মাত্র এক বছর আগেও জোহরান মামদানি ছিলেন রাজনীতিতে একজন অপরিচিত মুখ। আর এখন এটা নিশ্চিত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম শহরটি তার প্রথম মুসলিম এবং দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত মেয়র পেয়েছে। যার প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে পুরো যুক্তরাষ্ট্রে, এমনকি বিশ্বজুড়ে। দক্ষিণ আফ্রিকা ও নিউইয়র্কের মধ্যে বেড়ে ওঠা ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী নতুন মেয়রকে নিয়ে আমাদের আজকের রকমারি...
জোহরান মামদানির জীবনের শুরুটা কোনো সরলরৈখিক পথে হয়নি; বরং তাঁর মধ্যে বিভিন্ন সংস্কৃতির একটি জটিল ও স্তরযুক্ত সংমিশ্রণ ঘটেছে। উগান্ডার কাম্পালায় জন্ম, বেড়ে ওঠা দক্ষিণ আফ্রিকা এবং নিউইয়র্কের কুইন্সের এমন পাড়া-মহল্লায় যেখানে বাড়ির ভাড়ার বিলই মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করে- এই বহুমুখী অভিজ্ঞতা তাঁকে একজন সাধারণ রাজনীতিবিদের চেয়ে ভিন্ন মাত্রার পরিচিতি দিয়েছে। তাঁর যাত্রা ভাড়াটিয়াদের পরামর্শ দেওয়া থেকে শুরু করে নিউইয়র্কের প্রথম মুসলিম এবং দক্ষিণ এশীয় মেয়র পদে আসীন হওয়া পর্যন্ত গড়িয়েছে, যা বৈশ্বিক মহানগরীর নেতৃত্বে অভিবাসী চেতনার জয়কে নিশ্চিত করে।
রাজনৈতিক উত্থান
কুইন্স এবং তৃণমূলের শিক্ষানবিশ
নিউইয়র্কে এসে সাশ্রয়ী আবাসন সংকট যখন চরম আকার ধারণ করে, তখন মামদানি সরাসরি সেই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা বেছে নেন। ভাড়াটিয়াদের পরামর্শ দেওয়া ছিল এক নিরলস কাজ, যেখানে প্রতিটি মামলা শহরের বাস্তবতার সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত রাজনীতির ব্যবধান স্পষ্ট করত। মামদানি দ্রুতই বুঝতে পারেন, আবাসন কেবল একটি সমস্যা নয়, এটি স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, যাতায়াত এবং সামাজিক বন্ধনের ভিত্তি। এই উপলব্ধিই তাঁকে পরামর্শদাতার কাজ থেকে সংগঠকের ভূমিকায় নিয়ে আসে। তিনি স্থানীয় নির্বাচনে কাজ করেছেন, বাড়ি বাড়ি গিয়েছেন, আর গণতন্ত্রের সেই প্রক্রিয়াগুলো শিখেছেন যা কখনো টেলিভিশনে দেখা যায় না। গভীর রাতের ডি-ব্রিফিং এবং দরজার সিঁড়িতে ভোটারের প্রথম প্রশ্ন- ‘যখন পরিস্থিতি খারাপ হবে তখন আপনি ফোন ধরবেন কি না?’ এই শিক্ষাই তাঁর রাজনীতিকে কঠোর ও বাস্তববাদী করে তোলে। এরপর তাঁর মনোযোগ আকর্ষণ করে পাবলিক ট্রানজিট অ্যাক্টিভিজম। তিনি দীর্ঘ বাসযাত্রা শ্রমজীবী মানুষের দিন থেকে যে সময় কেড়ে নেয়, তা উপলব্ধি করেন। নির্বাচিত রুটে ভাড়ামুক্ত পাইলট প্রকল্প এবং উন্নত ফ্রিকোয়েন্সির জন্য তাঁর চাপ বুঝিয়ে দেয়, পরিবহননীতি কেবল একটি বিশেষ বিষয় নয়; এটি মজুরি, জলবায়ু, জননিরাপত্তা ও ন্যায়বিচারের সমস্যা।
স্টেট অ্যাসেম্বলি এবং তরুণ রাজনীতির নতুন ধারা
২০২০ সাল নাগাদ মামদানি অ্যাস্টোরিয়ার একটি স্টেট অ্যাসেম্বলি আসনের জন্য দীর্ঘকাল ধরে প্রতিষ্ঠিত এক ক্ষমতাশীল ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তাঁর মূল বার্তা ছিল স্পষ্ট- সাশ্রয়ী আবাসন সংকট সাধারণ পরিবারগুলোকে আঘাত করছে, অথচ আইনসভা এই বাস্তবতা থেকে দূরে। তিনি ভাড়াটিয়াদের অধিকার, শক্তিশালী পাবলিক পণ্য এবং এমন একটি সরকারি পদ্ধতির প্রতিশ্রুতি দেন যা দাতা তালিকার পরিবর্তে সাধারণ মানুষের জীবন থেকে শুরু হয়। তিনি প্রাইমারি এবং সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হন এবং একজন সংগঠকের কার্যক্রম আলবেনিতে (স্টেট ক্যাপিটাল) নিয়ে আসেন। তাঁর বিল স্পনসর করা একটি বৃহত্তর কৌশলের অংশ ছিল, যা কমিউনিটি অর্গানাইজিংয়ের সঙ্গে আইন প্রণয়নকে যুক্ত করে। তাঁর এই উত্থান ছিল বজ্রগতির। তরুণ ভোটারদের সক্রিয়তা, তৃণমূলভিত্তিক প্রচারণা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হাস্যরসাত্মক কিন্তু মানবিক বার্তা তাঁকে এক নতুন রাজনৈতিক ধারার প্রতীক করে তোলে। তাঁর জনপ্রিয় স্লোগান- ‘জীবন এত কঠিন হতে হবে না’ দ্রুত ভাইরাল হয়। কখনো ‘হালালফ্লশেন’ শব্দের উদ্ভাবন, কখনো কনি আইল্যান্ডের ঠান্ডা ঢেউয়ে ঝাঁপ দেওয়ার অঙ্গীকার- এসব তাঁকে তরুণ প্রজন্মের রাজনীতির কেন্দ্রে নিয়ে আসে।
বিতর্ক, আদর্শবাদ এবং ভবিষ্যৎ পরীক্ষা
যখন সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু কুয়োমোর মতো রাজনীতিবিদরা ধনকুবের দাতাদের টাকায় প্রচারণা চালান, তার বিপরীতে তিনি ছিলেন সাধারণ মানুষের মাঝে, নিজের সমালোচকদের সঙ্গেও মুখোমুখি আলোচনায়। ফলে তিনি হয়ে ওঠেন ‘পুরনো রাজনীতি’র বিপরীতে এক তরুণ বিকল্প। তিনি সোশ্যাল মিডিয়ার নীতিভিত্তিক বার্তার মাধ্যমে তরুণ ভোটারদের রাজনীতিতে টেনে এনেছেন। তাঁর অঙ্গীকারগুলোর মধ্যে ছিল ভাড়ার লাগাম টানা, ন্যূনতম মজুরি বাড়িয়ে ৩০ ডলার করা, বিনামূল্যে বাসসেবা, পাব্লিক গ্রোসারি স্টোর এবং সার্বজনীন শিশু পরিচর্যা। পাশাপাশি তিনি ধনীদের ওপর কর বৃদ্ধি, করপোরেট ট্যাক্স বাড়ানো এবং সিটি মালিকানাধীন মুদি দোকানের প্রস্তাব দিয়েছেন। বর্ণবাদ ও ইসলামোফোবিয়ায় ভরা বিরোধী প্রচারণার মুখেও মামদানি উর্দু, হিন্দি ও স্প্যানিশ ভাষায় প্রচার চালিয়েছেন। গাজা ইস্যুতে তাঁর অবস্থান এবং অভিবাসীদের অধিকার রক্ষায় সোচ্চার ভূমিকা তাঁকে এক নতুন প্রজন্মের প্রেরণার প্রতীকে পরিণত করেছে। অন্যদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষ থেকে ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েনের হুমকি, ফেডারেল তহবিল বন্ধের আশঙ্কা- সব মিলিয়ে এই নির্বাচন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে এক ঐতিহাসিক মোড় তৈরি করেছে। ৯/১১-পরবর্তী প্রজন্মের এক তরুণ মুসলিম হিসেবে মামদানির এই উত্থান এমন এক সময়ে ঘটেছে, যখন শ্বেত জাতীয়তাবাদ আমেরিকায় মাথাচাড়া দিচ্ছে। তবুও তিনি দৃঢ় থেকেছেন নিজের মূল বার্তায়- ‘নিউইয়র্কের জীবনকে আরও সাশ্রয়ী ও ন্যায্য করতে হবে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকতে হবে।’
জোহরান মামদানির গল্প
নাম জোহরান কোয়ামে মামদানি (Zohran Kwame Mamdani)। তরুণ এই রাজনীতিকের বয়স ৩৪। মার্কিন যুক্তরাস্ট্রের নিউইয়র্কের সদ্য নির্বাচিত এই মেয়র ‘যেন এক বিশ্বনাগরিকতার প্রতিচ্ছবি’। ১৯৯১ সালের ১৮ অক্টোবর, উগান্ডার কাম্পালায় জন্ম নেওয়া জোহরান মামদানির জীবনের শিকড় বিস্তৃত তিন মহাদেশে- আফ্রিকা, এশিয়া ও উত্তর আমেরিকায়। বাবা মাহমুদ মামদানি পূর্ব আফ্রিকার একজন অধ্যাপক ও বিশিষ্ট চিন্তাবিদ, যিনি উপনিবেশবাদ, জাতিসত্তা ও নাগরিকত্ব নিয়ে নতুন তত্ত্ব নির্মাণ করেছেন। আর মা মীরা নায়ার, সেই খ্যাতিমান ভারতীয় চলচ্চিত্রনির্মাতা, যিনি সালাম বোম্বে! ও মনসুন ওয়েডিংয়ের মতো ছবিতে অভিবাসন ও পরিচয়ের গল্পকে বিশ্বদরবারে তুলে ধরেছেন। তবে তার বাবা-মা দুজনই হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র। একাডেমিক তত্ত্ব ও শিল্পচেতনার এই সংমিশ্রণেই বড় হয়েছেন জোহরান- যেখানে রাতের খাবারের টেবিলে আলোচনা হতো রাজনীতি, চরিত্র, আখ্যান ও সত্য নিয়ে। আর শৈশবে পরিবারের সঙ্গে নিউইয়র্কে পাড়ি দেন। ব্রঙ্কস হাইস্কুল অব সায়েন্স থেকে স্নাতক সম্মাননা নিয়ে- বোডিন কলেজে পড়েন আফ্রিকানা স্টাডিজে। কলেজে থাকাকালীন তাঁর সহজাত প্রবৃত্তি আরও তীক্ষè হয়ে ওঠে। সেখানেই তাঁর সামাজিক সচেতনতার প্রকাশ ঘটে- ‘স্টুডেন্টস ফর জাস্টিস ইন প্যালেস্টাইন’-এর ক্যাম্পাস চ্যাপ্টার গঠনে তিনি ছিলেন অন্যতম উদ্যোগী। তাঁর পরিচয়ের প্রশ্নটি সবসময়ই তাঁকে তাড়া করেছে। ভারতীয় বংশোদ্ভূত, আফ্রিকায় জন্ম, আর আমেরিকায় বেড়ে ওঠা- এই ত্রিমাত্রিক পরিচয়ই তাঁকে একদিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে, অন্যদিকে দিয়েছে এক অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদনকালে তিনি নিজের জাতিগত পরিচয় লিখেছিলেন- ‘এশীয়’ এবং ‘কৃষ্ণাঙ্গ বা আফ্রিকান আমেরিকান’। সমালোচনার মুখে তিনি ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, ‘ফর্মের সীমাবদ্ধ বাক্সগুলোর মধ্যে আমি আমার পটভূমির পূর্ণতা প্রকাশ করতে চেয়েছিলাম।’ রাজনীতিতে পা রাখার আগে তিনি ছিলেন এক আবাসন পরামর্শদাতা- কুইন্সের নিম্নআয়ের পরিবারগুলোর উচ্ছেদ ঠেকাতে লড়াই করতেন। এখান থেকেই তাঁর রাজনৈতিক দর্শনের সূচনা- বাস্তব জীবনের লড়াই থেকে উঠে আসা এক সমাজসেবী। যখন তিনি মেয়র পদে প্রার্থী হন, তাঁর প্রতিশ্রুতি ছিল সাধারণ অথচ নিরাপদ, সাশ্রয়ী ও মানবিক শহরের।
তাঁর উপস্থাপনাও ছিল ভিন্ন; তিনি উর্দু ভাষায় ভিডিও প্রকাশ করেন, নিয়মিত মসজিদে যান এবং খোলাখুলিভাবে বলেন, ‘একজন মুসলিম হিসেবে প্রকাশ্যে দাঁড়ানো মানে অনেক সময় ছায়ায় যে নিরাপত্তা পাই, তা ত্যাগ করা।’ শুধু তাই নয়, তিনি লেখালেখি, সংগঠন এবং বিতর্কেও সক্রিয় ছিলেন। প্রায়শই তিনি সেই মিলনস্থল খুঁজেছেন যেখানে তাত্ত্বিক জ্ঞানের সঙ্গে নাগরিক দায়িত্বের সংযোগ ঘটে। পাঠ্যবইয়ের বাইরে তাঁর আগ্রহ সংগীত ও সংস্কৃতিতে। তিনি হিপ হপ এবং উগান্ডার ও দক্ষিণ এশিয়ার ঐতিহ্য থেকে আসা সুর নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন।
উগান্ডার স্মৃতিতে মামদানি
মামদানির শৈশব ছিল এক চলমান ভূগোলের গল্প। উগান্ডার কাম্পালায় জন্ম, তারপর দক্ষিণ আফ্রিকার গণতান্ত্রিক রূপান্তরের উত্তাল সময়, আর শেষ পর্যন্ত নিউইয়র্কের ব্যস্ত মহানগর- এই তিন ভিন্ন নাগরিক বাস্তবতার অভিজ্ঞতা তাঁর চিন্তাকে গড়ে তুলেছে। কাম্পালার শান্ত সবুজে তিনি দেখেছেন দারিদ্র্য ও বৈষম্যের বাস্তবতা; দক্ষিণ আফ্রিকায় দেখেছেন জাতি ও ক্ষমতার লড়াইরত সমাজকে; আর নিউইয়র্কে এসে পেয়েছেন অভিবাসী জীবনের সংগ্রাম। এখানে তিনি শিখেছিলেন- রাজনীতি যদি বাস্তব মানুষের জীবন না বদলায়, তবে সেটি এখনো অসম্পূর্ণ। তাঁর বাবা মাহমুদ মামদানি ছিলেন কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, আর মা মীরা নায়ার আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্রনির্মাতা। তবু তাঁদের ছেলে বেছে নিয়েছেন এক ভিন্ন পথ- মানুষের জীবনের মাটিতে দাঁড়িয়ে রাজনীতি করা। বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত পরিবারে জন্ম হলেও মামদানি বেছে নিয়েছিলেন সাধারণ জীবন- অস্থায়ী ক্যান্টিনে শ্রমজীবীদের পাশে বসে ভাপানো প্ল্যান্টেন খেতেন, শহরে চলতেন বোডা মোটরবাইকে। এই মাটির কাছাকাছি থাকা দৃষ্টিভঙ্গিই তাঁকে দিয়েছে জনতার রাজনীতির শক্তি।
মেয়র নির্বাচনে ঐতিহাসিক জয়
২০২৫ সালের নিউইয়র্ক সিটি মেয়র নির্বাচনের প্রচারণা ছিল জোহরান মামদানির রাজনৈতিক প্রস্তাবের এক অগ্নিপরীক্ষা। তিনি এমন একটি প্ল্যাটফর্মে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন, যা কেবল রাজনৈতিক বাগাড়ম্বর ছিল না, বরং সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার কঠিন বাস্তবতার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল। তাঁর মূল প্রতিশ্রুতিগুলোর মধ্যে ছিল স্থিতিশীল ইউনিটগুলোর জন্য ভাড়া স্থবির করা, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পুরো শহরে ভাড়া-মুক্ত বাস চালু করা, সার্বজনীন শিশুযত্নের ব্যবস্থা করা এবং সবচেয়ে ধনীদের ওপর উচ্চ করের মাধ্যমে নতুন রাজস্ব তৈরি করা। তাঁর কেন্দ্রীয় যুক্তি ছিল সুনির্দিষ্ট- শহরের পুনরুদ্ধারকে আকাশচুম্বী ভবন বা ওয়াল স্ট্রিটের মুনাফা দ্বারা নয়, বরং মুদির বিল, স্কুল-পরবর্তী যত্নের সুযোগ এবং যাতায়াতের সময় দ্বারা পরিমাপ করা উচিত, যা বাবা-মা এবং বয়স্কদের কাছ থেকে মূল্যবান সময় চুরি করে না। প্রতিদ্বন্দ্বীর সংখ্যা ছিল বেশি এবং প্রতিযোগিতা ছিল তীব্র। প্রাক্তন গভর্নর অ্যান্ড্রু কুওমোর মতো ব্যক্তিত্বরা এমন এক ধরনের ক্ষমতার প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন, যা অনেক নিউইয়র্কবাসী দীর্ঘকাল ধরে জানতেন। অন্যদিকে রিপাবলিকান কার্টিস স্লিওয়া রক্ষণশীল শক্তি এবং প্রগতিশীল নীতিগুলির প্রতি অস্বস্তি একত্রিত করার লক্ষ্য নিয়েছিলেন। এই প্রচারণার সময় মামদানির বিশ্বাস ও পটভূমি নিয়ে প্রকাশ্যে আক্রমণ করা হয়, পাশাপাশি জননিরাপত্তা, স্কুল ভর্তি এবং পররাষ্ট্রনীতি সংক্রান্ত এমন বিতর্ক তোলা হয় যা কখনো কখনো স্থানীয় বিষয়গুলোকে ছাপিয়ে যেত। এই নির্বাচনটির অস্থিরতা সামাল দিতে প্রয়োজন ছিল সংগঠনের কঠোর শৃঙ্খলা। এরপর যা ঘটল, তা ছিল তাঁর মাঠের কৌশল এবং এক বাস্তব প্রদর্শনী। মামদানির প্রচারণায় ছোট দাতাদের ওপর জোর দেওয়া হয় এবং বহুভাষিক প্রচার চালানো হয়। সাধারণত যেখানে কম ভোট পড়ে, সেই ওয়ার্ডগুলোতে তরুণদের ভোটদান অপ্রত্যাশিতভাবে বেড়ে যায়। স্বেচ্ছাসেবকদের কার্যক্রম কেবল সাবওয়ে স্টপ বা মসজিদে সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং গির্জার বেসমেন্ট, ইউনিয়ন হল এবং সিনিয়র সেন্টারগুলোতেও দেখা যায়। নির্বাচনের শেষ মুহূর্তের যুক্তি ছিল একটাই- শহরটিকে সাশ্রয়ী এবং ন্যায্য করে তুলুন এমনভাবে যাতে বাসিন্দারা মাসের প্রথম দিনেই সেই স্বস্তি অনুভব করতে পারে। নির্বাচনের রাতে ফল ছিল সুস্পষ্ট। মামদানি শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটই পাননি, তিনি এমন এক ব্যবধানে জয়ী হন যা অনেককে অবাক করে দেয়। এই ঐতিহাসিক বিজয়ের মাধ্যমে তিনি নিউইয়র্ক সিটির প্রথম মুসলিম এবং প্রথম দক্ষিণ এশীয় মেয়র হওয়ার গৌরব অর্জন করেন এবং আধুনিক সময়ের মধ্যে এই পদে থাকা কনিষ্ঠতমদের মধ্যে একজন হয়ে ওঠেন। তাঁর সমর্থকরা এই বিজয়কে প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরেন যে- ভাড়াটিয়া, শ্রমিক, ছাত্র এবং ছোট ব্যবসার মালিকদের একটি জোট সত্যিই সিটিওয়াইড ক্ষমতা নিতে পারে। তবে তাঁর সমালোচকরা সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে বাজেট গণিত এবং বিচারিক সীমার সঙ্গে সংঘাতের ভবিষ্যদ্বাণী করতে শুরু করেছেন। মামদানির এই ঐতিহাসিক বিজয় নিউইয়র্কের রাজনীতিতে এক নতুন যুগের সূচনা করেছে, যার সত্যতা নির্ভর করবে তাঁর আগামী দিনের শাসনের ওপর।

শিল্পী থেকে নিউইয়র্কের ফার্স্ট লেডি
জোহরান মামদানি যখন মেয়র নির্বাচনে ইতিহাস গড়লেন, তখন শুধু তিনিই নন- আলো ছড়ালেন তাঁর স্ত্রী, তরুণ সিরীয়-আমেরিকান শিল্পী রমা দুওয়াজিও। ২৮ বছর বয়সি এই শিল্পীর জীবনের গল্প যেন এক রঙিন ক্যানভাস, যেখানে ছড়িয়ে আছে- অভিবাসনের স্মৃতি, শিল্পের নেশা, আর ভালোবাসার ছোঁয়া। ১৯৯৭ সালের ৩০ জুন টেক্সাসের হিউস্টনে জন্ম রমার। বাবা-মা দুজনই সিরীয় অভিবাসী। মাত্র নয় বছর বয়সে পরিবারসহ পাড়ি জমান সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে। সেখানে বেড়ে ওঠার সময়ই তিনি শিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হন। পরে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে ভর্তি হন ভার্জিনিয়া কমনওয়েলথ ইউনিভার্সিটিতে, যেখানে ইলাস্ট্রেশন ও অ্যানিমেশন নিয়ে পড়াশোনা করেন। রমার শিল্পজীবন তাঁকে নিয়ে গেছে লেবাননের পাহাড়ি শিল্পীদের আবাসে, আবার কখনো ফ্রান্সের ছোট্ট গ্যালারিতে- যেখানে তাঁর চিত্রকর্ম দর্শকদের মনে রেখাপাত করেছে। তাঁর কাজ প্রকাশিত হয়েছে ওয়াশিংটন পোস্ট, দ্য নিউইয়র্কার ও হার্পার’স বাজার- এর মতো গণমাধ্যমে। ২০২১ সালে তিনি নিউইয়র্কে শিল্পচর্চার নতুন দিগন্তে আসেন। ভর্তি হন স্কুল অব ভিজ্যুয়াল আর্টস-এ, যেখান থেকে ২০২৪ সালে ফাইন আর্টসে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। একই বছর ডেটিং অ্যাপ হিঞ্জ-এর মাধ্যমে পরিচয় হয় জোহরান মামদানির সঙ্গে- যিনি তখন রাজনীতির মঞ্চে উঠতে শুরু করেছেন। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে তাঁদের বিয়ে হয় নিউইয়র্কে, এরপর উগান্ডার কাম্পালায় আয়োজন করা হয় এক উষ্ণ সংবর্ধনা। নির্বাচনি প্রচারণার পুরোটা সময় রমা ছিলেন স্বামীর অবিচল সহযাত্রী। অনলাইনে যখন তাঁকে নিয়ে ট্রল ছড়ায়, জোহরান স্পষ্ট করে জানান- ‘রমা শুধু আমার স্ত্রী নন, তিনি নিজেই এক অসাধারণ শিল্পী।’

একনজরে
জোহরান কোয়ামে মামদানি
জন্ম : ১৮ অক্টোবর ১৯৯১
কেন বিখ্যাত :
মামদানি হলেন নিউইয়র্ক সিটির প্রথম মুসলিম এবং দক্ষিণ এশীয় মেয়র।
রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি :
তিনি নিজেকে একজন গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রী (Democratic Socialist) হিসেবে বর্ণনা করেন, যার কোনো সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা না থাকলেও মূলত এর অর্থ হলো শ্রমিকদের পক্ষে কথা বলা, করপোরেশনদের পক্ষে নয়।
জানতেন কী :
তিনি ২০১০-এর দশকে একজন র্যাপার ছিলেন।
জন্মস্থান : উগান্ডা।
নিউইয়র্কে আগমন :
সাত বছর বয়সে পরিবারের সঙ্গে নিউইয়র্কে চলে আসেন।
শিক্ষা :
তিনি ব্রঙ্কস হাইস্কুল অব সায়েন্সে পড়াশোনা করেন। পরে বোডিন কলেজ থেকে আফ্রিকানা স্টাডিজে ডিগ্রি অর্জন করেন। সেখানে তিনি স্টুডেন্টস ফর জাস্টিস ইন প্যালেস্টাইনের ক্যাম্পাস চ্যাপ্টার প্রতিষ্ঠায় সহ-উদ্যোক্তা ছিলেন।
নাগরিকত্ব :
২০১৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাভাবিক নাগরিকত্ব (Naturalised American Citizen) লাভ করেন।
বংশ পরিচয় :
তিনি ভারতীয় বংশোদ্ভূত।
পিতামাতা :
তাঁর মা মীরা নায়ার একজন বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক।
তাঁর বাবা অধ্যাপক মাহমুদ মামদানি নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন।
পিতামাতা উভয়েই হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র।
স্ত্রী : মামদানি এবং তাঁর স্ত্রী ব্রুকলিন-ভিত্তিক সিরীয় শিল্পী রামা দুয়াজি (Rama Duwaji), ডেটিং অ্যাপ হিঞ্জ (Hinge)-এর মাধ্যমে পরিচিত হন।