মঙ্গলবার, ২৮ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

ঘুমের কষ্টে নগরের মানুষ

জয়শ্রী ভাদুড়ী

ঘুমের কষ্টে নগরের মানুষ

প্রযুক্তির ব্যবহার, দুশ্চিন্তা, শব্দদূষণসহ নানা কারণে মারাত্মক ঘুমের সমস্যায় ভুগছেন নগরের মানুষ। পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়ায় শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন অনেকেই -- ছবি : জয়ীতা রায়

রাজধানীতে রাইড শেয়ারিং অ্যাপসে মোটরসাইকেল চালিয়ে জীবিকানির্বাহ করেন সোলাইমান হোসেন। গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর মহাখালী আমতলী কাঁচাবাজারের এক কোনায় মোটরসাইকেলে বসে পাশের ভবনের দেওয়ালে হেলান দিয়ে ঝিমোচ্ছিলেন তিনি। ভরদুপুরে তার বসে থেকে ঘুমানো নিয়ে ঠাট্টা করছিলেন অন্য চালকরা। তাদের ঠাট্টায় বোঝা যায় তারা পরিচিত। এগিয়ে গিয়ে অসময়ে ঘুমের কারণ জানতে চাইলে চোখ-মুখে পানির ছিটা দিতে দিতে বলেন, পেটের দায়ে মাঝরাতে কখনো কাকডাকা ভোরে মোটরসাইকেল নিয়ে বের হই। পর্যাপ্ত ঘুমানোর সময় পাই না, অনেক সময় শুলেও ঘুম আসতে চায় না। করোনার সময় চাকরি খুইয়ে, অসুস্থ হয়ে ধারদেনা হয়েছে অনেক। সেগুলো শোধের চিন্তায় ঘুম আসে না। কখনো মোটরসাইকেল চালাতে গিয়েও ঘুম চলে আসে। কিছুদিন আগে মহাখালী ফ্লাইওভারের ওপরে দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে গেছি।’

রাজধানীসহ সারা দেশে ঘুমের সমস্যায় ভোগা মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। প্রযুক্তির ব্যবহার, দুশ্চিন্তা, শব্দ দূষণসহ নানা কারণে মারাত্মক ঘুমের সমস্যায় ভুগছে মানুষ। পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়ায় শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে।

এ ব্যাপারে ইমেরিটাস অধ্যাপক ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, ‘ঘুম মানুষের প্রয়োজনীয় শারীরতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। পরিমিত ঘুম সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করে। হৃদরোগসহ নানা রোগের ঝুঁকিও কমায়। প্রতিদিন পূর্ণবয়স্ক মানুষের কমপক্ষে সাত/আট ঘণ্টা ঘুমানো দরকার। নির্দিষ্ট এই ঘুম হলে প্রতিদিন সকালে আমরা সুস্থ অনুভূতি দিয়ে দিন শুরু করতে পারি। অনিদ্রার কারণে বিভিন্ন শারীরিক-মানসিক সমস্যা দেখা দেয়।’

নিদ্রাহীনতার ফলে স্বাস্থ্যহানির হুমকিতে আছে বিশ্বের জনসংখ্যার ৭৭ শতাংশ মানুষ। ব্যস্ত নাগরিক জীবনে ঘুমানোর সময় এবং পরিবেশ মিলছে না মানুষের। ফলে কাজে মন বসাতে পারছে না কর্মজীবী মানুষ। অসময়ে ঝিমিয়ে পড়ছে। দীর্ঘদিন পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়ায় মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে।  চিকিৎসকরা বলেন, শরীর সুস্থ রাখতে কমপক্ষে আট থেকে ১০ ঘণ্টা ঘুমের প্রয়োজন। শিশুদের বেশি সময় ঘুমের প্রয়োজন। ১৮ থেকে ৬৪ বছর বয়সী মানুষের রাতে সাত থেকে নয় ঘণ্টা ঘুমানো প্রয়োজন। অনেকেই এর চেয়ে কম ঘুমিয়েও সুস্থ থাকতে পারেন।

অ্যাসোসিয়েশন অব সার্জনস ফর স্লিপ অ্যাপনিয়া বাংলাদেশ-এর মহাসচিব অধ্যাপক ডা মনিলাল আইচ লিটু বলেন, ঘুম কম হলে মস্তিষ্কে ‘বিটা অ্যামিলয়েড’ নামের ক্ষতিকর প্রোটিন তৈরি হয়। অ্যালঝাইমার রোগের সঙ্গে এই প্রোটিনটির সম্পর্ক রয়েছে। আমরা যখন ঘুমাই, তখন আমাদের শরীর মস্তিষ্ক থেকে বিটা অ্যামিলয়েড ও এ রকম অন্যান্য ক্ষতিকর পদার্থ অপসারণ করে থাকে।

যেসব পুরুষ রাতে মাত্র পাঁচ বা ছয় ঘণ্টা ঘুমান, তাদের শরীরে টেস্টোস্টেরন হরমোনের মাত্রা কমে দাঁড়ায় তাদের চেয়ে প্রায় ১০ বছর বেশি বয়সীদের সমান। মাত্র এক রাত চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা ঘুমালে শরীরের ক্যান্সারপ্রতিরোধী কোষগুলোর ৭০ শতাংশ মরে যায়। এভাবেই কম ঘুম তৈরি করে অন্ত্রের ক্যান্সার, প্রোস্টেটের ক্যান্সার ও স্তন ক্যান্সারের মতো নানা ধরনের ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি। তিনি আরও বলেন, ঘুমের স্বল্পতা স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাকের শঙ্কা অনেক গুণ বাড়িয়ে দেয়। কম ঘুম ওজন বাড়ায়। যারা ডিপ্রেশনে ভুগছেন তাদের অনেকেই দেখা গেছে পর্যাপ্ত ঘুম হয় না। ঘুম স্মৃতিশক্তি ও মনোযোগ বাড়ায়। তাই দিনের বেলা না ঘুমিয়ে রাতে নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমানোর রুটিন তৈরি করুন।’

চিকিৎসকরা বলছেন, পরিমিত ঘুমের জন্য রাতে ঘুমানোর দুই ঘণ্টা আগে থেকে মোবাইল কিংবা টেলিভিশন দেখা বন্ধ রাখতে হবে। ঘুমানোর আগে চা কিংবা কফি পান করলে এতে থাকা ক্যাফেইন ঘুম কমাতে কাজ করে। ঘুমানোর আগে হালকা কুসুম গরম পানি দিয়ে গোসল করলে ভালো ঘুম হয়। হালকা ব্যায়াম অথবা ইয়োগাও ঘুমের ক্ষেত্রে খুব কার্যকর। ঘুমানোর আগে বিছানা গুছিয়ে নেওয়া ও পর্যাপ্ত বাতাস আর চারপাশ অন্ধকার আছে কি না- এ বিষয়ের ওপরও নজর রাখা আবশ্যক। ভালো ঘুমের ক্ষেত্রে ঘুমানোর আগে বই পড়ার অভ্যাসও ঘুম আসার ক্ষেত্রে খুব কার্যকর।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর