বৃহস্পতিবার, ৩০ জুলাই, ২০১৫ ০০:০০ টা

দিনাজপুর নাগ দরজার রাজবাড়ীর ভগ্নদশা

দিনাজপুর নাগ দরজার রাজবাড়ীর ভগ্নদশা

এক সময় ছিল তখন পায়ে জুতা, মাথায় ছাতা এমনকি গায়ে জামা-কাপড় পরে সজ্জিত হয়ে কোনো প্রজার পক্ষে রাজবাড়ী ও গেটের সামনের পথ অতিক্রম করার মতো ধৃষ্টতা ছিল শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কেউ এ অপরাধ করলে তার প্রাপ্য ছিল পাইক পিয়াদার হাতে জুতাপেটা বা লাঠি গুঁতার পুরস্কার। এ ধরনের অনেক কথাই শোনা যায়। এটি মোগল আমলের মধ্যযুগীয় স্থাপত্য শিল্পের এক অনন্য নিদর্শন। হিন্দু-মুসলিম ও ইংরেজ এ তিন যুগের স্থাপত্য বৈশিষ্ট্যের বিচিত্র দৃষ্টি নন্দন এর সমাবেশ এ রাজবাড়ীটি। রাজবাড়ী বর্তমানে চরম ভগ্নদশায় নিপতিত। উপমহাদেশ বিভাগের পর রাজবংশ উচ্ছেদ হয়। এর ফলে পরিত্যক্ত হয় রাজবাড়ীও। রাজবাড়ী অনধিক ৪০০ বছরের পুরাতন এবং মূল বাড়িটি ৩০ বিঘা জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত। রাজবাড়ীর মূল ভবনগুলো সংস্কার আর অবহেলায় ভবনের লোহা-বিমসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র চুরি হচ্ছে প্রতিনিয়তই।

এ ব্যাপারে দিনাজপুর রাজ দেবোত্তর এস্টেটের ট্রাস্টি সদস্য ও প্রেসক্লাব সভাপতি চিত্ত ঘোষ জানান, রাজবাড়ীর মূল মন্দিরগুলোর সংস্কার কাজ ট্রাস্টের নিজস্ব তহবিল থেকে প্রায় ২৮ লাখ টাকার কাজ চলমান রয়েছে। মন্দিরের টায়ালস, টিন পরিবর্তনসহ বিভিন্ন সংস্কার কাজ চলমান রয়েছে। তিনি অভিযোগ করে বলেন, রাজবাড়ীর মূল ভবনসহ বিভিন্ন ভবনগুলো লোহা-বিমসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র চুরি হওয়ায় আজ ধংসস্তূপে পরিণত। মূল রাজবাড়ীতে একটি এতিম খানা ও বিদ্যাশ্রম গড়ে তোলা হয়েছে। অবৈধভাবে এতিমখানাটি গড়ে তোলা হয়েছে যা দেশের পুরাকীর্তি সংরক্ষণ আইনের পরিপন্থী। সরকারিভাবে পুরো রাজবাড়ীটি এখনো সেভাবে সংরক্ষণ করা হয়নি। এটা করা হলে পর্যটকদের আরও বেশি আকৃষ্ট করবে। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, রাজবাড়ীর প্রধান দরজাটির নাম নাগ দরজা। এটি কৃষ্ণ পাথরে নির্মিত। দরজাটির চৌকাঠের উচ্চতা ছিল ৭ ফুট। এ উপমহাদেশে আর কোথাও সর্প মূর্তি দিয়ে এ ধরনের অদ্ভুত ভাস্ককর্যময় দরজা আছে বলে জানা যায়নি। বর্তমানে এটি ঢাকা জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। চারদিক থেকে সুউচ্চ প্রাচীর ঘেরা রাজবাড়ীর অনেক প্রবেশদ্বার। এরমধ্যে ধর্মাদেউড়ী, সিংহ দেউড়ী, বেলতলীর দেউড়ী (নাট মন্দিরে যাওয়ার দ্বার), ঠাকুরবাড়ীর দেউড়ী, হাতিশালার দেউড়ী, হীরাবাগ দেউড়ী অন্যতম। রাজবাড়ীর প্রধানত দুটি অংশ- আয়নামহল ও রানীমহল। এ ছাড়াও আছে ঠাকুরবাড়ী ও হীরাবাগ এলাকা। আয়নামহল দ্বিতল ভবন। এই ভবনের দোতলায় রাজদরবার, জলসাঘর, মিছিলঘর, অতিথি ভবন, সভাকক্ষ ও নিচতলায় রাজকীয় পাঠাগার, কোষাগার ইত্যাদি। রাজা প্রাণনাথ ও রাজা রামনাথের আমলে আয়নামহল নির্মিত হয়। এই মহলের অধিকাংশ কক্ষ ভেঙে পড়েছে। রানীমহলের চারদিকের ভগ্নমান প্রাচীরগুলো জরাজীর্ণ কিছু অস্তিত্ব ছাড়া সাবেক ভবন আর নেই। ত্রিশের দশকে তা ভেঙে ওই স্থানের ওপর আধুনিক ডিজাইনের দ্বিতল রানীভবন নির্মিত হয়। মূল প্রাসাদসহ বৃহত্তর রাজবাড়ীর প্রায় ১০ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত।

মূল বাড়ি থেকে একটি বিশেষ দূরত্বে গভীর পরিখার দ্বারা বেষ্টিত আউটার রাজবাড়ী এলাকার আয়তন ছিল ৩০০ বিঘার মধ্যে। এই অংশে ম্যানেজার ভবনসহ উচ্চ পদস্থ আমলা কর্মচারীদের বাড়ি, রাজ অতিথি ভবন, পোস্ট অফিস, দাতব্য চিকিৎসালয়, আখড়া প্রভৃতি ছাড়াও কামার, ডোম, মেথরসহ পাইক-পিয়াদা, কোচোয়ান, দারোয়ান প্রমুখদের কলোনি ছিল। এরপরেও ছিল রাজকীয় ফুলবাগান, সবজি বাগান এবং পদ্ম সাগর, শুকসাগর, আনন্দসাগর, মাতাসাগর ও রামসাগর জাতীয় বৃহৎ দিঘি। এই রাজবাড়ীতে ১১ জনের মতো রাজা রাজত্ব করেন। শুকদেব, রামদেব, জয়দেব, প্রাণনাথ, রামনাথ, বৈদ্যনাথ, রাধানাথ, গোবিন্দনাথ, তারকানাথ, গিরিজিনাথ ও জগদীশনাথ। শেষ জগদীশনাথের এক ছেলে ছিল জলধিনাথ। প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে ১৯৪১ সালে জলধিনাথ প্রাণ হারান। রাজগদিতে উপবেশন না করলেও এই রাজকুমারই ছিল রাজবংশের শেষ উত্তরাধিকারী। বর্তমানে রাজবাড়ীর ভিতরে রাজার আমল থেকেই কান্তজিই মন্দিরে পূজা পার্বণ চলে আসছে এবং আরেকটি অংশে এখন নিয়মিত দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। সংস্কার অভাবে ভগ্নদশা এবং রাজবাড়ীর এলাকায় বসতবাড়ি গড়ে উঠায় সংকুচিত হয়ে আসছে এর পরিধি যা একদিন রাজবাড়িটি শুধু ইতিহাসেই থাকবে। য় মোঃ রিয়াজুল ইসলাম, দিনাজপুর প্রতিনিধি

 

সর্বশেষ খবর