করোনা সংক্রমণ থেকে মুক্তি পেলেও আক্রান্তদের শরীরে বাসা বাঁধছে নতুন রোগ। অনেক রোগীর ফুসফুস মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, অনেকের ফুসফুসে পানি জমেছে। অনেকে করোনার থাবা থেকে পেয়েছেন উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, চর্মরোগ, মাংসপেশিতে তীব্র ব্যথার মতো নতুন যন্ত্রণা। অনিদ্রা, স্মৃতিভ্রংশ, দুর্বলতা, মানসিক অবসাদ ডেকে আনছে করোনা।
এসব সমস্যা কাটাতে চিকিৎসকের পরামর্শের পাশাপাশি পুষ্টিকর খাবার, ব্যায়াম, মেডিটেশন এবং নিয়মমাফিক জীবনযাপনে জোর দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। পোস্ট কভিড জটিলতায় ভুক্তভোগী রোগীদের সেবা দিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে খোলা হয়েছে পোস্ট কভিড ক্লিনিক। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন সারা দেশে তাদের শত শত সেল, প্রি-সেল, শাখা, সেন্টারে পোস্ট কভিড ট্রমা ম্যানেজমেন্টের ওপর সেমিনার, মেডিটেশন ও ইয়োগাচর্চার আয়োজন শুরু করেছে।
বিএসএমএমইউ উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘করোনা নেগেটিভ আসার পরে অধিকাংশ রোগী বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছেন। হৃদরোগ, মনোরোগসহ নানা সমস্যায় ভুগছে মানুষ। অনেকের ক্ষেত্রে করোনা পরবর্তী জটিলতা প্রকট আকার ধারণ করছে। তাদের সেবা দিতে আমরা পোস্ট করোনা ক্লিনিক চালু করেছি। সমস্যা অনুযায়ী রোগীরা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে পারেন। সপ্তাহে রবি, মঙ্গল, বৃহস্পতিবার এই ক্লিনিক চালু থাকে।’ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও এই তিন দিন সেবা নেওয়া যাবে।
করোনা আক্রান্ত হয়েছিলেন ব্যাংকার খাইরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আমি এবং আমার স্ত্রী করোনা আক্রান্ত হয়েছিলাম। করোনা নেগেটিভ আসার পর থেকে আমরা ভীষণ দুর্বল বোধ করছি। আমার প্রায়ই ঘনঘন পেটে সমস্যা হচ্ছে। রাত তিনটা-চারটা বাজলেও ঘুম আসে না। তিন মাস ধরে অনিন্দ্রা নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠেছে। আমার স্ত্রীর শরীর অ্যালার্জিতে ভরে গেছে। শরীর জুড়ে লাল ফোসকা উঠেছে। টানা ওষুধ চললেও কাজ হচ্ছে না। ইনজেকশনও দিতে হয়েছে। চিকিৎসক এটাকে পোস্ট কভিড সিনড্রম বলছেন।’
বিভিন্ন সমীক্ষা বলছে, জটিল কভিড রোগীদের বিপদ বেশি। এর মূলে কিছুটা হাত আছে ভাইরাসের, কিছুটা প্রাণান্তকর চিকিৎসার। ফলে মুড সুইং, চিন্তার অসঙ্গতি থেকে যায় অনেকের। কারও হয় অবসাদ। রোগ যত জটিল হয়, পাল্লা দিয়ে বাড়ে বিপদ। করোনা নিয়ে অসংখ্য মানুষ আতঙ্কিত। আতঙ্কের ধকল সামলানোর ক্ষমতা সবার সমান থাকে না। সেজন্যই দেখা যায়, উদ্বেগপ্রবণ মানুষের সমস্যা বেশি। এই সমস্যা মুক্তিতে মেডিটেশন নিরাময়ের বড় হাতিয়ার হতে পারে।
প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও ইউজিসি অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, করোনা পরবর্তী রোগীদের শরীরে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা যাচ্ছে। হাসপাতালে ভর্তি অবস্থায় যাদের বেশি অক্সিজেনের প্রয়োজন পড়ে, আইসিইউতে যেতে হয়, তারা সুস্থ হওয়ার পর এ ধরনের সমস্যা বেশি হয়। আগে না থাকলেও করোনা পরবর্তীতে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস দেখা দিয়েছে এমন রোগী পেয়েছি আমরা। করোনা পরবর্তীতে দুর্বলতা কিংবা অন্য সমস্যা দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ মতো খাবার ও ওষুধ সেবন করতে হবে।’ চিকিৎসকরা বলছেন, করোনা নেগেটিভ হওয়ার পর মাঝেমধ্যে অনেকের শ্বাসকষ্ট হতে পারে। সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা বা সামান্য পরিশ্রমে হাঁপিয়ে উঠতে পারেন। বিশেষ করে, যারা নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ) থেকেছেন, তাদের শ্বাসক্রিয়া স্বাভাবিক হতে বেশ সময় লেগে যাচ্ছে। করোনা সেরে যাওয়ার পরও কয়েক সপ্তাহ কাশি থাকতে পারে। অবসাদ আর ক্লান্তি থেকে যায় দীর্ঘদিন। হাসপাতালের বিছানায় দীর্ঘদিন শুয়ে থাকার কারণে দেহের পেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, পেশি দুর্বল হয়ে পড়ে। খাবারে অরুচিও থেকে যায় বেশ কিছুদিন। এমনকি খাবার গিলতে, চিবুতে সমস্যা হতে পারে। যারা আইসিইউতে ছিলেন বা গলায় টিউব দেওয়া হয়েছিল, তাদের এই সমস্যা বেশি হয়। করোনাভাইরাস সংক্রমণের পর অনেক রোগী মানসিক বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। মনোযোগ ও চিন্তাশক্তির সমস্যা, স্মৃতি হারানো, বিষণ্ণতার মতো সমস্যা হতে পারে। মেডিটেশনে এসব সমস্যার মুক্তি মিলবে বলে জানিয়েছেন স্নায়ু বিজ্ঞান গবেষক অধ্যাপক ডা. স্টিভেন লরিস। গত ৩ এপ্রিল যুক্তরাজ্যভিত্তিক বিজ্ঞান সাময়িকী নিউ সায়েন্টিস্টকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ব্রেনকে রি-টিউন করার পাশাপাশি মহামারীর সুদূরপ্রসারী ও ক্ষতিকর নানা প্রভাব থেকে আমাদের মুক্তি দিতে মেডিটেশন চর্চা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রোগ নিরাময়, অস্থিরতা ও স্ট্রেসমুক্তি, শিশু মনের বিকাশসহ নানা ক্ষেত্রে মেডিটেশন কার্যকরী। দুশ্চিন্তা-উদ্বিগ্নতা আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দুর্বল করে দেয়। তাই দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত থাকতে মেডিটেশন একটি অসাধারণ প্রক্রিয়া। বর্তমানের চিন্তা ও আবেগগুলোর প্রতি দৃষ্টি দিলে হার্ট রেট কমতে থাকে। এতে ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণে আসে এবং স্ট্রেস হরমোন কর্টিসল হ্রাস পায়। এই বিষয়গুলো পোস্ট কভিড ট্রমা মোকাবিলায় ভীষণ সহযোগিতা করে।