পারের চেয়ে আট শট কম খেলায় দুলালের স্বপ্নটা আরও চওড়া হয়ে গেছে। এখন শিরোপার স্বপ্ন দেখছেন বাংলাদেশের এই গলফার। তিনি বলেন, 'আমার বিশ্বাস এভাবে পরের দুই দিন খেলতে পারলে আশা করছি চ্যাম্পিয়ন হতে পারব।'
গতকাল একটুর জন্য বেঁচে গেছেন সিদ্দিকুর রহমান। আগের দিনের মতো গতকালও পারের চেয়ে এক শট বেশি খেলেছেন তিনি। দুই দিন মিলে পারের চেয়ে দুই শট বেশি খেলে যৌথভাবে ৪২তম স্থানে সিদ্দিকুর। তবে এখনো শিরোপার আশা করছেন তিনি। যদিও শীর্ষে থাকা মারদান মামতের সঙ্গে তার ব্যবধান এখন ১১ পারের। সিদ্দিকুর বলেন, 'এই কোর্সে আমার এক রাউন্ডে ১০ শট পর্যন্ত কম খেলার রেকর্ড আছে। তাই এখনো আশা ছাড়ছি না।'
ঘরের কোর্সে বাজে খেলা প্রসঙ্গে সিদ্দিকুর বলেন, 'কখনো রোদ হচ্ছে, কখনো বাতাস, আবার বৃষ্টি। এমন বাজে আবহাওয়ার মধ্যে আগে কখনো খেলতে হয়নি। তাই বুঝতে পারছিলাম। তাছাড়া পাটিং গ্রিনে আমি খারাপ করেছি। আমার ধারণা ছিল না, আমাদের দেশের পাটিং গ্রিন এতো ভালো হবে। অন্য সময় যেমন দেখেছি তার চেয়ে অনেক ভালো। এমন সাধারণত দেশের বাইরের গলফ কোর্সে দেখা যায়। তাই প্রথম দুই দিন মানিয়ে নিতে পারিনি। এখন আমি বুঝে গেছি। আশা করি পরের দুই রাউন্ডে ভালো হবে।'
বসুন্ধরা গ্রুপের পৃষ্ঠপোষকতায় দেশের প্রথমবারের মতো হচ্ছে গলফের মহা আয়োজন। এমন টুর্নামেন্টে যদি দ্বিতীয় রাউন্ডেই দেশের সেরা তারকা বাদ পড়ে যেতেন সেক্ষেত্রে টুর্নামেন্টটাই যেন রঙ হারিয়ে ফেলত। তাই শেষ পর্যন্ত সিদ্দিকুর রহমান 'কাট' পাওয়ায় যেন আয়োজকরাও হাফ ছেড়ে বেঁচেছেন।
সিদ্দিকুরের প্রতি দর্শকের আগ্রহটা যে কত বেশি তা বোঝা গেল 'বার্ডি' পাওয়ার পর উচ্ছ্বাস দেখে। গলফ কোর্সে সাধারণত চুপচাপ থাকাই নিয়ম। কিন্তু কাল দেখা গেল নিজের দায়িত্ব ভুলে স্বেচ্ছাসেবকরাও সিদ্দিকুরের বার্ডিতে চিৎকার করে ওঠেন। তবে দর্শকের এই ভালোবাসাটাই ঘরের কোর্সে সিদ্দিকুরের জন্য চাপ কিনা? যদিও তিনি এটা মানতে নারাজ, 'আমি দর্শক উচ্ছ্বাসকে চাপ হিসেবে দেখি না। বরং আমার অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে।'
একজন গলফারকে দিনে ১৮ হোল খেলতে হয়! সাড়ে ছয় গজের কোর্সে আনাচে-কানাচে ঘুরতে হয়। চার ঘণ্টা টানা হাঁটাহাঁটি করতে হয়। কাল দেখা গেল সিদ্দিকুরের সঙ্গে তার সহধর্মিণী অরনিও হাঁটছেন। সারা দিন তিনি সিদ্দিকুরের সঙ্গে সঙ্গে ছিলেন। তবে তাকে হাঁটতে হয়ে সিদ্দিকুরের চেয়েও বেশি। কেননা গলফাররা ফেয়ারওয়ের ভিতর দিয়ে হাঁটতে পারেন, কিন্তু দর্শকরা তা পারেন না। তাকে ঘুরে ঘুরে ওয়াকওয়ে দিয়ে যেতে হয়। তাই সিদ্দিকুরের চেয়েও অরনিকে হাঁটতে হয়েছে অনেক বেশি। তবে এতেও তার কোনো ক্লান্তি নেই। বরং স্বামীকে উৎসাহ দিতে পেরে অনেক খুশি তিনি। আর এমন অনুপ্রেরণা দায়ী স্ত্রী যার সঙ্গে থাকেন তার ভালো না করে উপায় আছে। হয়তো আজই ঘুরে দাঁড়াবেন সিদ্দিকুর! আর সে আশাতেই প্রতীক্ষায় দেশবাসী।